বিজ্ঞান অভিযাত্রা ১৯৬৫

দণ্ডায়মান (বাঁ থেকে): এ কে কাজী জাকের হোসাইন (দলনেতা), প্রফেসর সালার খান (উদ্ভিদবিদ), লেখক (ছাত্র সদস্য), আবদুল (সহকারী), জিংলিয়ান (শিকারি) এবং বসা: ১২ জন উপজাতীয় কুলিছবি: লেখক

অভিযাত্রা শব্দটির সহজ অর্থ দাঁড়ায় ‘যাত্রা’। অভিযান অর্থেও তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়। তবে এর সঙ্গে ‘বিজ্ঞান’ কথাটা যোগ হলে তা তেমন আর সহজ থাকে না। জটিলই হয়ে দাঁড়ায়। এখন অভিযাত্রা শব্দটা হয়ে দাঁড়ায় খানিকটা জটিল, যা দুঃসাহসিক যাত্রা বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এখানে দুর্গম, দুঃসাহসিক কথাগুলো সহজে এসে যায়, কেননা বিজ্ঞান অনুসন্ধান, সত্য খোঁজা, প্রকৃতির অজানাকে জানার পথগুলো যে সহজে পাওয়া যায় না। তা বিপত্সংকুল বা ঝুঁকিপূর্ণ তো হওয়ারই কথা।

বিজ্ঞান অভিযাত্রার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Expedition’। অনেক ক্ষেত্রে তা Exploration-ও হতে পারে। এ বিষয়ের সঙ্গে আমরা খুব একটা পরিচিত না হলেও উন্নত বিশ্বে এর যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে। টিভি চ্যানেল খুললেই আমরা এর প্রমাণ পাই। প্রতিনিয়ত দুর্গম অঞ্চলে দু-চারটা এমনই অভিযাত্রার দৃশ্য দেখা যায়। সেসব অভিযাত্রী দল আফ্রিকা-আমাজন ও দুর্গম মরু অঞ্চলের কোথায় যায় না তারা? যায় সাগর জলের অতল গভীরেও। সেসব অভিযান বা অভিযাত্রা থেকে জানা যায় নতুন নতুন তত্ত্ব-তথ্য। এর পেছনে তারা খরচ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সম্প্রতি (২০১৫) ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের (WWF) তিব্বত মালভূমির মেকং নদী অভিযাত্রায় বিজ্ঞানীরা ১৬৩টি নতুন প্রজাতির প্রাণী শনাক্ত করেছেন। এর আগে এসব প্রজাতির অস্তিত্ব জানা ছিল না। বিজ্ঞানের জগতে এর মূল্য অপরিসীম। এখানে আরেকটা চমকপ্রদ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রকৃতিবিদ ডারউইন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত অভিযোজন বা বিবর্তন তত্ত্বের মূল উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন গালাপগোস দ্বীপমালা অভিযাত্রার প্রাণিকুলের সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ থেকে।

আজ থেকে অর্ধশতাব্দী (৫১ বছর) আগে (১৯৬৫) এমনই বিরল এক বিজ্ঞান অভিযাত্রার ছাত্র সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পেরে আমি গর্ববোধ করি। আমি তখন এমএসসির (কীটতত্ত্ব) শেষ বর্ষের ছাত্র। এই অভিযানের অর্থায়ন ও সাহায্যকারী সংস্থা ছিল এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান। পার্বত্য চট্টগ্রামের (বান্দরবান সাব-ডিভিশন) এই বিজ্ঞান অভিযাত্রার মূল নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন (জীববিজ্ঞানী), প্রয়াত প্রফেসর সালার খান (উদ্ভিদবিদ), আমি (ছাত্র সদস্য), আবদুল। এ ছাড়া রুমা বাজার থেকে ছিল আমাদের সার্বক্ষণিক বন্দুকধারী শিকারি ও প্রহরী জিংলিয়ান ব্যোম (সে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের ও অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সদস্য)।

প্রাক্-কথন

ঐতিহাসিক আমল থেকে আদি সভ্যতার দেশ ভারতে মহেঞ্জোদারো, মোগল আমল; বৌদ্ধযুগের অধ্যাত্মবাদ, দর্শন, সাংস্কৃতিক ও জনজীবনের নানাবিধ অগ্রগতি এবং বিকাশ লাভ হলেও প্রকৃতিচর্চা, বনাঞ্চল ও এর ছোট-বড় জীবজন্তু-কীটপতঙ্গ-সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চা বা গবেষণার পৌরাণিক দলিল খুব একটা পাওয়া যায় না। একইভাবে বনজ সম্পদ-সম্পর্কিত জরিপ বা তালিকার রেকর্ডও অপ্রতুল। এসব বিষয়ে আমাদের হাতে যে প্রামাণ্য দলিল রয়েছে তা হলো: Fauna and flora of British India। তখনকার ইংরেজ শাসকদের এই বৈজ্ঞানিক অন্বেষণ ও কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল তাদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ। ভারতের প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোভাবে না জানার কারণে দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, প্লেগ, বসন্ত, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তারা মারা যেত। সে সময় এসব রোগের প্রতিরোধ বা চিকিত্সা তেমন জানা ছিল না। কাজেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়া টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের প্রকৃতি অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য, আমাদের অঞ্চল (পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান) ব্রিটিশদের ও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের নেক নজরে পড়েনি। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের প্রতি শাসকগোষ্ঠী তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। এ ছাড়া তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট ও বান্দরবান এলাকার যাতায়াতব্যবস্থা ছিল বিপত্সংকুল ও দুর্গম। হাঁটা পথে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

সুতরাং প্রকৃতিবিদ জাকের স্যারের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে ‘বিজ্ঞান অভিযাত্রা ১৯৬৫’ ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সময়োচিত এক পদক্ষেপ। সেই সময় আমাদের এ যাত্রার আগে চট্টগ্রামের এই পাহাড়ি অঞ্চলে অন্য কেউই পরিদর্শন করতে আসেননি। বিশেষ করে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে।

এই বিজ্ঞান অভিযাত্রা ঢাকা থেকে ১১ জানুয়ারি, ১৯৬৫ সালে শুরু হয়েছিল। ১৩ তারিখ বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা হই। চড়াই-উতরাই, ভাঙা-কাটা, উঁচু-নিচু পথ, টিলা ডিঙিয়ে বান্দরবান পৌঁছাতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বন বিভাগের বাংলোতে রাত কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে এই প্রথম টের পেলাম, ঘনবসতি ছাড়িয়ে রিজার্ভ ফরেস্টের কাছাকাছি হলে অগণিত পাখি ও বন্য জন্তু-জানোয়ারের আকর্ষণীয় কিচিরমিচির ডাক, হল্লা যে এত আকর্ষণীয় ও বিস্তৃত হতে পারে তা জানা ছিল না। কৌতূহলী হয়ে জানালার পর্দা সরাতেই প্রায় চমকে উঠি। কুয়াশাভেজা সতেজ সবুজ গাছে যেন আগুন ধরে আছে। গাছের পাতা ছাড়িয়ে শুধু চোখে পড়ছিল টুকটুকে আগুনে লাল এক গাছ। লাল টুকটুকে পাখি সব ঝাঁকে ঝাঁকে জড়ো হয়েছে এই গাছে। জাকের স্যার পরে আমাকে জানিয়েছিলেন, ‘এগুলো স্কালেট মিনিবিক পাখি। এতগুলো একসঙ্গে পেয়ে যাব ভাবিনি। পাখিগুলো বনের আরও গভীরে থাকে বলে আমার জানা ছিল।’ আমি বিজ্ঞান অভিযাত্রার প্রথম পাঠ পেয়ে গেলাম। অর্থাত্ জীববিজ্ঞান অভিযাত্রার মূল উদ্দেশ্যগুলো হলো: ১. অজানা বনভূমির ধরন, বিস্তৃতি, পার্শ্ববর্তী দেশে এর প্রসার ২. রিজার্ভ বনাঞ্চলের ছোট-বড় পশুপাখি, গাছগাছালি দেখা, রেকর্ড ও নমুনা সংগ্রহ (সম্ভব হলে) এবং এসবের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিরূপণ করা।

পরদিন ১৪ জানুয়ারি সাঙ্গু নদী ধরে আমাদের যাত্রা শুরু হয় রুমা বাজারের দিকে, এটি সর্বশেষ পুলিশ স্টেশন। সাঙ্গু নদী গভীর নয়, আর নৌকাগুলো ছিল লগকাঠের ছিপ নৌকা ধরনের। পরের দিন বেলা তিনটার দিকে আমরা রুমা বাজার পৌঁছে যাই।

চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট ও বান্দরবান এলাকার যাতায়াতব্যবস্থা ছিল বিপত্সংকুল ও দুর্গম
ছবি: লেখক

১৭ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় আসল রিংখিয়াং লেকমুখী অভিযাত্রা (লেকের অপর পাড়ে বার্মা বর্ডার)। এই পথ দুর্গম বন্ধুর উঁচু পাহাড়ি, হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমাদের মালপত্র, খাদ্য-রসদ বহন করার জন্য জোগাড় হলো ১২ জন উপজাতীয় কুলি । এর মধ্যে টিপরা তরুণ কুলিরা ছিল বেশ কর্মঠ ও ভারী মাল বহনে পটু। পরপর সাংনাক্রো, দ্য সং সং কলিঙ্গ ও মধু পাহাড় অতিক্রম করে আমরা বেলা আড়াইটার দিকে পৌঁছে যাই সাংনাক্রোপাড়ায়। এই পথটুকু পার করতে গিয়ে লক্ষ করি, গভীর সবুজ বনের ওপরকার ঘনত্বের জন্য আকাশ দেখা যায় না। ফলে দুই পাড়েই যেন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। শীতও বাড়তে থাকে। পাড়ার উপজাতীয় নেতা আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন। তাঁর বাঁশের মাচাং ঘরে আমরা রাত কাটাই।

চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল রিংখিয়ান লেক সামনে রেখে আমাদের দ্বিতীয় দিনের যাত্রার আয়োজন শুরু হয় সকাল থেকে। আমাদের পরবর্তী ভ্রমণ প্রাণসা পাড়া হয়ে নাইনল পাড়া। এ পর্যায়ে আমার বোর্ড স্টাফিং প্রশিক্ষণ নিতে হলো জাকের স্যারের কাছ থেকে। কেননা, বন্দুক হাতে জিংলিয়ান শিকারির হাত নিশপিশ করছিল। সে আগের দিন সন্ধ্যালগ্নে চারটি পাখি মেরে নিয়ে এসেছিল। এই পাখিগুলোর ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। তাই যাত্রার আগেই পাখিগুলো সংরক্ষণ (স্টাফিং) করতে হলো। (চলবে...)

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী ও খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত