বিজ্ঞানচিন্তার জুড়ি নেই

বিজ্ঞান উৎসবসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে বিজ্ঞানচিন্তা। বিজ্ঞান উৎসবের জাতীয় পর্বে উপস্থিত অতিথিদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা। গত ২০ মার্চ বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে। প্রথম আলো
ফাইল ছবি।

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে আমার জন্ম। জন্মের কিছুদিন পরই হারিয়েছি বাবাকে। যৌথ পরিবারে বড় হওয়া। তবু নিজের মধ্যে সব সময় একটা শূন্যতা কাজ করত। প্রচণ্ড অন্তর্মুখী আমি নিজের শূন্যতাকে দূর করার জন্য আঁকড়ে ধরেছিলাম বইকে।

আমাদের বাড়িতেই ছিল বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। ধীরে ধীরে যুক্ত হলাম আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত সুধীজন পাঠাগারের সঙ্গে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে, অবসরের পুরো সময়টাই কাটাতাম পাঠাগারে।

বই পড়ার পাশাপাশি পাঠাগারে বইয়ের ক্যাটালগ তৈরি থেকে শুরু করে কাউন্টারে বসে পাঠকদের সেবা দেওয়ার কাজও করতাম। টিনটিন, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, তিন গোয়েন্দা, শার্লক হোমস, নানা ধরনের কিশোর ক্ল্যাসিক, আইজ্যাক আসিমভ, জুল ভার্ন, এইচ জি ওয়েলসের সায়েন্স ফিকশন, আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দিন, আলী আসগর, প্রবীর ঘোষ, শিশু-কিশোরদের ম্যাগাজিন—কিছুই বাদ যায়নি পড়ার তালিকা থেকে।

সপ্তম শ্রেণিতে যখন পড়ি, তখন যুক্ত হই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচির সঙ্গে। পরপর তিনবার অর্জন করে নিই সেরা পাঠকের পুরস্কার। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই পড়ে বাসায় নানা এক্সপেরিমেন্ট করতাম, স্কুলের বিজ্ঞান মেলার পাশাপাশি অংশ নিতাম জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান মেলায়। স্কুলের পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগত বিজ্ঞান ও গণিত। আর যে বিষয়গুলো মুখস্থনির্ভর, সেগুলো পড়তে একটুও ভালো লাগত না।

আমাদের ছেলেবেলার সেই সময়ে বই পড়া, বাসার পাশের মাঠে খেলাধুলা করা আর মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশন দেখা—এই তিনটাই ছিল অবসরের সঙ্গী। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে সেই পরিবেশ ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। স্মার্ট ডিভাইসের পর্দায় কেটে যাচ্ছে দিনের সিংহভাগ সময়। সেই সঙ্গে বাড়ছে পড়াশোনার সুযোগও। সারা বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার এখন আমাদের কাছে উন্মুক্ত। এক ক্লিকেই জানতে পারছি অজানা সব তথ্য, মেটাতে পারছি আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা। জানার, বোঝার, পড়ার এত সুযোগ থাকার পরও আমরা কি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি, নাকি হারিয়ে যাচ্ছি তথ্যের ভিড়ে?

বিজ্ঞান আমাদের বিভ্রান্তির পথ থেকে সরিয়ে সঠিক পথ দেখায়, পৌঁছে দেয় সত্যের কাছে। আমরা খুঁজে পাই অনুসন্ধিৎসু মনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর। আমাদের শিশু-কিশোরদের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দেওয়ার এই দুরূহ কাজটাই সহজভাবে করে যাচ্ছে বিজ্ঞানচিন্তা

বিজ্ঞানচিন্তার জন্মলগ্ন থেকেই আমি ম্যাগাজিনটির নিয়মিত পাঠক। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার, নোবেলজয়ীদের তথ্য, বিজ্ঞানবিষয়ক বই পর্যালোচনা, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার, নানা রকম অলিম্পিয়াড সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য—সব আমরা এতে এক মলাটের মাঝে পেয়ে যাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকসের মতো আধুনিক প্রযুক্তি নিয়েও বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা।

আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন নারী বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার বিজ্ঞানচিন্তার‍ বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। STEM–এ (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এই প্রতিবেদনগুলো অনেক বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

এককথায় বলা যায়, আমাদের কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞানবিষয়ক আগ্রহ মেটাতে বিজ্ঞানচিন্তার জুড়ি নেই। আজ ১৫ অক্টোবর বিজ্ঞানচিন্তার সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অনেক অনেক অভিনন্দন ও ভালোবাসা। আমি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই।

জয় হোক সত্যের। জয় হোক বিজ্ঞানের।

  • লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াড এবং অধ্যাপক, রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়