কীভাবে বিলুপ্ত হলো ডাইনোসর?

পৃথিবীর সব মহাদেশেই ডাইনোসরদের ছিল অবাধ বিচরণ। রাজত্ব বললেও দোষ নেই। তবে কেমন করে হারিয়ে গেল এরা?

ডাইনোসরদের উত্পত্তি ঠিক কত আগে, সেটা নিয়ে চলছে বহু গবেষণা। ধারণা করা হয়, ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকে এসে, অর্থাৎ ২৩১ থেকে ২৪৩ মিলিয়ন বছর আগের কোনো একসময়ে এর গ্রুপগুলোর জন্ম। জুরাসিক যুগে এর আধিপত্য ছিল পৃথিবীজুড়ে। আর প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ক্রিটেশাস-প্যালিওজিনের বিলুপ্তির ঘটনায় পৃথিবীতে এদের বিদায়ঘণ্টা বাজে। সবচেয়ে বড় যে প্রাণী, গণ কিংবা প্রজাতিভেদে ৭০-৮০ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারত যেগুলো, যাদের ওজন হতে পারত ১০০ টন পর্যন্ত, তাদের একদম বিলুপ্তির কারণ নিয়ে এখনকার পৃথিবীতে রাজত্ব করা মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।

বিজ্ঞানীরা একমত, পৃথিবীতে অন্তত পাঁচটা মহাবিলুপ্তি ঘটেছে। কোনো একটা কারণে জলবায়ু হঠাৎ বদলে গিয়ে প্রাণধারণের জন্য প্রায় অনুপযোগী পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াতেই এই মহাবিলুপ্তিগুলো ঘটেছে। প্রতিবারই সমসাময়িক পৃথিবীর উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীদের অধিকাংশ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অল্প কয়েক শতাংশ যে বেঁচে গিয়েছিল, তা থেকেই আবার অভিযোজনের মাধ্যমে উত্পত্তি ঘটে নতুন নতুন প্রজাতির। ধারণা করা হয়, এখন পর্যন্ত শেষ মহাবিলুপ্তি হলো ক্রিটেশাস-প্যালিওজিন বিলুপ্তি। এতেই হারিয়ে গেছে দৈত্যাকার ডাইনোসররা। এই বিলুপ্তি খুব বেশি পরিচিত কে-পিজি বা কে-টি (K-Pg বা K-T) বিলুপ্তি নামে। কে-টি বিলুপ্তির জন্য আগ্নেয়গিরিকে যাঁরা দায়ী করেন, তাঁদের মতে, পৃথিবীজুড়ে নানা এলাকায় লাভা নিঃসরণ প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল বাতাসে। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছিল ছাই, সালফার আর ধাতব কণা। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া কণাগুলো যখন কুয়াশার মতো সৃষ্টি করে সূর্যরশ্মিকে ঢুকতে দিচ্ছিল না পৃথিবীতে, তখনই ঘটে বিপত্তি। পানির ক্ষুদ্র প্ল্যাংকটন থেকে শুরু করে সব উদ্ভিদই সালোকসংশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয় তাতে। আর উত্পাদক পর্যায়ে খাদ্য তৈরি বন্ধ হওয়ায় খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলেই মৃত্যু ঘটতে থাকে সব জীবের।

কে-টি বিলুপ্তির কারণ হিসেবে চমকপ্রদ আরেকটা ব্যাখ্যা আছে। এই তত্ত্বমতে, পৃথিবীর সঙ্গে কোনো এক গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে ঘটেছে এমন ঘটনা। বিশালকায় গ্রহাণু প্রচণ্ড গতিতে ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানলে সুনামি ও ভূমিকম্প হওয়ার কথা, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার কথা নানা রকম ধূলিকণা, ধাতব কণা। আগ্নেয়গিরির মতো একই গল্প তৈরি হওয়ার কথা এরপরে। প্রথম দিকে এই তত্ত্বকে তেমন কেউ মেনে না নিলেও হঠাৎ করে ১৯৮০ সালে বেশ বড় একটা প্রমাণ পাওয়া যায় এর পক্ষে। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী লুইস আলভারেজ আর তাঁর ছেলে ওয়াল্টার মাটিতে অবস্থান্তর ধাতু ইরিডিয়ামের প্রায় ৪৬ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি আস্তরণ খুঁজে পান। ভঙ্গুর এই অবস্থান্তর মৌলের আস্তরণের খোঁজ মেলে পৃথিবীজুড়ে আরও শতাধিক জায়গায়। এমনিতে এই ধাতুটি সোনার চেয়েও দুর্লভ। তাহলে কেমন করে তৈরি হলো এই আস্তরণের?

পৃথিবীতে ইরিডিয়াম দুর্লভ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু মহাকাশেও যে দুর্লভ তা তো নয়! তাই বলা যেতে পারে, মহাশূন্য থেকে আছড়ে পড়া গ্রহাণুতে ছিল এই ধাতু, যা সংঘর্ষের সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। এরপর এগুলো শান্ত-স্থির হয়ে যখন মাটিতে জমাট বাঁধে, তখন তৈরি হয় এমন আস্তরণের। এই আস্তরণের মধ্যে শুধু যে ইরিডিয়াম মিলেছে তা নয়, পাওয়া গেছে প্রচণ্ড চাপে তৈরি হওয়া শকড কোয়ার্টজ আর কাচের গুঁড়ো, যখন গলিত পাথর বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে, এরপর আবার ঠান্ডা হয়ে জমা হয়, তখন কাচের গুঁড়ো তৈরি হতে পারে। আর বড় রকমের দাবানলের আলামত হিসেবে পাওয়া গেছে প্রচুর ছাই আর ঝুলও (Soot)। গ্রহাণুর সংঘর্ষের নমুনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় উত্তর আমেরিকায়। মেক্সিকোর উপসাগরে সুনামির কবলে ছড়িয়ে পড়া পাথর, নানা এলাকায় দুর্লভ ধাতুর অস্তিত্ব, হাইতির কাদামাটিতে কাচের গুঁড়ো ইঙ্গিত দেয় গ্রহাণুর আছড়ে পড়ারই।

টেলিস্কোপে চাঁদের দিকে চোখ রাখলেই আমরা যেমন বিশাল বিশাল ক্র্যাটার (গ্রহাণুর আঘাতে তৈরি বিশালকায় গর্ত) দেখতে পাই, তেমনটা পৃথিবীতে দেখতে পাই না। তাই এসব আলামত গ্রহাণুর আঘাত থেকে তৈরি, নাকি পুরোটাই আগ্নেয়গিরির কর্ম, তা নিয়ে বিতর্ক ছিলই। কারণ, কে-টি বিলুপ্তির মতো বিশাল বিলুপ্তির জন্য প্রয়োজন অন্তত ১০ কিলোমিটার ব্যাসের এক গ্রহাণুর আঘাতের। আর সেটা এত জোরে আছড়ে পড়তে হবে, যেন অন্তত ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের একটা গর্ত তৈরি হয়। তখনো যেহেতু আগ্নেয়গিরিগুলো জীবিত ছিল, তাই আগ্নেয়গিরি তত্ত্ব আর গ্রহাণুর আঘাত তত্ত্ব, কোনোটাকেই নিশ্চিত কারণ হিসেবে ধরার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না।

১৯৯০ সালে বিতর্কটা প্রায় থেমেই গেল যখন ভূবিজ্ঞানী অ্যালান হিল্ডেব্র্যান্ড মেক্সিকোতে উপকূলের কাছাকাছি সাগরতলে খুঁজে পেলেন বিশাল একটি ক্র্যাটার। প্রায় ১৮০ কিলোমিটার প্রশস্ত এই গর্তের কাছে অদ্ভুতুড়ে অভিকর্ষ বল লক্ষ করা গেল। সেই সঙ্গে আরও দেখা গেল আগ্নেয়শিলা, কাচের গুঁড়া, ব্রেক্কিয়া (খনিজ সিমেন্ট দিয়ে ভাঙা পাথর জোড়া লেগে তৈরি)। এই সবকিছু একটা জিনিসেরই ইঙ্গিত দেয়, গ্রহাণুর সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ।

ক্র্যাটারের আকৃতি থেকে টের পাওয়া যায়, গ্রহাণুটি আছড়ে পড়েছিল কোনাকুনিভাবে। ফলে এটি ভূপৃষ্ঠ ধরে অনেকটা পথ পিছলে গিয়ে উত্তর আমেরিকার দিকে ধুলোবালু ও পাথরের টুকরো ছড়িয়ে দিয়েছে। এত বড় গ্রহাণুর আঘাতের প্রচণ্ড কাঁপুনিতে পাথর ভেঙেচুরে যাওয়ার কথা, গলিত পাথর বায়ুতে ছড়িয়ে পড়ার কথা, আর প্রচণ্ড তাপে আশপাশের সবকিছু একদম ধ্বংস হওয়ার কথা।

বিজ্ঞানীদেরও ধারণা, বিশাল এই সংঘর্ষ সেই কাজটিই করেছে। এত জোরে আঘাতের ফলে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে, সেটি হবে এখন পর্যন্ত মানুষের নথিভুক্ত সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। ধারণা করা হয়, সেটি ছিল ১১ মাত্রার ভূমিকম্প। আশপাশের সবকিছু তাতে এত জোরে ছিটকে যাবে, যাতে অনেক কিছুই বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে যাবে। আর যেসব জিনিস মাটিতে ফিরবে, সেগুলো ফিরবে জ্বলন্ত অবস্থায়। অর্থাত্ একটা অগ্নিবৃষ্টির কবলে পড়বে এলাকাটা। এতে আশপাশে যে বিশাল অগ্নিকাণ্ড হবে, তাতে সব জীব মারা পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ক্র্যাটারের আকৃতি ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, আঘাতের সময়ে আশপাশের সবকিছু একদম তরলের মতো আচরণ করছিল। আর সেই সঙ্গে গলিত পাথর, সালফার, ছাই বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ায় পৃথিবী কুয়াশাচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল, যেটি কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত বিদ্যমান থাকতে পারে। এটি কিন্তু প্রাণের জন্য ভয়াবহ হুমকি ছিল। এতে সাগরের ফাইটোপ্ল্যাংকটন, আর ভূমির উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর এগুলো যেহেতু খাদ্যশৃঙ্খলের একদম গোড়ার উপাদান, তাই পুরো জীবকুলই ভুগতে শুরু করেছিল।

এখানেই শেষ নয়। গ্রহাণুটা যেখানে পড়েছিল সেখানে ছিল প্রায় তিন কিলোমিটার পুরু কার্বনেট পাথরের স্তর। যখন বায়ুমণ্ডল মোটামুটি পরিষ্কার হলো, তখন শত শত কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গেল প্রায় ১০ ডিগ্রি। প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে নেমে এল অ্যাসিড-বৃষ্টি হয়ে। হিসাব করে দেখা গেছে, এতে মোটামুটি তখনকার পৃথিবীর প্রাণিকুলের ৭০ শতাংশ প্রজাতির সব প্রাণীই মারা পড়েছিল এর ফলে, যার মধ্যে রয়েছে ডাইনোসরের প্রায় সব প্রজাতি। যেহেতু বেশির ভাগ ডাইনোসর বিশালকায়, সেগুলোই মারা পড়ল আগে।

মেক্সিকোর ইউকাতান উপদ্বীপের চিকশুলুব অঞ্চলে এই গ্রহাণু আঘাত করেছিল বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন। এই আঘাতের ফলে একে বলা হয়ে থাকে চিকশুলুব সংঘর্ষ। চিকশুলুব শহরের কাছে ১৮০ কিলোমিটার ব্যস আর ২০ কিলোমিটার গভীরতার যে ক্র্যাটারটি পাওয়া গেছে, বিজ্ঞানীরা হিসাবনিকাশ করে এর বয়স বের করেছেন ৬৬ মিলিয়ন বছরের কিছুটা কম। এটা কে-টি বিলুপ্তির ঘটনার সময়কালের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। কেউ কেউ অবশ্য এখনো বিশ্বাস করেন, এই আঘাতের ফলেই সব ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটেনি। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে এরা। আর ওই মহাবিলুপ্তির ৩ লাখ বছর আগেই চিকশুলুব সংঘর্ষ হয়েছিল বলেও অনেকে ভেবে থাকেন। কারণ, ডাইনোসরের অনেক ফসিল পাওয়া গেছে ধ্বংসাবশেষের ওপরে। অবশ্য এমনটিও হতে পারে, আঘাতের ফলে হওয়া সুনামির কারণে ফসিলগুলো ওপরে উঠে এসেছে। সেখানে যে গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল সেটি নিশ্চিত, কিন্তু সেটিই যে একসঙ্গে সব ডাইনোসরের ভবলীলা সাঙ্গ করেছে, তার প্রমাণ কষ্টসাধ্য। কারণ, প্রায় ৪৬ মিলিয়ন বছর আগেকার পাথরের বয়স কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা যায় না। তবু এখন পর্যন্ত ডাইনোসরদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা। তবে নিশ্চিত কারণটা আমাদের কখনোই জানা হবে না।

পৃথিবীর প্রতিটা কোণে রাজত্ব করা ডাইনোসর যে এক মহাবিলুপ্তির কবলে পড়ে একদম বিলুপ্তই হয়ে গেছে, তেমনটি কিন্তু না। ডিপ্লোডকাস, ব্রাকিওসরাসের মতো দৈত্যাকার ডাইনোসররা হারিয়ে গেছে যদিও, তবে এখনকার পাখিরাও কিন্তু ডাইনোসরের বংশধর। নন-এভিয়ান ডাইনোসররা সব এখন বিলুপ্ত হলেও এভিয়ান ডাইনোসর, অর্থাৎ এভিস শ্রেণির জীব, আধুনিক ডাইনোসররা উড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের আশপাশেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: উইকিপিডিয়া; হাউ ইট ওয়ার্কস

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত