গাছের দর্জি

২০১৬ সালে ব্ল্যাস্ট ফাঙ্গাসের আক্রমণে মাঠের পর মাঠ গম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া একই ফাঙ্গাসের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলো ধানের উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের দেশে। মজার ব্যাপার হল, বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে OsERF22 নামে এক রেগুলেটরি প্রোটিনের সন্ধান পেয়েছেন। এই প্রোটিন ব্যবহার করেই ফাঙ্গাস ধানে ব্ল্যাস্ট রোগ ছড়ায়। বিজ্ঞানীরা বিখ্যাত জিনোম এডিটিং টুল ক্রিসপার–কাস৯ ব্যবহার করেছেন ফসলের ডিএনএ থেকে OsERF22 কেটে সেটাকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য। ফলে এখন ফাঙ্গাস ওই প্রোটিন ব্যবহার করে ধানে ব্ল্যাস্ট ঘটাতে পারছে না। আক্রান্ত গমগাছেও কিছু জিনের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের গমের ব্ল্যাস্ট রোগকে প্রতিরোধের জন্য এখন এই জিনকে টার্গেট করে ক্রিসপার–কাস৯ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ধান ও গম দুটোই এখন বাজারে আসার অপেক্ষায়।

ক্রিসপার–কাস৯-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এর মাধ্যমে কোনো বহিরাগত জিনের অনুপ্রবেশ ছাড়াই খুব সহজে জিন পরিবর্তন করা সম্ভব। ফলে এসব গাছ জিএমও বা জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্ল্যান্টের চিহ্ন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না! যদিও GMO প্ল্যান্ট বা এদের ফলমূল মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, তারপরও কিছু মানুষ ভুল বুঝে জিএমও ফুড এড়িয়ে চলেন। কিছু ট্র্যান্সজেনিক গাছ আছে, যারা পোকামাকড় প্রতিরোধী প্রোটিন তৈরি করতে পারে। এসব গাছ নিবিড় ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখতে হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাপনার জন্য বহু বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের দরকার হয়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ক্রিসপার–কাস৯-এর পাওয়া গাছে কোনো বহিরাগত জিন পাওয়া যায়নি। কারণ, এ পদ্ধতিতে গাছ তার নিজস্ব এডিটিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে জিনের পরিবর্তন ঘটায়।

২০১৬ সালে অ্যামেরিকার কৃষি বিভাগ বাদামি বর্ণহীন মাশরুমকে বাজারজাত করার অনুমতি দেয়। মাশরুমের জীবনকাল বৃদ্ধির জন্য একধরনের জিন নিষ্ক্রিয় করেন বিজ্ঞানীরা, এই জিন পলিফেনাল অক্সিডেজ উৎপন্ন করে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ ঘোষণা করেছে, ক্রিসপারের সাহায্যে এডিটেড ভুট্টা, সয়াবিন, টমেটো, ক্যামেলিনা, জিএমএওর চেয়ে আলাদা। যদিও পরে এসব এডিটেড গাছকে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের কিছু অ্যাসিড টেস্ট পাস করতে হয়েছে। ডুপোর্ট পাওনিয়র একধরনের ভুট্টার জিনকে এডিট করেছিলেন, শুধু ব্র্যাঞ্চড চেইন পলিস্যাকারাইড (অ্যামাইলেপেক্টিন) তৈরি করার জন্য। এটি করা হয়েছিল ক্রিসপার–কাস৯ দ্বারা ওয়াক্সি (মোমজাতীয়) জিনকে বন্ধ করে। এই ওয়াক্সি জিনটি স্ট্রেট চেইনড পলিস্যাকারাইড অ্যামাইলোজ তৈরি করে। সুতরাং যখন এই জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তখন উদ্ভিদগুলো কেবল শাখাযুক্ত শিকলবিশিষ্ট অ্যামাইলো প্যাকটিন তৈরি করে। এ ধরনের অ্যামাইলোপ্যাকটিনসমৃদ্ধ ভুট্টা প্রক্রিয়াজাত খাবার, আঠালো এবং উচ্চ-গ্লাস কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

পরীক্ষাগারে অন্যান্য অনেক জিনকে নিষ্ক্রিয়তা এমনকি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হচ্ছে। এখানে নিষ্ক্রিয়তা মানে হচ্ছে যে জিনকে নিষ্ক্রিয় করতে চান, সেটাকে খুঁজে বের করে ক্রিসপার–কাস৯ দ্বারা কেটে দেয়া। জিনটি কেটে ফেললে কোষের নিজস্ব মেরামত সিস্টেমগুলো সারিয়ে ফেলতে পারে। এ সময় যদি কোনো টেমপ্লেট না থাকে, তবে মেরামতের সময় কিছু নিউক্লিওটাইড মুছে যায় এবং জিনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এ ধরনের জিন নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে ধান ও গমে ব্ল্যাস্ট রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে ধানে ব্যাকটেরিয়াজনিত ব্লাস্ট রোগ, গমের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়া রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। টমেটো ও ধানের খরা সহনশীলতা বৃদ্ধিও সম্ভব হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়।

কোনো জিনের মধ্যে কিছু নিউক্লিওটাইড প্রতিস্থাপন করতে চাইলে একটি উপযুক্ত টেমপ্লেট সরবরাহ করতে হবে। সেটা কোষের মেরামত সিস্টেমকে কমপ্লিমেন্টারি নিউক্লিওটিড স্থাপন করতে ব্যবহৃত হবে। এ ধরনের মেরামতকে হোমোলজি ডিপেনডেন্ট রিপেয়ার বলে। এই মেরামত–প্রক্রিয়া ব্যবহার উন্নত জাতের উচ্চফলনশীল ও খরা সহনশীল ভুট্টা, লবণ ও খরা সহনশীল ধান এবং আয়রন সমৃদ্ধ গম তৈরি করা হয়েছে।

এ ছাড়া বেস এডিটিং নামে একটি পদ্ধতি আছে। সেটা ক্রিসপার–কাস৯ পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব সহজেই নিউক্লিওটাইড বেসের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এ কাজ সম্পন্ন হয় সাইটিডাই ডি অ্যামিনেজ নামের এনজাইমের সাহায্যে। কাস৯, যার ভেতর নিউক্লিয়েজ নেই, তাকে ওই এনজাইমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। এটা C নিউক্লিটিডকে T নিউক্লিটিডে পরিবর্তন করতে পারে। কিছু বিজ্ঞানী ইতিমধ্যে প্রোটিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে ব্যকটেরিয়া থেকে অ্যাডিনিন ডিঅ্যামাইনেজ উত্পন্ন করেছেন। সেগুলো C নিউক্লিটিডকে T নিউক্লিটিডে পরিবর্তন করতে সক্ষম। Mir-156 জিনের ভেতর পরবর্তী রূপান্তরটি ব্যবহার করে আদর্শ আর্কিটেকচার এবং উচ্চফলনশীল ধান উত্পাদন করা হচ্ছে। ক্রিসপার-কাস৯ শুধু ভাইরাস বা ছত্রাকের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টিতেই ব্যবহৃত হচ্ছে না, নানা রকম ফল, যেমন, লং শেল্ফ ও বিভিন্ন রঙের টমেটো যেমন, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি এবং লাইকোপিন সমৃদ্ধ টমেটো তৈরিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। লাইকোপিনে অ্যান্টি ক্যানসারযুক্ত বৈশিষ্ট রয়েছে। বুনো টমেটোতেও উচ্চ প্রতিরোধক এবং উচ্চপুষ্টির মতো প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যদিও এটাকে চাষযোগ্য টমেটোতে পরিণত করার জন্য এর কিছু নির্দিষ্ট জিনকে ক্রিসপার-কাস৯ ব্যবহার করে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে।

লেখক: জেবা ইসলাম সেরাজ, অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং

আয়শা আক্তার, গবেষণা সহযোগী, প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি ল্যাবরেটরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়