জীবজগতে জীবজ দ্যুতি বা আলোর বিচ্ছুরণ শক্তির যেই অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, তা প্রধানত জোনাকি পোকাকে কেন্দ্র করে। ছোটবেলা থেকে আমরা তা দেখে এসেছি গ্রামগঞ্জের বনজঙ্গলে। সেই দেখা এতই সহজাত ছিল যে আমরা তা বরাবর দেখেছি গঞ্জগ্রামের বাড়িঘরের আশপাশেও। এমনকি তা দেখা গেছে অতীতের ছোট আকারের এই ঢাকা শহরেও। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে জোনাকির পরে তা দেখেছিলাম মাটির নিচের কেঁচোতে। অথচ সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, জীবজ দ্যুতি বা বায়োলুমিনেসেনস (Bioluminescence) প্রক্রিয়া এককোষী প্রাণী বা উদ্ভিদ থেকে নিয়ে মাছ পর্যন্ত অনেক প্রজাতিতেই বিরাজমান। এর মধ্যে রয়েছে কিছু ছত্রাক, সামুদ্রিক শৈবাল। ব্যাকটেরিয়া, কীটপতঙ্গে প্রজাতিতে জীবজ দ্যুতির বিস্তারের ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীও।
সাধারণভাবে জানা যায়, এই জীবজ দ্যুতি প্রাণীদেহের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সংঘটিত হয়। যাতে জীবদেহের কিছু আলোবিচ্ছুরণশীল কণিকা ও বিজারকের (এনজাইম) সাহায্যে কার্যকর হয়। আলোক কনিকাটি লুসিফারিন (Luciferin) এবং বিজারকটি লুসিফারেজ (Luciferage) নামে পরিচিত। এই রাসায়নিক উপাদান দুটির পরিচিতি জীবজ দল বা প্রজাতির বিবেচনায় নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন জোনাকি পোকার লুসিফারিন এসব ক্ষেত্রে বিজারক লুসিফারেজ লুসিফারিনকে জারণ (Oxidadion) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকর করে। যার ফল হিসেবে আমরা প্রকৃতিতে কোনো প্রাণীর শরীর থেকে আলোককণিকার বিচ্ছুরণ দেখতে পাই। এই নির্দিষ্ট বিক্রিয়াটি দেহকোষের অভ্যন্তরে শক্তি প্রদানকারী অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন দ্বারা ফসফেট শক্তিতে পরিণত না হয়ে জৈব-আলো উত্পাদনে ব্যবহৃত হয়। জীবজ দ্যুতি উত্পাদনকারী জীবদেহে অনেক রকম লুসিফরিন ও লুসিফারেজ বিদ্যমান থাকে। সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন জীবদেহে একেক রকমে সম্পৃক্ত থাকে। সুতরাং সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায়, জীবদেহ প্রকৃতি থেকে যে আলো গ্রহণ করে, তার ওপর এই আলো নির্ভরশীল নয়। বরং এটি একপর্যায়ের রাসায়নিক আলোক বিক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তি আলোকশক্তির রূপ নেয়। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রজাতির বিজারক লুসিফারেজের কার্যকরণের জন্য কোফ্যাক্টরের (Cofactor) প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেশিয়াম আয়রনের প্রয়োজন হয়। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে, শক্তিবাহক যৌগ অ্যাডনোসিন ট্রাইফসফেটও (ATP) দরকারি উপাদান হিসেবে প্রয়োজন হতে দেখা যায়।
অভিযোজনের দৃষ্টিকোণ থেকে লুসিফারিনের খুব একটা পরিবর্তন হয় না। এক হিসাবে দেখা গেছে, একটি বিশেষ বিজারক ১১টি ভিন্ন ভিন্ন পর্বে (Plyla) রয়েছে, যা সাধারণত প্রাণীদলগুলো খাদ্যের মাধ্যমে পেয়ে থাকে।
ঐতিহাসিক আমল থেকে এসব প্রজ্বলনক্ষম জীবজ বৈচিত্র্যের বিষয়টি জানা থাকলেও গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও প্লিনি ভেজা কাঠে এর প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছিলেন। এর কয়েক শতাব্দী পরে রবার্ট রয়েল এসব কাষ্ঠখণ্ডে ও দ্রুতিসম্পন্ন প্রাণীতে যে আলোর বিচ্ছুরণ হয়, তাতে অক্সিজেনের নির্দিষ্ট ভূমিকা সম্পর্কে অভিহিত করেন। তবে জীবজ দ্যুতি সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। তবে বেকার ১৭৫৩ সালে ফ্লাজিলেটস Noctiluca-কে আলোক দ্যুতিসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পরে হেলার অষ্টাদশ শতাব্দীতে উল্লেখ করেন যে মৃত গাছের কাঠে যে আলো দেখতে পাওয়া যায়, তা দ্যুতিসম্পন্ন ছত্রাক সুতলি (Fungi hyphae) থেকে উত্সারিত। ট্যাকি (১৮১৮) সালে তাঁদের ‘জায়েরি অভিযাত্রায়’ জৈবদ্যুতিসম্পন্ন জলজ প্রাণী সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্যে প্রজ্বলনক্ষম চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি সংগ্রহ উল্লেখযোগ্য অণুবীক্ষণীয় অনুসন্ধানে তিনি এই প্রজ্বলনক্ষম কণার সন্ধান পান জলজ প্রাণীর মগজে।
চার্লস ডারউইন তাঁর বিখ্যাত সাগর, অভিযাত্রার নিবন্ধে রাতের বেলায় জীবজ দ্রুতিসম্পন্ন প্রাণীগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। এর মধ্যে তাঁর জেলিফিশের সন্ধান উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান সময়ে এই দ্যুতি নিয়ে পৃথিবীর অনেক গবেষণাগারে কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে, এর ব্যবহারিক দিক নিয়ে নানামুখী অনুসন্ধান চলছে। বর্তমানে গবেষণাগারে বিশেষ করে বংশগতিক প্রযুক্তিবিদ্যা ও জীবজ চিকিত্সাশাস্ত্রের পর্যবেক্ষণে লুসিফারেজ–সংশ্লিষ্ট পদ্ধতির ব্যবহারের যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে। একপর্যায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকার নৌবাহিনী এর প্রযুক্তিগত ব্যবহারে সম্ভাবনার ওপর আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে জানা যায়।
এখানে স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন এসে যায়। তা হলো কোনো কোনো বিশেষ জীবজ গোষ্ঠীতে জীবজ দ্যুতির উপস্থিতির কারণ কী? ঐতিহাসিক আমল থেকে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী মহল নানামুখী অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করেছে। তা থেকে ধরে নেওয়া যায় যে প্রাণীদেহে এই দ্যুতি প্রধানত তিন কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রথমত এই জীবজ দ্রুতি ছড়িয়ে প্রাণী এদের শিকারকে আকর্ষণ করে এবং পরে ধরে খায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রাণী আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে শিকারি প্রাণীকে অন্য পথে পরিচালিত করে এবং নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হয়। জীবজ দ্যুতি পরস্পরের যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে করে। শেষোক্ত কারণটি একই প্রজাতির সদস্যের মধ্যে ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ জোনাকি পুরুষ পোকার দ্যুতি স্বগোত্রীয় স্ত্রী পোকার সন্ধানে সহায়তা করে। সামগ্রিক বিবেচনায় বিজ্ঞানী মহলের পর্যবেক্ষণের স্বীকৃতি যে জীবজ দ্যুতি প্রক্রিয়াটি স্বতন্ত্রভাবে একাধিকবার প্রকৃতিতে উত্পত্তি লাভ করেছে। অর্থাৎ এই দ্যুতি অন্যান্য ক্ষুদ্র অঙ্গাদি যেমন সাইটোক্রম, হিপ্টন ও ডিএনএ/আরএনএ ক্রমাবিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়নি। এসব তথ্য ও কার্যকারিতার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবজগতের ক্রমবিকাশের ধ্যানধারণা অনেকটা স্পষ্টত লাভের সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে ধরে নেওয়া যায়। অন্যদিকে জীবজ দ্যুতির উদ্ভাবন প্রকৃতিতে অভিযোজন প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তোলার পক্ষে উপাদান জোগায়।
লেখক: পরমাণুবিজ্ঞানী, খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়