দুর্লভ বড়চাদরগাছ

অ্যাপোসাইনেসি পরিবারের Rauvolfia গণে প্রায় এক হাজার প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রজাতি হলো Rauvolfia tetraphylla, যা এ দেশে বড়চাদরগাছ নামে পরিচিত। ছোটচাদর নামে এ দেশে আরেকটা গাছ আছে। সেটি সর্পগন্ধা নামে পরিচিতি। বড়চাদরগাছ ছাতা সর্পগন্ধা নামেও পরিচিত। এ গাছের আরও কিছু নাম পেয়েছি, গন্ধনকুলী ও বড়চন্দ্রিকা। এর হিন্দি নামও বড়চন্দ্রিকা। ইংরেজি নাম ডেভিল–পেপার বা মিল্কবাশ। বড়চাদর ও ছোটচাদর একই পরিবারের Rauvolfia গণের দুটি প্রজাতির গাছ। এ গণের আরও একটি প্রজাতির গাছ এ দেশে আছে, তার নাম বম সর্পগন্ধা। বড়চাদর একটি ঔষধি গাছ। এ গাছের শিকড় অবশকারক, প্রস্রাব নিঃসারক ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। দক্ষিণ আমেরিকায় এ গাছের কষ, বাকল, শিকড় ও পাতা ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গুয়াতেমালায় এ গাছ সাপে কাটা ও ম্যালেরিয়া রোগের চিকিত্সায় ব্যবহার করা হয়।

বড়চাদরগাছটির জন্ম মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ধারণা করা হয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে গাছটির ভারতবর্ষে আগমন ঘটেছে। এ দেশে বড়চাদরগাছ খুব কমই চোখে পড়ে, ছোট চাদর বা সর্পগন্ধাগাছ বেশি দেখা যায়।

বড়চাদরগাছ ছোট গুল্ম প্রকৃতির, প্রচুর ডালপালা হয়ে ঝোপ সৃষ্টি করে। পাতা ডিম্বাকৃতি। অমসৃণ বাদামি ডালের প্রতিটি গিঁট থেকে তিনটি পাতা বের হয় বলেই এর প্রজাতি নামের শেষাংশ টেট্রাফাইলা। একই গিঁট থেকে গুচ্ছাকারে বের হওয়া দুটি পাতা বড়, একটি ছোট। ফুল ক্ষুদ্র, গন্ধহীন, দেখতে কিছুটা নাকফুলের মতো। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাসে ফুল ও ফল হয়। ফল মটরদানার মতো গোলাকার, কাঁচা ফলের রং লালাভ সবুজ, পাকলে লাল ও শেষে কালো হয়ে যায়। ফল বিষাক্ত। তাই এ গাছের ফল কোনো পাখি ও প্রাণী খায় না। তবে কালো পাকা ফল থেকে প্রাকৃতিক কালো রং তৈরি হয়। যে যুগে লেখার কালি আবিষ্কৃত হয়নি, সে যুগে এ ফলের রস লেখার কালি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বীজ থেকে চারা হয়। এক বছর বয়স হলেই গাছে ফুল-ফল ধরা শুরু হয়। বড়চাদরগাছের মূল বা শিকড় প্রধান ব্যবহার্য ওষুধ। কিন্তু দুটি গাছের শিকড় অভিজ্ঞতা না থাকলে চেনা দুষ্কর। বড়চাদরগাছের শিকড় খুব শক্ত, সহজে ভাঙা যায় না, স্বাদে তিতা ও শিকড় ভাঙলে তা থেকে তেঁতুলের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ছোটচাদরগাছের শিকড় অতটা শক্ত নয়, সহজে ভাঙা যায়, স্বাদে তিতা হলেও তা থেকে তেঁতুলের গন্ধ পাওয়া যায় না।

গ্রামে বড়চাদর নিয়ে খনার একটা বচন প্রচলিত আছে, ‘ছোট চান্দা বড় চান্দা/ কী হবে তোর দড়ি বান্ধা’। ছোট চান্দা মানে ছোটচাদরগাছ আর বড় চান্দা মানে বড়চাদরগাছ। তিনি এ বচনের মাধ্যমে এ দুটি গাছ দিয়ে সাপে কাটা রোগীর চিকিত্সার ইঙ্গিত করেছেন। তার মানে, সেই প্রাচীনকালেও খনা জানতেন, এ দুটি গাছ থাকলে সাপে কাটা রোগীকে আর দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে না। এ যুগে এসেও গবেষণায় সেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। সে কারণেই হয়তো বড়চাদরগাছের আয়ুর্বেদিক নাম রাখা হয়েছে গন্ধনকুলী। নকুল মানে বেজি। বেজি হলো সাপের শত্রু বা যম। সাপকে মারতে পারে বেজি। তাই এই গাছ সাপের বিষকে নাশ করে বলেই হয়তো নামের এই সাযুজ্য। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর চিরঞ্জীব বনৌষধি বইয়ে লিখেছেন, ‘নকুলী (ছোটচাদর) ও গন্ধনকুলী (বড়চাদর) স্বাদে তিক্ত এবং বায়ু, পিত্ত, কফনাশক; সর্বপ্রকার বিষহরণকারী; তবে দ্বিতীয় অর্থাৎ গন্ধনকুলী কিঞ্চিৎ শ্রেষ্ঠ।’ এটি সাপ, মাকড়সা, বিছে, ইঁদুর প্রভৃতির বিষ নষ্ট করে। জ্বর, কৃমি, ব্রণ ইত্যাদিও নষ্ট করে। বড়চাদরগাছের ফল বিষাক্ত, আঠা যন্ত্রণা উদ্রেককারী, পাতার রস দাঁতব্যথা ও চোখের সমস্যায় ব্যবহার্য, শিকড় পেটে ব্যথা ও সাপে কাটা রোগীর চিকিত্সায় ব্যবহার করা হয়। চর্মরোগ সারাতে গাছের রস ক্যাস্টর অয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে মাখা হয়। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও মালয়েশিয়ায় সাপে কামড়ানোর চিকিত্সা করা হতো বড়চাদর বা গন্ধনকুলীগাছ দিয়ে। সাপে কামড়ালে এ গাছের মূল ক্বাথ করে খাওয়ানো হয় এবং বেটে সাপে কামড়ানো জায়গায় প্রলেপ দেওয়া হয়। এতে বিষদোষ কেটে যায়।

এ গণের অধিকাংশ গাছে ‘রেসারপাইন’ নামক রাসায়নিক উপাদান বা ফাইটোকেমিক্যাল থাকায় এসব গাছ অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ড্রাগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চিকিত্সাশাস্ত্রের দৃষ্টিতে বড়চাদরগাছ হৃদরোগে বা কার্ডিওভাসকুলার রোগ, হাইপারটেনশন ও সাইকিয়াট্রিক রোগের চিকিত্সায় কাজে লাগে। শিকড়ে বিশেষ ধরনের অ্যালকালয়েড থাকায় তা মূল্যবান। অন্ত্রের সমস্যা নিরাময়ে এ গাছের শিকড় ব্যবহার করা হয়। গবেষকেরা গবেষণা করে এ গাছের শিকড়ে প্রায় ৩০ রকমের অ্যালকালয়েডের উপস্থিতি পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রেসারপাইন, অ্যাজমালিসিন, অ্যাজমালাইন, রেসারপাইটিন, সার্পাজাইন, ডেসারপিডিন, রেসারপাইলিন, সার্পিনাইন, থামবিন ইত্যাদি। মোট অ্যালকালয়েডের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ হলো রেসারপাইন। একেক ধরনের অ্যালকালয়েড একেক রোগ সারানো বা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। যেমন রেসারপাইন রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে, অ্যাজমালাইন শ্বাসপ্রশ্বাস চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই গাছের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান অন্ত্রে থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে Escherichia coli, Enterobacter aerogenes, Alcaligenes faecalis ইত্যাদির বিরুদ্ধে কার্যকর। এ গাছের পাতার রস কিছু ছত্রাক জীবাণু যেমন Aspergillus niger ও Penicillium spp ধ্বংস করতে পারে।

লেখক: উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা