বিজ্ঞানচিন্তা: এ তো গেল মানুষের কথা। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে জিনোম সিকোয়েন্সিং কীভাবে কাজে লাগানো যায়?

জেবা ইসলাম সেরাজ: একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ভুট্টাগাছ সি৪ উদ্ভিদ, কিন্তু ধান সি৩ উদ্ভিদ। কম কার্বন ডাই–অক্সাইড থাকলেও ভুট্টা খুব ভালোভাবে সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে, যা ধানগাছ পারে না। আবার অধিক তাপমাত্রায়ও ভুট্টা জন্মাতে পারে। বেশি গরমে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন সি৩ উদ্ভিদকে সি৪ উদ্ভিদে পরিণত করা যায় কি না। এটা দেখতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, বিবর্তিত হয়ে ৬৩ বারের মতো এই পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। এখন তাঁরা খুঁজে বের করছেন, কোন কোন জিনের পরিবর্তন করলে সি৩-কে সি৪ উদ্ভিদে পরিণত করা যায়, যাতে আমাদের সি৩ খাদ্যশস্য আবহাওয়ার সঙ্গে আরও ভালোভাবে খাপ খেয়ে অধিক ফলন দেয়। এ ছাড়া ধানের বুনো জাত কাশালাথের কথা বলা যেতে পারে। এই জাতটি খরাসহিষ্ণু এবং মাটিতে কম ফসফরাস থাকলেও ঠিকঠাক ফলন দেয়। বুনো জাতের এই গুণগুলোর জন্য কোন জিন দায়ী, তা জানার জন্য নির্দিষ্ট ক্রোমোসোম ম্যাপ করে আমাদের বাণিজ্যিক জাতগুলোর জিনোম ডেটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হলো। কিন্তু কোনো জিন খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষে কাশালাথের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং করে সম্পূর্ণ নতুন জিন পিএসটিওএল-২ চিহ্নিত করা হলো। এখন নতুন এ জিনটি বাণিজ্যিক জাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে ধানের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

বিজ্ঞানচিন্তা: পাটের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। এর মধ্যে এই সিকোয়েন্সিং আমাদের কী কাজে লাগছে?

জেবা ইসলাম সেরাজ: ‘পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্প’ এ নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছে। সফলতাও এসেছে বেশ। গবেষণায় ইএমএস মিউটেশন করে আঁশ ভালো হয় এমন পাটের জাত (রবি-১) পেয়েছেন। ‘ফাইবার বায়োসিনথেটিক জিন’ চিহ্নিত করে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে জিনের প্রকাশ ঘটিয়ে ভিন্নতাও পেয়েছেন তাঁরা। আবার আঁশের গুণগত মানের সঙ্গে ১৫-২০ শতাংশ বেশি ফলন দেবে, এমন জাতের জিনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য থাকার কারণে। আবার মিউটেশন করে সব সময় ফুল ফুটবে এমন পাটগাছও পাওয়া গেছে, তবে ফলন অত ভালো পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি গবেষণাগার পাটের লিগনিন কমাতে সক্ষম হয়েছে। মাঠে সফল পরীক্ষার পর কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া যাবে এই পাটের বিশেষ জাতগুলো।

বিজ্ঞানচিন্তা: জিনোম সিকোয়েন্সিং–ভিত্তিক এত সূক্ষ্ম ও জটিল গবেষণা করা বাংলাদেশের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জিং?

জেবা ইসলাম সেরাজ: আসলে জিনোম সিকোয়েন্সিং কোনো একক গবেষণা নয়। বরং অনেক কাজের সমন্বয়। আমরা দেশের ল্যাবরেটরিতে স্যাম্পল তৈরি করি। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা অর্থের বিনিময়ে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সিকোয়েন্সিং করে দেয়। এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে নেই। যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশ থেকে এটা আমরা করিয়ে আনি। এ পর্যন্ত কাজটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। চ্যালেঞ্জটা শুরু হয় এরপরের ধাপ থেকেই। কারণ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের হাতে তুলে দেয় ‘র’ ডেটা বা অপরিণত ডেটা। এই ডেটাকে সমন্বয় করাই গবেষণার মূল চ্যালেঞ্জ। এর জন্য দরকার বায়োইনফরমেটিকসে দক্ষ গবেষক। বিভিন্ন প্রোগ্রামিং টুল ব্যবহার করে সিকোয়েন্সিংয়ের বিভিন্ন অংশ সমন্বয় ও বিশ্লেষণ করার জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে বিশেষ দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। শুধু জীববিজ্ঞানের জ্ঞান এখন আর পর্যাপ্ত নয়। বরং থাকতে হবে প্রোগ্রামিং নলেজ। সে ক্ষেত্রে কম্পিউটারবিজ্ঞানী আর জীববিজ্ঞানীদের একত্রে কাজ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

বিজ্ঞানচিন্তা: তথ্য বিশ্লেষণের পর এই বিপুল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ করার উপায় কী?

জেবা ইসলাম সেরাজ: দেশের নিজস্ব জিনোম তথ্যভাণ্ডার থাকা খুব জরুরি। যেমন আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ এসএনপি (সিঙ্গেল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম) পাওয়া গেল। ডেটাবেসে সংরক্ষিত থাকলে তা নিয়ে ভবিষ্যতে যে কেউ গবেষণা করতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের এমন কোনো তথ্যভান্ডার তৈরি হয়নি। অবশ্য এত বিশাল ডেটা রাখতে দরকার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সুপার কম্পিউটার, যা এখনো আমাদের দেশে নেই।

বিজ্ঞানচিন্তা: জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়ে যাওয়ার পর পেটেন্টের একটা ব্যাপার চলেই আসে। এটা নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

জেবা ইসলাম সেরাজ: পেটেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আমার নিজের দেশের কাজ, তার একটা লিখিত প্রমাণ এই পেটেন্ট। ভবিষ্যতে পেটেন্ট করা কোনো সিকোয়েন্সিং নিয়ে কেউ কাজ করতে চাইলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।

বিজ্ঞানচিন্তা: জিনোম সিকোয়েন্সিং ছেড়ে এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার বর্তমান গবেষণা নিয়ে কিছু বলুন।

জেবা ইসলাম সেরাজ: ধান নিয়েই আমার গবেষণা। আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবেই লবণাক্ত মাটিতে কিছু বুনো ধানের জাতকে বেড়ে উঠতে দেখা যায়, যদিও এরা অধিক ফলন দিতে পারে না। এমনই একটি লবণসহিষ্ণু ধানের জাত হলো হরকুচ। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলে এটি জন্মে এবং কৃষকের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। হরকুচ নিয়েই আমার বর্তমান গবেষণা। বিরি ও ইরির সাহায্য নিয়ে আমরা হরকুচের রেসিপ্রোকাল পপুলেশন তৈরি করেছি। এরপর জিনগুচ্ছের মানচিত্র (কিউটিএল ম্যাপিং) করেছি। তার আগে অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় এসএনপি (সিঙ্গেল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম) বের করেছি। কোথায় কোন জিন আছে, তা খোঁজার চেষ্টা করেছি। চারা ও প্রজনন উভয় পর্যায়েই লবণসহ আর লবণ ছাড়া বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছি। পরে জিনগুলো দুই দলে ভাগ করেছি—একদল জিন লবণসহিষ্ণু, আরেক দল জিন লবণ সংবেদনশীল। আবিষ্কৃত জিনগুলো নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ এখন প্রকাশের অপেক্ষায়। আর এখন আমরা আরেকটু বিস্তারিত কাজ করছি। কোন জিনগুলো কতটুকু প্রকাশ পেলে কতখানি সহিষ্ণুতা দেখাবে, তা বের করার চেষ্টা করছি। হরকুচে ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিহ্নিত জিনগুলো আলাদাভাবে নকআউট করে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি, আসলেই এরা লবণসহিষ্ণুতার জন্য দায়ী কি না।

বিজ্ঞানচিন্তা: জীবপ্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা খাতে কেমন খরচ হয়? আর অর্থায়নের উৎস কী?

জেবা ইসলাম সেরাজ: আমার কাজই কিন্তু গবেষণার জন্য অর্থায়নের উৎস খোঁজা। আমার অতিসম্প্রতি শেষ হওয়া ‘লবণ-সহনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবনে উড়ি ধানের সম্ভাবনা উন্মোচন; জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট। জুলাই ২০১৬ থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে আনুমানিক ১ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। অবশ্য পরে এক বছর সময় বর্ধিত করে নিয়েছিলাম। আমার এ প্রকল্পের সঙ্গে বিরিও জড়িত ছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা: কিছুদিন আগেই আপনার তত্ত্বাবধানে হওয়া একটি গবেষণার প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্ট জার্নালে। এত হাই-ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরসম্পন্ন কোনো জার্নালে বাংলাদেশি গবেষণা খুব একটা দেখা যায় না।

জেবা ইসলাম সেরাজ: এ ধরনের বিশ্বমানের গবেষণার জন্য দেশের বাইরের উন্নত গবেষণাগারের সঙ্গে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন। এতে কাজের মান হয় অনেক উঁচু। ফলাফলও হয় নিখুঁত আর বিজ্ঞানমহলে গ্রহণযোগ্যতাও অনেক বেড়ে যায়।

বিজ্ঞানচিন্তা: বাংলাদেশি গবেষণায় বর্তমানে তরুণদের অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু বলুন।

জেবা ইসলাম সেরাজ: আমি সব সময়ই নিজ দেশে গবেষণা করাকে অণুপ্রাণিত করি। দেশের বাইরে গবেষণায় যুক্ত থাকলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য দেশের সমস্যাগুলোকে সমাধান করা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, শ্রম ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছে অন্য দেশ। শিক্ষার্থী আর গবেষকেরা যদি দেশেই তাঁদের গবেষণা করেন, তাহলে নিজ দেশের জটিল সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে সহজেই। দেশের উন্নতিতে অনেক অবদান রাখতে পারেন বাংলাদেশি গবেষকেরা। তবে এ কথা সত্যি যে গবেষণা খাতে জোরদার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে ভালো মানের গবেষণা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি মেধাবীদের দেশে ধরে রাখাও কঠিন।

বিজ্ঞানচিন্তা: অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার ভবিষ্যৎ গবেষণাকাজের জন্য বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে শুভকামনা রইল।

জেবা ইসলাম সেরাজ: বিজ্ঞানচিন্তাকেও ধন্যবাদ।