প্রত্নতত্ত্বে জিন প্রকৌশল

প্রত্নতত্ত্বের উদ্দেশ্য হলো অতীতের সমাজ এবং মানবজাতির বিকাশ সম্পর্কে বিস্তৃত জানা। মানবতার বিকাশের ৯৯ শতাংশের বেশি প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতিতে ঘটেছিল। সে সময় লেখার প্রচলন ছিল না, যার সে সময়ের ইতিহাসের কোনো লিখিত রেকর্ডও বিদ্যমান নেই। লিখিত উৎস ছাড়াই প্রাগৈতিহাসিক সমাজগুলো বোঝার একমাত্র উপায় হলো প্রত্নতত্ত্ব। প্রত্নতত্ত্ব হলো অতীতের মানবিক ক্রিয়াকলাপের অধ্যয়ন, এটি আমাদের প্রায় আড়াই মিলিয়ন বছর আগের ওল্ডোয়ান ইন্ডাস্ট্রি, যখন আমরা প্রথম পাথরের সরঞ্জামগুলো পেয়েছি, সেই সম্পর্কে ধারণা দেয়। প্রত্নতত্ত্ব মানবতার অনেক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বিষয়ে আলোকপাত করেছে, যেমন আগুন ব্যবহারের ক্ষমতা, পাথরের সরঞ্জামের বিকাশ, ধাতববিদ্যার আবিষ্কার, ধর্মের সূচনা এবং কৃষির উৎপত্তি। সহজ কথায়, প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা হচ্ছে এমন জিনিস, যা অতীত মানুষের এবং যা মাটি থেকে খনন করে পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে সংরক্ষিত বস্তুর জিন পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিকে প্যালেওজেনেটিকস বলা হয়। প্রথম ১৯৮৪ সালে অ্যালান উইলসনের নেতৃত্বে একটি দল বিলুপ্ত প্রাণী ‘কোয়াগার’ জাদুঘর নমুনা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি প্রাচীন ডিএনএর অনুক্রম বা সিকোয়েন্স প্রকাশ করেছিলেন।

প্যালিওজেনেটিকস প্রাগৈতিহাসিক যুগের দুর্দান্ত রহস্য সমাধানে সহায়তা করে। মানুষ পৃথিবীতে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, সে সম্পর্কে ধারণা দেয়। প্রাচীন ডিএনএর সঙ্গে কাজ করা জটিল। সাধারণত এটি অবনমিত হয়, রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয় এবং কয়েক মিলিয়ন ছোট ছোট টুকরো হয়। তবে সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির সাম্প্রতিক অগ্রগতির ফলে কয়েক হাজার বছর আগের নমুনাগুলো থেকে পুরো জিনোমগুলোকে সিকোয়েন্স করা সম্ভব করেছে। শরীরের অঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়, পুরো জিনোমের সিকোয়েন্স তার থেকে আরও অনেক বেশি তথ্য ধারণ করে এবং জিনতত্ত্ববিদদের ব্যক্তি ও জনসংখ্যার মধ্যে বিশদ তুলনা করার সুযোগ করে দেয়। এই তুলনাগুলো থেকে এখন মানুষের বংশধারার নতুন শাখার উন্মোচন হচ্ছে।

মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’। এখন ‘হোমো’ বংশের একটি বিলুপ্ত প্রজাতি বা প্রত্নতাত্ত্বিক মানুষের উপপ্রজাতি হচ্ছে ‘নিয়ান্ডারথালস’, যারা প্রায় ৪ লাখ বছর আগে থেকে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে ইউরেশিয়ার মধ্যে বাস করতেন। ১৮২৯ সালে অ্যাঙ্গিস গুহাগুলোতে প্রথম নিয়ান্ডারথাল জীবাশ্ম আবিষ্কার করা হয়েছিল। নিয়ান্ডারথাল প্রাচীন ডিএনএ নিয়ে জেনেটিক গবেষণা সম্ভব হয়েছিল ১৯৯০–এর দশকের শেষের দিকে। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নিয়ান্ডারথাল জিনোম প্রকল্পটি ২০১৩ সালে প্রথম নিয়ান্ডারথাল জিনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স উপস্থাপন করেছে।

২০১০ সালে নিয়ান্ডারথাল জিনোমের প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে দেখা গিয়েছিল যে ইউরোপ এবং এশিয়ার আধুনিক মানুষের ডিএনএর গড় প্রায় ২ শতাংশ নিয়ান্ডারথালদের মতো, অর্থাৎ এই দুটি প্রজাতি অবশ্যই অতীতে কোনো একসময় মিলিত হয়েছে, সম্ভবত যখন মানুষ আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা করেছিল, তখন তাদের এই মিলন ঘটেছিল। ২০১০ সালে, একটি আঙুলের হাড় থেকে ডিএনএ নিয়ে বিশ্লেষণ করে পুরো নতুন ধরনের প্রাথমিক মানব পাওয়া গেছে, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডেনিসোভানস’। এদের সঙ্গে এশীয় এবং অস্ট্রেলিয়ানদের বংশধরদের মিল পাওয়া যায়।

২০১১ থেকে ২০১৫ সালের গবেষণায় উঠে এসেছে যে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে আমাদের ডিএনএর কোনো মিল নেই। সুতরাং এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে সময়ের ব্যবধানে অনেক বেশি পরিবর্তন ঘটেছে জিনোম সিকোয়েন্সে। এর পেছনে কারণ হতে পারে আধুনিক মানুষের নিজেদের মধ্যে অনেক বেশি মিলন। তবে প্রাচীন ডিএনএর ব্যবহার করে যে আমরা শুধু আমাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানি, তা নয়। এটি আমাদের আফ্রিকা থেকে বিচ্ছুরিত পরিবেশ এবং কৃষির উৎস ও প্রসার এবং আমেরিকার তুষারপাত সম্পর্কেও ধারণা দেয়। এটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রাগৈতিহাসের অন্যতম দুর্দান্ত রহস্য—ইন্দো-ইউরোপীয়দের উৎস জানতে সহায়তা করেছে।

লেখক: গবেষণা সহকারী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ইওন ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া