প্লাস্টিকের নিষ্ঠুর ভালোবাসা

প্লাস্টিক বর্জ্যছবি: রয়টার্স

টেকনাফ থেকে জাহাজে চড়ে সেন্ট মার্টিন গিয়েছেন কখনো? কিংবা নিদেনপক্ষে সদরঘাট থেকে চাঁদপুর? টেকনাফ থেকে জাহাজে চড়ার কিছুক্ষণ পরই দেখবেন জাহাজের পেছন পেছন গাংচিলের দল উড়ে আসছে। কেউ কেউ ওদের দিকে চিপস বা বিস্কুট ছুড়ে দিচ্ছে। একটু পর দেখবেন, খালি হওয়া চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। একই ব্যাপার দেখা যাবে চাঁদপুর যাওয়ার পথেও। গাংচিল হয়তো আশপাশে পাবেন না, কিন্তু চিপস, বিস্কুট বা প্লাস্টিকের বোতল ফেলে দেওয়ার দৃশ্য বদলাবে না এতটুকু।

আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন আসবে, বিশাল এ জলরাশির মধ্যে ওই সামান্য চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট কীই-বা ক্ষতি করবে! আসুন, আমরা একটু সহজভাবে বুঝতে চেষ্টা করি। প্রতিদিন ২০টি লঞ্চে কমপক্ষে ২ হাজার মানুষ সদরঘাট-চাঁদপুর-সদরঘাট আসা-যাওয়া করে। পুরো দক্ষিণবঙ্গে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ হাজার মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করে। এখন যদি এদের মধ্যে ২০ শতাংশ মানুষও (২০০০ জন) আসা-যাওয়ার পথে একটি করে পানির বোতল বা চিপসের প্যাকেট বুড়িগঙ্গায় ফেলে, তাহলে ৫০ বছর পর কী পরিমাণ প্লাস্টিকের পানির বোতল বা চিপসের প্যাকেট বুড়িগঙ্গায় থাকবে?

উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের মিডওয়ে প্রবালদ্বীপ থেকে তোলা একটি মৃত অ্যালবাট্রোসের পাকস্থলীর ভেতরের অবস্থা। সবচেয়ে কাছের মহাদেশ থেকে দ্বীপটি প্রায় ২ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। ধারেকাছে কোনো কলকারখানা আছে, এমনও নয়। সমুদ্রের এই পাখিগুলো প্রশান্ত মহাসাগর থেকে যখন খাবার সংগ্রহ করে, তখন সাগরে ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন প্লাস্টিকও এরা না বুঝে খেয়ে ফেলে এবং নিজেদের ছানাদেরও খাওয়ায়। সমুদ্রে প্লাস্টিক-দূষণ যে কত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, এ ছবিটি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
ছবি: ক্রিস জর্ডান

২০০০×৩০×১২×৫০ = ৩,৬০,০০,০০০ অর্থাত্ ৩ কোটি ৬০ লাখ প্যাকেট। এ তো গেল কেবল নদীর হিসাব। পুরো বাংলাদেশের দিকে নজর দেওয়া যাক। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ১ কোটি মানুষ যদি প্রতিদিন প্লাস্টিকসামগ্রী বাইরে নিক্ষেপ করে, তাহলে আগামী ৫০ বছরে কত মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হবে? আগের মতো করে গুণ করলে দেখা যাবে, ১৮ হাজার কোটি প্যাকেট প্লাস্টিক বর্জ্য।

আরও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, আপনার ব্যবহূত প্লাস্টিকের বোতল বা সামগ্রী যেখানেই ফেলছেন না কেন, প্লাস্টিকের এসব সামগ্রী শেষ পর্যন্ত নদী-নালা বা সমুদ্রে গিয়েই পড়ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লাখ টনেরও বেশি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহূত হয়। এর মধ্যে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয় মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ অপচনশীল প্লাস্টিক হয় নদী-নালা দিয়ে আমাদের বঙ্গোপসাগরে পড়ছে অথবা মাটির নিচে চাপা পড়ছে বা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এসব ফেলে দেওয়া বর্জ্যের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের পরিবেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কীভাবে প্লাস্টিক আমাদের ক্ষতি করছে?

প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের জীবনকে যে সহজ করেছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। বহুমুখী ব্যবহার, স্বল্প খরচ ও ব্যবহারের সুবিধার কারণে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কিন্তু কখনো প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকটি বিবেচনা করে দেখেছেন কি? আমরা যেসব প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলছি, সেসবের কারণে বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী। আর যেসব প্লাস্টিক আমরা মাটিতে ফেলে দিই, সেগুলো কিন্তু মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। এসবের মধ্যে ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। এটি ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠের পানির সঙ্গে মিশে যায়। যেহেতু ভূগর্ভস্থ পানি আমরা প্রতিনিয়ত পান করছি, তাই আমাদের শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার, মাটিতে থাকা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া যেমন সুডোমনাস (চংবঁফড়সড়হধং), নাইলন-ইটিং ব্যাকটেরিয়া বা ফ্ল্যাভোব্যাকটেরিয়া (ঋষধাড়নধপঃবত্রধ) প্লাস্টিক অণুর ভাঙনে সাহায্য করে। এসব ব্যাকটেরিয়া নাইলোনেজ এনজাইম ক্ষরণের মাধ্যমে নাইলন অণুকে ভেঙে ফেলে। তখন প্লাস্টিকের ভাঙনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাস উত্পন্ন হয়, তা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে এক শতাব্দীকাল সময়ব্যাপী ৩০ গুণ বেশি তাপ ধরে রাখতে পারে। তার মানে, গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও মিথেনের বেশি।

সমুদ্র বা নদীতে প্লাস্টিক কী ক্ষতি করে

নদী-নালা বা এর আশপাশে আমরা যেসব প্লাস্টিক আবর্জনা ফেলে রাখি, তাদের শেষ গন্তব্য সমুদ্র। প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সাগরে গিয়ে পড়ে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের কারণে সামুদ্রিক পরিবেশ গুরুতরভাবে বিপন্ন হচ্ছে। এমনকি মহাসাগরে বিচরণকারী কোনো কোনো পাখি এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর পাকস্থলী পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর ৮০ শতাংশ জায়গা প্লাস্টিক বর্জ্যে ভর্তি হয়ে আছে। প্লাস্টিক সাধারণত হজম হয় না, যার ফলে আস্তে আস্তে পাখি বা প্রাণীগুলো না খেতে পেরে করুণভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। শুধু প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী ও কচ্ছপ মারা যাচ্ছে। খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে যাচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে।

প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগসহ বিভিন্ন সামগ্রীর ২০ থেকে ১ হাজার বছর সময় লাগে ভেঙে টুকরো হতে। সাধারণত প্লাস্টিকসামগ্রী ভেঙে টুকরো হয়ে প্রথমে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। পানি ও অন্য খাদ্যের সঙ্গে একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের দেহে প্রবেশ করে। এমনকি একসময় মাছের সঙ্গে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে চরম স্বাস্থ্যবিপর্যয় ঘটাতে পারে।

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্যাকেজিং-সামগ্রী থেকে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যাল, খেলনা, গাড়ির পার্টস, কসমেটিকস, ডিটারজেন্ট, পেইন্ট, ইলেকট্রিকসামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করি। এসব প্লাস্টিকসহ অন্য সামগ্রীতেও যত্রতত্রভাবে থ্যালেট (চযঃযধষধঃব) নামে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এগুলো প্লাস্টিকসামগ্রী থেকে খাদ্যে বা পানিতে মিশে যায়। অনেক সময় এই থ্যালেট সিনথেটিক ইস্ট্রোজেন হিসেবে কাজ করে। ইস্ট্রোজেন মেয়েলি গঠন ও স্বভাবের জন্য দায়ী। সিনথেটিক ইস্ট্রোজেন পুরুষ মাছ বা প্রাণীকে স্ত্রী মাছ বা প্রাণীতে রূপান্তরিত করতে পারে। এর ফলে কোনো প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী মাছের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে ওই প্রজাতির মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতে পারে। এ ছাড়া প্লাস্টিকসামগ্রীতে বিসফেনল-এ (ইরং-ঢ়যবহড়ষ-অ) নামক অত্যন্ত ক্ষতিকর প্লাস্টিসাইজারও থাকে। এটি ক্যানসারের কারণ হতে পারে এবং প্রজননের ক্ষমতাও নষ্ট করে দিতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা গেছে।

প্লাস্টিকের ভয়াল বিশ্ব

সাধারণত অপরিশোধিত তেল থেকে প্লাস্টিক তৈরি হয়। ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অপরিশোধিত তেল দিয়ে ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক তৈরি হয়েছে। এই পরিমাণ এত বিশাল যে এটি দিয়ে পুরো আর্জেন্টিনাকে ঢেকে ফেলা যাবে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল বা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। এবং ৭৯ শতাংশ বর্জ্য বিভিন্ন ভাগাড়ে পতিত হচ্ছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন টনে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক দুর্যোগের ধাক্কা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব তো?

প্লাস্টিক-দূষণ রোধে আমাদের ভূমিকা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে এই দূষণ কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব। আপনি যখন বাজারে ফলমূল কিংবা সবজি কিনতে যাচ্ছেন, তখন পলিথিন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এর পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাগজের বা পাটের ব্যাগ করা যেতে পারে। রেস্তোরাঁ থেকে খাবার বাসায় নিয়ে আসার সময় প্লাস্টিকের প্যাকেট বর্জন করা উচিত। শুধু রেস্তোরাঁর খাবার নয়, যেকোনো পণ্যের প্যাকেজিংয়ে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হলে সেটা ব্যবহার করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। প্লাস্টিকের বোতলে পানি, কোমল পানীয় কিংবা জুস ব্যবহারের একটি বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্লাস্টিকের তৈরি ওয়ানটাইম গ্লাস, প্লেট, চামচের পরিবর্তে কাগজের তৈরি ওয়ানটাইম গ্লাস বা বারবার ব্যহারের জন্য ব্যক্তিগত গ্লাস, প্লেট ব্যবহার করা গেলে প্লাস্টিক বর্জ্যের সমুদ্র থেকে আমরা একটু হলেও রেহাই পাব।

প্লাস্টিকের পণ্য রিসাইকেল কিংবা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত, প্লাস্টিক-দূষণ রোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আমরা যত বেশি রিসাইকেল করতে শিখব, দূষণের হার তত কমতে থাকবে। যেসব প্লাস্টিক দুই বা ততোধিকবার রিসাইকেল করা যায়, সেসব প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে রিসাইকেলের হার খুবই কম। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বায়োপ্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি দূষণ হ্রাসের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগের সুবিধা হলো এই যে, তা সাধারণ প্লাস্টিক ব্যাগের মতো সরানো বা পোড়ানোর কোনো দরকার পড়ে না। কাজেই বায়োপ্লাস্টিকের রিসাইক্লিংয়ের জন্য আলাদা করে কোনো পদ্ধতির প্রয়োজন নেই। বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগ কিছুকাল পর নিজে থেকেই পচে যায়। কাজেই তা আলাদা করে অপসারণ করতে হয় না।

দূষণ রোধে আজই আপনার, আমার, আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নিজেদের অভ্যাস পরিবর্তন করার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে সচেতন হতে হবে। না হলে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আমাদের রেখে যেতে হবে এক ভয়ংকর জঞ্জালের পৃথিবী। এটা আমরা কখনোই চাই না। সরাতে হবে জঞ্জাল। এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে হবে আমাদের। সুকান্তের ভাষায়,

চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক: শিক্ষার্থী, পুরকৌশল বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা