ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। ঋতুচক্রের পালাবদলে ছয়টি ঋতু—গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ভিন্নতা দিয়েছে, যা বিশ্বে বিরল। বছরের বেশির ভাগ সময়ই যেমন প্রচণ্ড গরম থাকে এ দেশে, তেমনি বেশ কয়েক মাস প্রবল বৃষ্টিপাতও হয়। বর্ষা মৌসুমে কেন বৃষ্টিপাতের হার থাকে সবচেয়ে বেশি।
আমাদের দেশে ঋতুভেদে বায়ুপ্রবাহ পরিবর্তিত হয়। শীতকালে বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয় এবং বর্ষাকালে প্রবাহিত হয় দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে। সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সূর্য দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকে এবং নভেম্বর থেকে হিমালয়ের শুষ্ক ও ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণের দিকে প্রবাহিত হয়, যাকে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুও বলা হয়ে থাকে। তেমনি বর্ষা ঋতুতে, অর্থাৎ মে মাসের শেষ দিকে মৌসুমি বায়ু দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তরের দিকে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প নিয়ে হিমালয় পর্বতমালার দিকে প্রবাহিত হয়। এই দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুপ্রবাহের কারণে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এ দেশে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ৭০-৮০ শতাংশ বৃষ্টিপাত বর্ষাকালেই হয়।
ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়া বা জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশে নিয়মিত বন্যা হয়। এ দেশের ওপর দিয়ে ৪০৫টি নদী বয়ে গেছে এবং প্রধান প্রধান নদীর উত্পত্তিস্থল দেশের বাইরে। যখন একটি নদী একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন তাকে Transboundary river বলে। বাংলাদেশের নদীর অববাহিকাগুলো হলো গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা। এগুলো বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল ও চীনে বিস্তৃত।
অববাহিকার ৯৩ শতাংশ এলাকার অবস্থান বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি এলাকা, মধুপুর গড়, লালমাই পাহাড় ও বরেন্দ্র ভূমি ছাড়া অধিকাংশ জায়গায়ই প্লাবন ভূমি এবং অর্ধেকের বেশি অংশের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আট মিটার উচ্চতায়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি বাড়তে শুরু করে, পরে এই পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে নিচু এলাকাগুলো, যেমন হাওর, বিল, ঝিলগুলো বৃষ্টির পানি দ্বারা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং, বর্ষা ঋতুতে স্বাভাবিকভাবেই বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়।
পানি যখন নদীর তীর বা বাঁধ উপচে প্লাবন ভূমিতে ঢুকে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, তখন সেই অবস্থাকে বন্যা বলে। পানি যে উচ্চতায় উঠলে উপদ্রুত এলাকার ফসলি জমি বা ঘরবাড়িসহ রাস্তাঘাট, বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ওই এলাকার জন্য সেই উচ্চতাকে বিপত্সীমা হিসেবে ধরা হয়।
বাংলাদেশে চার ধরনের বন্যা হয়। বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি ও নদীর পানি প্রবাহের মাত্রার ওপর নির্ভর করে বন্যার ধরন। এর একটি হলো মৌসুমি বন্যা। সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো ও তাদের শাখা বা উপনদীগুলোতে ধীরে ধীরে পানি বৃদ্ধি পায়। তখন নদীর তীর বা পার্শ্ববর্তী বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ফলে বন্যা দেখা যায় সেই অঞ্চলে। এ ছাড়া আছে আকস্মিক বন্যা। দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি নদীগুলোতে আকস্মিক বন্যা হয়। এই বন্যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পানি দ্রুত বৃদ্ধি এবং হ্রাস পায়। পাহাড়ি এলাকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হয়। ফলে এ ধরনের বন্যা ফসল ও মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি করে। অনেক সময় আকস্মিক বন্যায় মানুষের জীবনহানিও ঘটে থাকে। আর আছে বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা (Rainfed Flood)। তীব্র দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত ও পানিনিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনার কারণে এ ধরনের বন্যা হয়। ইদানীং শহর এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা বেশি হয়। এ ছাড়া আছে উপকূলীয় বন্যা। বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল ও মোহনায় জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় বন্যা হয়।
বাংলাদেশে বন্যার জন্য বড় ভূমিকা পালন করে দেশের তিনটি প্রধান নদী অববাহিকা। জুন মাস থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্রুত বাড়তে থাকে এবং জুলাইয়ের প্রথমার্ধে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। তখন এই অববাহিকার জেলা−কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জের নিম্ন এলাকায় বন্যা হয়। আবার জুলাইয়ের শেষে ও আগস্টের প্রথমার্ধেও ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি আরেকবার বাড়ে এবং পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করে বন্যা হয়। অন্যদিকে গঙ্গা অববাহিকায় জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং আগস্ট মাসে পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এপ্রিল-মে মাস থেকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মেঘনা অববাহিকা এলাকায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রাক-মৌসুমে বন্যার সৃষ্টি হয়। এই বন্যাকে আকস্মিক বন্যা, আবার আগাম বন্যাও বলা হয়ে থাকে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার নদী সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, কংশ, যদুকাটা ইত্যাদি একাধিক বার বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। মেঘনা অববাহিকার বন্যার কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে বন্যা হয়।
এই তিন অববাহিকার প্রধান নদীর পানি একই সঙ্গে বাড়তে শুরু করে যুগপত্ভাবে সর্বোচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী ও মারাত্মক আকার ধারণ করে, যেমনটি ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে দেশের প্রায় ৬১ শতাংশ এবং ১৯৯৮ সালে প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়।
২০১৭ সালের বন্যা
২০১৭ সালের প্রাক-মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল-মে) মেঘনা অববাহিকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মেঘালয় ও আসামে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় নদ-নদীর পানি খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করে।
জুনের শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারের পানি বাড়তে শুরু করে। জুলাইয়ের ৬ তারিখে এসব নদ-নদীতে পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করতে শুরু করে। ১৩ জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকে পানি বাড়া। ওই সময়ে যমুনা নদীর পর্যবেক্ষণাধীন সব কটি পয়েন্টে পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করে। ১৪ জুলাই থেকে যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করে। ১৯ জুলাই সব কটি পয়েন্টে বিপত্সীমার নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকেই উত্তরাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়। এই পরিস্থিতি তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে আবার বাড়তে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারের পানি। ১২ আগস্ট থেকে এই নদ-নদীগুলোর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করে। ১২ থেকে ১৪ আগস্ট যমুনা নদীর পানি ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার হারে বাড়ে। একই সময়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং বাংলাদেশের উজানের সীমান্তসংলগ্ন এলাকাগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। ফলে বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এতে ওই জেলাগুলো বন্যাকবলিত হয়। এ ছাড়া ২০১৭ সালে চলমান মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারার পানি একাধিক বার বিপত্সীমা অতিক্রম করে এবং এ অঞ্চলের প্রধানত নিম্নাঞ্চল ও বাঁধের বাইরের অংশ বন্যাকবলিত হয়।
বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হতে দেখা যায় ২০১৭ সালের বন্যা মৌসুমে, অর্থাৎ জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে বাংলাদেশে স্বাভাবিক হতে বেশি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়েছে। জুন মাসের প্রথম দিক হতেই ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর স্বাভাবিক নিয়মে জুন মাসে হওয়াকে নির্দেশ করে। মৌসুমি বায়ু তিনটি অববাহিকায় একই সময়ে সক্রিয় থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত সংঘটিত করলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রধান তিনটি নদী—ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনার বন্যার কারণে দেশের বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ২০১৭ সালের বন্যা যমুনা নদীর জামালপুর পয়েন্টে পূর্বের উচ্চতাকে অতিক্রম করলেও গঙ্গা এবং মেঘনার পানি বিপত্সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি ১৯৮৮ বা ১৯৯৮-এর মতো মারাত্মক আকার ধারণ করেনি।
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা বাংলাদেশকে প্রতিবছরই বিভিন্ন মাত্রায় মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব।
লেখক: নির্বাহী প্রকৌশলী, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত