মানুষ কেন বামন হয়?

তুষারকন্যা ও সাত বামনের গল্প ছোটবেলায় কে না পড়েছে? পাহাড়ে সাত বামন আদরে–যত্নে না রাখলে তুষারকন্যা কবেই মরে যেত! গল্পকাহিনি বা পুরাণে বামনদের একটা আলাদা মর্যাদা আছে। বেশির ভাগ পুরাণেই বামনদের উচ্চ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন, জ্ঞানী ও উচ্চ মানবিক গুণাবলির মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু কেন কিছু কিছু মানুষ এত খর্বাকৃতির হয় যে লোকে তাদের বামন বলে?

আমাদের শারীরিক বৃদ্ধির জন্য শৈশবে কিছু হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর সঙ্গে চাই সঠিক পুষ্টি ও বেড়ে ওঠার মতো পরিবেশ। কৈশোরে গ্রোথ হরমোন, থাইরয়েড হরমোন এবং সেক্স হরমোনগুলো বেশি বেশি করে নিঃসরণ হয় বলে এ সময়টাতেই আমরা দ্রুত বাড়তে শুরু করি। একে বলে পিউবারটাল স্পার্ট। আবার ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সে হাড়ের গ্রোথ প্লেটগুলোর বাড়ন্ত অংশ ফিউজ হয়ে যেতে থাকে, এরপর আমরা লম্বায় আর বাড়ি না। তার মানে ১৮ বছরের আগে পুষ্টি ও প্রয়োজনীয় হরমোনের অভাব হলে শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। হরমোনগুলো যেসব গ্রন্থি থেকে তৈরি হয়, যেমন পিটুইটারি গ্রন্থি বা থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যায় মানুষ বামন হতে পারে। হতে পারে জিনগত নানা সমস্যা, যেখানে জন্মগতভাবে জিনের ত্রুটির কারণে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

উন্নয়নশীল দেশে অপুষ্টি ও ভিটামিন ও আমিষের অভাবে শিশুরা খর্বাকৃতির হয়। অনেক সময় ছোটবেলায় দীর্ঘদিন রোগে ভোগার কারণেও মানুষ খর্বাকৃতি হয়। তবে খর্বাকৃতি মানেই যে বামন, তা কিন্তু নয়। দেশ–জাতিভেদে বিশ্বের একেক জায়গার মানুষের উচ্চতা একেক রকম। পাশ্চাত্য দেশের মানুষের গড় উচ্চতা এবং চীন ও থাইল্যান্ডের মতো প্রাচ্য দেশের মানুষের গড় উচ্চতা এক হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাহলে কাকে আমরা অস্বাভাবিক বলব। চিকিত্সকেরা এ ক্ষেত্রে গ্রোথ চার্টের মানদণ্ড ব্যবহার করেন। নির্দিষ্ট জাতিগত মানদণ্ডে কোনো শিশু যদি গ্রোথ চার্টে তার বয়স অনুযায়ী যে উচ্চতা হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে আড়াই গুণ মান নিচে পড়ে যায়, তবে তাকে অস্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। তারপর খুঁজে দেখা হয় যে সে কী কারণে উচ্চতা বৃদ্ধিতে পিছিয়ে পড়ছে। যদি হরমোনের ঘাটতির কারণে বা অপুষ্টির কারণে হয়ে থাকে, তবে সময়মতো চিকিত্সার আওতায় এলে সে স্বাভাবিক উচ্চতা লাভ করতে সক্ষম। কিন্তু কারণটা যদি হয় জিনগত বা জন্মগত, তবে সাধারণত কোনো সুফল পাওয়া যায় না চিকিত্সায়। কিছু কিছু বামনের কম উচ্চতার সঙ্গে স্কেলিটাল ডিসপ্ল্যাসিয়া বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অসামঞ্জস্য থাকে। যেমন শরীরের তুলনায় হাত-পা খাটো বা বেশি লম্বা। এগুলো সাধারণত জিনগত সমস্যা। আবার পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে গ্রোথ হরমোন কম নিঃসরণের কারণে খর্ব হয়ে থাকলে ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করে উচ্চতা নিশ্চিত করা যায়। যেমনটা ঘটেছে বিশ্বখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় লিওনেল মেসির বেলায়।

মেসির ১২ বছর বয়সে ধরা পড়ে যে তার গ্রোথ হরমোনের অভাব রয়েছে। সে কারণে ক্লাস বা ফুটবল দলের অন্য ছেলেদের তুলনায় তাকে সব সময়ই ছোটখাটো দেখাত। মেসির পরিবার ছিল দরিদ্র, তাই প্রতিদিন গ্রোথ হরমোন ইনজেকশন নেওয়ার ব্যয় সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ সময় এগিয়ে আসে বিশ্বখ্যাত ফুটবল দল বার্সেলোনা। মেসির মধ্যে অপার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল বার্সেলোনা। তাই তাঁর চিকিত্সার সব ব্যয়ভার তারা কাঁধে তুলে নিয়েছিল এক শর্তে, তা হলো বার্সার হয়েই খেলতে হবে মেসিকে। তাদের সিদ্ধান্ত যে মোটেও ভুল ছিল না, তা আজ প্রমাণিত। এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ছোট মানুষটির নাম জ্যোতি অ্যামগি। ভারতের কেরালার এই নারীর উচ্চতা মাত্র ২ ফুট ১ ইঞ্চি। জন্মগত জটিল রোগ অ্যাকন্ড্রপ্ল্যাসিয়ায় আক্রান্ত জ্যোতি। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তিনিই সবচেয়ে ক্ষুদ্র মানুষ।

খর্বাকৃতি বা বামনদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বখ্যাত অভিনেতা বা পারফরমার হয়েছেন। উইজার্ড অব ওজ, গেম অব থর্নস, লর্ড অব দ্য রিংস বা ক্রনিকলস অব নার্নিয়ায় আমরা বামনদের দেখা পাই। এমি বা গোল্ডেন গ্লোব এওয়ার্ডও পেয়েছেন কেউ কেউ। অনেকে বলেন, বিখ্যাত কবি আলেকজান্ডার পোপও নাকি এই সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমাজে বামনদের ঠাঁই হয় সার্কাসে বা সিনেমায় কমেডিয়ান চরিত্রে বা রেস্টুরেন্টের দারোয়ানের চাকরিতে। কিন্তু উন্নত ধরনের চিকিত্সা আবিষ্কৃত হওয়ায় যথাসময়ে রোগ শনাক্ত হলে তাঁদের অনেকেই লিওনেল মেসির মতো সফল মানুষে পরিণত হতে পারেন। আর গ্রোথ হরমোন চিকিত্সা এখন বাংলাদেশেও আকছারই হচ্ছে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা