একটা যন্ত্র ঠিকভাবে চলার জন্য দরকার শক্তিশালী ইঞ্জিন। আমাদের পুরো শরীরকে যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর এই যন্ত্রের ইঞ্জিন হলো হৃৎপিণ্ড। সংবহনতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ হৃৎপিণ্ড। ক্রমাগত সংকুচিত-প্রসারিত হয়ে এই অঙ্গ সারা শরীরে রক্ত প্রবাহিত করছে। হৃৎপিণ্ড স্বাধীনভাবে কাজ করে। কারণ, এটা মায়োজেনিক। মায়োজেনিক মানে হলো মস্তিষ্কের সংকেত বা সাহায্য ছাড়াই হৃৎপেশিগুলো নড়াচড়া করতে পারে। তবে এই নড়াচড়া আবার ইচ্ছেমতো হয় না। আমার ইচ্ছে হলো আর হৃৎপিণ্ড সংকুচিত হয়ে গেল—এমনটা হবে না। আবার দীর্ঘ সময় প্রসারিত বা সংকুচিত হয়েও থাকতে পারবে না। তাল–লয় মেনে ছন্দের গতিতে হবে সংকোচন আর প্রসারণ। এই ছন্দ ঠিক রাখতে সাহায্য করে সাইনো–অ্যাট্রিয়াল নোড। এটা একগুচ্ছ কোষ দিয়ে তৈরি, যারা হৃৎপিণ্ডের ডান অলিন্দের দেয়ালে থাকে। এই নোড থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত মাংসপেশিকে ছন্দের তালে তালে সংকুচিত আর প্রসারিত করে। হৃৎপিণ্ডের চারটি চেম্বারের ভেতর অক্সিজেনসমৃদ্ধ আর অক্সিজেনমুক্ত রক্ত আলাদাভাবে থাকে। চেম্বারের মাংসপেশি দৃঢ় আর শিথিল হয়ে রক্তকে প্রবলভাবে সারা শরীরে আর ফুসফুসে পৌঁছে দেয়।
শরীরে নদীর মতো রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়। বেঁচে থাকার জন্য রক্তের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। নিজের সঙ্গে অক্সিজেন বহন করে নিয়ে যায় প্রতিটি কোষে, আবার কার্বন ডাই–অক্সাইড পরিষ্কার করে নিয়ে আসে কোষ থেকে। খাদ্যনালিতে যে খাবার হজম হয়, তার পুষ্টি উপাদান রক্তের সঙ্গে মিশে যায় আর কোষকে পুষ্টি জোগায়। হরমোনকে তার উৎপাদনের জায়গা থেকে দূরদূরান্তে পৌঁছে দেয় এই রক্ত। যেমন ভেসোপ্রেসিন হরমোন মস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাসে তৈরি হয় আর পিটুইটারিতে জমা থাকে। কিন্তু কাজ করে কিডনিতে গিয়ে আর শরীরে তরলের মাত্রায় ভারসাম্য বজায় রাখে।
তরল রক্ত শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা ঠিক রাখে। তবে রক্ত কোনো সামান্য লাল রঙের তরল নয়। এই রক্তে রয়েছে নানা রকম কণা। কোনো কণার কাজ অক্সিজেন বা কার্বন ডাই–অক্সাইড বহন করা, কেউ আবার দেহরক্ষীর কাজ করে। রক্তে অনাকাঙ্ক্ষিত জীবাণু দেখলে তাদের মেরে ফেলে। কণাদের মধ্যে প্রধান হলো লোহিত রক্তকণিকা। রক্তের ৪৫ শতাংশই তাদের দখলে। এই লাল কণাদের সংখ্যা বেশি বলেই রক্তের রং লাল। আরও আছে শ্বেত রক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকা। পরিমাণে কম হলেও এদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেটের গুরুত্ব কিন্তু আমরা সহজেই বুঝতে পারি। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু হলে আমরা বলতে শুনি, রোগীর দেহে প্লাটিলেট কমে গেছে। প্লাটিলেট কমে যাওয়া রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে হুলুস্থুল লেগে যায়। সাধারণভাবে রক্তে এরা এতই কম পরিমাণ থাকে যে এর উপস্থিতিই টের পাওয়া যায় না। কিন্তু এর অনুপস্থিতিতে আমাদের মৃত্যুও হতে পারে।
কণা ছাড়া রক্তের বাকি অংশ তৈরি হয় তরল দিয়ে। এ তরলকে সাধারণ পানি বলা যাবে না। বলতে হবে প্লাজমা। কারণ, এটা পুরোপুরি পানি নয়। এতে ১০ ভাগের মতো গ্যাসীয় উপাদান, পুষ্টি উপাদান আর বর্জ্য পদার্থ থাকে।
প্রাণীদের শরীরে এই রক্ত কবে থেকে তৈরি হওয়া শুরু হলো, তা একটা রহস্য। ধারণা করা হয়, প্রথম বহুকোষী প্রাণীদের শরীরে এই রক্তের উদ্ভব হয়। প্রাণীটি ছিল খুবই সাধারণ আদি প্রকৃতির স্পঞ্জ। এদের রক্ত ঠিক মানুষের রক্তের মতো এত কাজের ছিল না। তাদের রক্তকণিকা খুব সামান্য কাজ করতে পারত। মনে করা হয়, আদিম স্পঞ্জদের ফ্যাগোসাইট ধরনের রক্তকণিকা ছিল। এই ফ্যাগোসাইট কোষগুলোর কাজ বাইরের জীবাণু ভক্ষণ করে মেরে ফেলা। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের আধুনিক মানুষের সংবহনতন্ত্রে আজও এই ফ্যাগোসাইটদের রাজত্ব আছে। সংখ্যায় এরা প্রায় ৩৩ বিলিয়ন!
রক্ত খুবই বৈচিত্র্যময়। একেক প্রাণীর রক্ত একেক রকম। আবার একই প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যেও রক্তের ভিন্নতা আছে। যেমন মানুষের মধ্যে প্রায় আট রকম রক্ত আছে। এক গ্রুপের রক্ত অন্য গ্রুপের রক্তের মানুষকে দেওয়া যায় না। কুকুরের মধ্যে রয়েছে আরও ভিন্নতা। প্রায় ১২ রকম ব্লাড গ্রুপ আছে তাদের।
নীল রক্ত
রক্ত কি শুধু লালই হয়? উত্তরটা হলো, না। রক্তের রং নীলও হতে পারে। আমাদের রক্ত লাল, কারণ, আমাদের রক্তে আয়রনযুক্ত প্রোটিন হিমোগ্লোবিন থাকে। কোনো প্রাণীর দেহে প্রোটিনের সঙ্গে আয়রনের বদলে অন্য কোনো মৌল থাকতে পারে। তখন আর রক্ত লাল রঙের হয় না। উদাহরণ হিসেবে অ্যান্টার্কটিক এলাকার অক্টোপাসের কথা বলা যেতে পারে। এদের রক্তে প্রোটিন হিসেবে হিমোগ্লোবিনের বদলে থাকে হিমোসায়ানিন। এই প্রোটিন মৌল হিসেবে আয়রনের বদলে কপার ব্যবহার করে। দেহের ভেতরে থাকা অবস্থায় রক্তের কোনো রং থাকে না। কিন্তু বাইরের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই নীল রং হয়ে যায়। এই নীল রক্তের অনেক সুবিধা আছে। কারণ, অতিরিক্ত ঠান্ডায় হিমোগ্লোবিন থেকে অক্সিজেন সহজে আলাদা হতে চায় না। তখন শীতের দেশের প্রাণীদের টিস্যুতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু হিমোসায়ানিনের অক্সিজেনের প্রতি আকর্ষণ অনেক কম। তাই অতিরিক্ত ঠান্ডাতেও খুব সহজেই হিমোসায়ানিন থেকে অক্সিজেন আলদা হয়ে যায়। এভাবেই নীল রক্ত শীতপ্রধান অঞ্চলের প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখছে।