শুঁয়াপোকার অদ্ভুত অভিযোজন
ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এসব জীবাণুর সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়তই যুদ্ধ চলে। তবে মজার বিষয় হলো, শরীরে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো কিন্তু আদতে আমাদের উপকারই করে। প্রাণিদেহের অন্ত্রে বাস করা ব্যাকটেরিয়া রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিপক্ষে সরাসরি লড়াইও করে। এ লড়াই পোষক দেহের রোগপ্রতিরোধ-ব্যবস্থাকে দৃঢ় করে। এমনকি এসব ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবডি তৈরিতেও প্রত্যক্ষ কাজ করে। কিছু কিছু উদ্ভিজ্জ শর্করা (যেমন সেলুলোজ) প্রয়োজনীয় উেসচক তৈরি করে পরিপাকে সাহায্য করে। এমনকি ওষুধ ও খাদ্যের বিষাক্ত উপাদান ধ্বংসের মাধ্যমে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে। এককথায় বলা যায়, অন্ত্রে এসব ব্যাকটেরিয়ার অনুপস্থিতি প্রাণিজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি ভয়াবহ রোগ সৃষ্টিতেও সক্ষম। তবে টবিন হ্যামার নামের একজন বাস্তুবিদ্যা বিশেষজ্ঞের শুঁয়াপোকার আন্ত্রিক অণুজীব নিয়ে গবেষণা কিন্তু অন্য কথাই বলে। অবাক করা বিষয় হলো, শুঁয়াপোকার অন্ত্রে বাসকারী অণুজীবের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম কম।
আমেরিকার ১২৪টি প্রজাতির তৃণভোজী বন্য শুঁয়াপোকার আন্ত্রিক অণুজীবদের নিয়ে গবেষণা করেন টবিন হ্যামার। জুলাই মাসে প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকায় তিনি এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এদের অন্ত্রে বাসকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা নগণ্য ছিল। কিছু কিছু শুঁয়াপোকার অন্ত্রে এ ধরনের কোনো অণুজীবই পাওয়া যায়নি। এমনকি শুঁয়াপোকার মলে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়ার অধিকাংশই ছিল তাদের পোষক গাছের পাতায় বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া। এদের অন্ত্রে প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়াগুলো ছিল ক্ষণস্থায়ী। একই প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও অসংখ্য বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ একই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কোনো কলোনি খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাধারণত প্রাণিদেহে বাসকারী একই ধরনের ব্যাকটেরিয়াগুলো কলোনি গঠন করে থাকে।
শুঁয়াপোকার শরীরে আসলেই অণুজীবদের কোনো ভূমিকা আছে কি না, তা জানতে টবিন কিছু শুঁয়াপোকার চাষ করলেন। এরপর এদের শরীরে বিভিন্ন ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দেন। উদ্দেশ্য ছিল তাদের আন্ত্রিক সব অণুজীব ধ্বংস করে শুঁয়াপোকার শরীরে এর কোনো বিরূপ প্রভাব আছে কি না, তা দেখা। টবিন অদ্ভুতভাবে লক্ষ করলেন, এতে শুঁয়াপোকাদের কোনো সমস্যাই হয় না; বরং দেখা গেছে, কিছু ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শুঁয়াপোকার রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। টবিনের মতে, শুঁয়াপোকার এ ধরনের বিবর্তন হয়তো অণুজীবের সাহায্য ছাড়া স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার প্রয়াস।
যা-ই হোক, এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে টবিন আবিষ্কার করেন, শুঁয়াপোকার আন্ত্রিক পরিবেশ অণুজীবের বেঁচে থাকা কিংবা বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। শুঁয়াপোকার আন্ত্রিক পরিবেশ অত্যন্ত ক্ষারীয়, পিএইচ স্কেলে ১০-এর বেশি। এদের অন্ত্রে পোষক উদ্ভিদ থেকে আসা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রোটিন থাকে, যা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংসে অত্যন্ত কার্যকর। এ ছাড়া শুঁয়াপোকার অত্যন্ত সাধারণ নলসদৃশ গঠন অণুজীবের কলোনি গঠনের উপযোগী নয়। আবার এদের আন্ত্রিক প্রাচীর ক্রমাগত প্রতিস্থাপিত হয়। ফলে ব্যাকটেরিয়ার কলোনি গড়ে উঠতে পারে না।
অন্ত্রে বাসকারী ব্যাকটেরিয়া মূলত উদ্ভিজ্জ শর্করা পরিপাকে সহায়তা করে থাকে।
যেহেতু শুঁয়াপোকা বেঁচেই থাকে উদ্ভিদের পাতা খেয়ে, তাই প্রশ্ন ওঠে, এসব ব্যাকটেরিয়া ছাড়া শুঁয়াপোকার খাদ্য পরিপাক হয় কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরও নতুন তথ্য বের হয়ে আসে। শুঁয়াপোকার অন্ত্রে যান্ত্রিক পরিপাকের জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে এবং পরিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় উেসচক নিজেই তৈরি করে।
এ ছাড়া অত্যন্ত ক্ষারীয় পরিবেশ খাদ্য পরিপাক ও খাদ্য উপাদান পৃথক্করণে বিশেষভাবে উপযোগী। তবে যত ব্যবস্থাই থাকুক না কেন, এর মাধ্যমে শুঁয়াপোকা খুব বেশি পুষ্টি পায় না। তাই বেশি পাতা ভক্ষণের মাধ্যমে তারা পুষ্টির ক্ষতিপূরণ করে থাকে। উদ্ভিদের কোষে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ (অ্যালকালয়েড) থাকে, যা প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর। এসব ক্ষতিকর পদার্থ নষ্ট করে ফেলার জন্য তৃণভোজী প্রাণীদের শরীরে বাসকারী ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, শুঁয়াপোকার শরীরে তার নিজের তৈরি কিছু কৌশল রয়েছে, যার মাধ্যমে এরা এসব বিষাক্ত পদার্থ ধ্বংসে সক্ষম। তবে শুঁয়াপোকা ছাড়াও আরও কিছু প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের ক্ষেত্রেও আন্ত্রিক অণুজীবের অনুপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
অণুজীববিজ্ঞানীদের মতে হয়তো আমরা আন্ত্রিক অণুজীবদের যত বেশি প্রয়োজনীয় ভেবেছিলাম, তারা হয়তো ততটা প্রয়োজনীয় নয়। হয়তো ভবিষ্যতে বিবর্তনের ফলে সব প্রাণীই আন্ত্রিক অণুজীবদের সাহায্য ছাড়া স্বাধীনভাবে চলতে পারবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: নেচার
*লেখাটি ২০১৭ সালেল বিজ্ঞানচিন্তা সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়