পৃথিবীর সমস্ত সাপ মারা গেলে কী হতো

আজ ১৬ জুলাই বিশ্ব সাপ দিবস। অনেকেই সাপ দেখলেই পিটিয়ে মেরে ফেলেন বা সাপের ক্ষতি করেন। কিন্তু সাপেরও ভূমিকা রয়েছে আমাদের প্রতিবেশে। আজ বিশ্ব সাপ দিবসে জেনে নিন, পৃথিবীর সব সাপ বিলুপ্ত হয়ে গেলে কী হতো।

সাপ। সরীসৃপ শ্রেণির এই প্রাণীটি মূলত মাটির নিচে বা পানিতে বাস করে। অনেক সময় বসতবাড়ির অন্ধকার কোণায় বা মানুষের পা পড়ে না সহজে, এমন জঞ্জালের মাঝেও এদের আস্তানা খুঁজে পাওয়া যায়। দেখতে ভয়ানক হলেও, সাপ নিরীহ প্রাণী। বিরক্ত বা আক্রান্ত না হলে মানুষকে আক্রমণ করে না। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কাছে আসার প্রয়োজনও নেই এদের। যেটুকু খাবার প্রয়োজন, তা শিকার করতে পারে আশপাশ থেকেই। তারপরও প্রতিবছর সাপের কামড়ে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যান পৃথিবীজুড়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য এমনটাই বলছে।

নিরীহ হলেও তাই সাপ নিয়ে অনেকের মাঝে আছে প্রবল আতংক। পৃথিবী থেকে সব সাপ বিলীন হয়ে গেলে এসব মানুষ হয়তো স্বস্তি পেতেন। হয়তো প্রতিবছর বেঁচে যেত প্রায় ১ লাখ মানুষের প্রাণ। কিন্তু সেটা কি পৃথিবীর জন্য সবদিক থেকে ভালো হতো? এই প্রাণীটি পৃথিবীর জীববৈচিত্রের মঞ্চে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

হঠাৎ কোনো প্রাণী বিলুপ্ত হওয়া সহজ নয়। সময় লাগে। পরিবেশ ও প্রকৃতির ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো প্রাণী নিজেকে খাপ খাওয়াতে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। এ ছাড়া মহামারি বা অতিদুর্যোগের কারণেও কোনো কোনো প্রাণিগোষ্ঠি বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু সাপের ক্ষেত্রে এগুলো কোনোটাই তেমন কাজে আসবে না। কারণ, সাপ নিজেকে দারুণভাবে অভিযোজিত করে নিতে পারে।

মানুষ বনাম সাপের দৃষ্টি

পৃথিবীর সব জায়গাতেই সাপ দেখা যায়। সমুদ্র, পাহাড়, সমতল, বনাঞ্চল বা মরুভূমি¬—সবখানেই আছে সাপের বসবাস।

তাই প্রাকৃতিকভাবে শুধু সাপের বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভবনা এখন পর্যন্ত খুবই কম। সাপ বিলুপ্ত করার কাজটি তাই মানুষকেই করতে হবে। অর্থাৎ মেরে ফেলতে হবে পৃথিবীর সব সাপ। (আসলেই মেরে ফেলার কথা বলছি না। শুধু আলোচনা সুবিধার্থে, সাপ কীভাবে বিলুপ্ত হতে পারে, তা বলছি।) বলা সহজ হলেও, কাজটা প্রায় অসম্ভব।

পৃথিবীতে প্রায় ৩,৪০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। সাপের কান নেই। তাতে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় না এই মেরুদণ্ডী প্রাণীর। ত্বক দিয়েই দিব্যি শব্দ তরঙ্গ বুঝতে পারে। সাপের দৃষ্টি শক্তিও আমাদের মতো নয়। সব রং তারা দেখতে পায় না। তবে তাদের চোখের আছে দারুণ এক ক্ষমতা। ইনফ্রারেড বা অবলাল আলো ধরা পড়ে সাপের চোখে। ফলে তাপীয় কোনো উৎস খুব সহজেই চোখে পড়ে এদের। সাপের জিহ্বারও আছে অদ্ভুত সক্ষমতা। কেবল স্বাদ নয়, বাতাসের গন্ধ শনাক্ত করতে পারে সাপ জিহ্বার সাহায্যে। এদের চোয়ালের পেশী স্থিতিস্থাপক হওয়ায় নিজের চেয়ে আকারে বড় শিকারকেও গিলে নিতে পারে নিমেষে।

সব মিলে সাপের বংশ নির্বংশ করা মোটেই সহজ নয়। তারপরও ধরা যাক, মানুষ এই আপাত অসম্ভব কাজটি করতে সক্ষম হলো। পৃথিবী হলো পুরোপুরি সাপমুক্ত। শুনতে কিছুটা ভালো লাগলেও, সাপ বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হবে মূল সমস্যা।

সাপের খাদ্য তালিকায় আছে ইঁদুর, পাখি বা ব্যঙের মতো প্রাণী। সাপ না থাকলে এসব প্রাণীর সংখ্যা অল্প কিছুদিনের মাঝেই ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। অতিরিক্ত এসব প্রাণী নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হামলা চালাবে মানুষের খাদ্যভাণ্ডার, অর্থাৎ শস্যক্ষেত্রে।

প্রাণিজগতে তাই কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রতিটি প্রাণীই এই পৃথিবীর জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রমবর্ধমান এই প্রাণীদের হাত থেকে খাদ্য বাঁচাতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে কৃষকদের। এটা একদিক থেকে যেমন মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলবে, তেমনি জিনিসপত্রের দাম বাড়বে হু হু করে।

ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীতে আবারও ফিরতে পারে বিউবোনিক প্লেগের মতো মহামারি। শুধু প্লেগ নয়, নতুন নতুন মহামারিও দেখা দিতে পারে বিশ্বজুড়ে। সাপকে বিদায় করার পর শুধু ইঁদুরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে প্রয়োজন হবে আমাদের নতুন এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার। গল্পের সেই বংশিবাদককে তো পাওয়া যাবে না। তাই ইঁদুর, ব্যাঙ বা পাখির মতো প্রাণিদের বংশ নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে হবে বিজ্ঞানীদের।

খাদ্যশৃঙ্খলে সাপের অবস্থান শীর্ষে নয়। শুকর কিংবা পেঁচা ও ইগলের মতো পাখিরা খাদ্যের জন্য সাপের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। সাপ না থাকলে এসব প্রাণী পড়বে খাদ্য সংকটে। যার প্রভাব ছড়িয়ে যাবে খাদ্যশৃঙ্খলের একদম সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। অনেক প্রজাতির প্রাণীই পড়বেই বিলুপ্তির মুখে।

মানুষও কিছু ব্যাপারে সরাসরি সাপের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে সাপের বিষ ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধীর ওষুধ তৈরি হয় সাপের বিষ থেকে। সাপের বিলুপ্তিতে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এসব ওষুধের সংকটে পড়বে। সাপের কারণে বছরে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তারচেয়ে হয়তো অনেক বেশি মানুষ মৃত্যুমুখে পড়বে সাপ বিলুপ্ত হয়ে গেলে। সার্বিকভাবে তখন পৃথিবী নেমে আসবে এক ভয়ংকর বিপর্যয়।

প্রাণিজগতে তাই কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। প্রতিটি প্রাণীই এই পৃথিবীর জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফশো ডট কম, ডাব্লিউএইচও, উইকিপিডিয়া