বাইপোলার ডিসঅর্ডার: মনের রোলার কোস্টার!

ধরুন, আপনার মনটা হঠাৎ টার্বো গতিতে ছুটে চলছে, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ মনে হচ্ছে। একসঙ্গে অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার মনটা ডুবে গেল অতল বিষণ্নতায়। সবকিছু অর্থহীন লাগে, অসহ্য লাগে নিজেকেই। এ ধরনের সমস্যাকে বলে বাইপোলার ডিসঅর্ডার।

এটা মস্তিষ্কের মানসিক স্বাস্থ্যগত অসুস্থতা। এর মূল কারণ হলো মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা। বিশেষ করে ডোপামিন, সেরোটোনিন ও নর-এপিনেফ্রিন নামে রাসায়নিকগুলো যখন ঠিকঠাক কাজ করে না, তখন এই সমস্যা দেখা দেয়। এর সাধারণত দুটি ধাপ দেখা যায়। ম্যানিয়া ও ডিপ্রেশন। বেশি আত্মবিশ্বাস, কম ঘুম, দ্রুত কথা বলা, ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া ম্যানিয়ার লক্ষণ। আর ডিপ্রেশন হলো মন খারাপ, আগ্রহহীনতা, ঘুম বা খাওয়ায় সমস্যা ইত্যাদি। এটা কোনো পাগলামি নয়। ডায়াবেটিস রোগীদের যেমন ইনসুলিনের ঘাটতি হয়, তেমনই মস্তিষ্কের কেমিক্যাল ভারসাম্য নষ্ট হয় এই অসুখে।

তবে ভয়ের কিছু নেই। এর চিকিৎসা আছে, ওষুধ ও কাউন্সেলিংয়েও কাজ হয়। এর সবচেয়ে বড় ওষুধ সহানুভূতি। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে নিউরোট্রান্সমিটার পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। নিউরোট্রান্সমিটার হলো এমন রাসায়নিক বার্তাবাহক, যেগুলো মস্তিষ্কের এক স্নায়ুকোষ থেকে আরেকটিতে সংকেত পাঠায়। এদের কাজ হলো চিন্তা, আবেগ, ঘুম, খাওয়া, মনোযোগসহ বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা। এর সঙ্গে মস্তিষ্কের তিনটি জিনিস জড়িত। প্রথমটা ডোপামিন। এটাকে বলা হয় রিওয়ার্ড কেমিক্যাল। আনন্দ, মোটিভেশন—এগুলো হয় ডোপামিনের প্রভাবে। ডোপামিনের মাত্রা বেড়ে গেলে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত, ঘুমের প্রয়োজন কমে যাওয়া, অতিরিক্ত কথা বলার প্রভাব দেখা যায়। আবার এর মাত্রা কমলে আগ্রহহীনতা দেখা যায়। শক্তি ও মোটিভেশনের অভাব হয়।

মস্তিষ্ক একরকম রাসায়নিক ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে না। ফলে মানুষটি কখনো হঠাৎ আনন্দিত হয়, আবার কখনো অকারণে মনোবেদনায় ডুবে যায়।

দ্বিতীয়টি হলো সেরোটোনিন। এটি আবেগের ভারসাম্য ও ঘুম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ডিপ্রেশনের সময় সেরোটোনিনের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মন খারাপ হয়, বিষণ্ন লাগে। সেরোটোনিনের ঘাটতি মস্তিষ্কে মানসিক স্থিতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। এতে মুড একেক সময় একেক রকম থাকে।

আর তৃতীয়টি নর-এপিনেফ্রিন। এটি মনোযোগ ও শক্তি নিয়ন্ত্রণ কাজ করে। বাইপোলার ডিসঅর্ডারে এই কেমিক্যালগুলোর উত্থান-পতন হয় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ও অপ্রত্যাশিতভাবে। মস্তিষ্ক একরকম রাসায়নিক ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে না। ফলে মানুষটি কখনো হঠাৎ আনন্দিত হয়, আবার কখনো অকারণে মনোবেদনায় ডুবে যায়। 

লেখক: প্রভাষক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ