বাংলাদেশে নতুন তিন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার

সম্প্রতি তিনটি নতুন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার করেছি বাংলাদেশি গবেষকেরা। ফড়িংগুলো পাওয়া গেছে টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান, পাথরঘাটা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, চরকুকরি মুকরি ও সিলেট অঞ্চলের আন্তঃসীমানা এলাকার পাহাড়ি ছড়ায়। এগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে ফাইলোথেমিস এল্টোনি, ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি ও অ্যানাক্স এফিপিগার। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ ফিরোজ জামান ও আশিকুর রহমান সমী। তাঁদের কলমেই পড়ুন আবিষ্কারের কথা।

Anax ephippigerছবি: আশিকুর রহমান
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০৩ প্রজাতির ফড়িং রয়েছে। এর মধ্যে ৫৮ প্রজাতির ফড়িং এবং ৪৫ প্রজাতির সূচফড়িং

গ্রামের বিলে ফুটেছে অসংখ্য শাপলা। সে শাপলা পাতায় বসেছে লাল, সবুজ ও নীল বর্ণের অসংখ্য ফড়িং। তার অপরূপ রূপে জলাশয়গুলোর সৌন্দর্য বেড়ে গেছে বহুগুণ। ফড়িং শব্দটা শুনলেই মন চলে যায় শৈশবের  সোনারোদের হাসিমাখা দিনগুলোতে। সেই দিনগুলোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ফড়িং। বাস্তুতন্ত্রে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় ফড়িং যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সে উপলব্ধি হয়তো আমাদের তখন ছিল না। ফড়িং সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা যে সুস্থ জলাশয় পেতে পারি, তা বর্তমানেও আমাদের অনেকের ধারণার বাইরে।

জল ও স্থল—দুই স্থানেই জীবনচক্র সম্পন্নকারী অ্যাম্পফিবিয়াস পতঙ্গের একটি বর্গ অডানাটা (Odonata)। ফড়িং (Dragonfly) ও সূচফড়িং (Damselfly) এর অন্তর্ভুক্ত। মেসোজয়িক যুগে অডানাটার উৎপত্তি। সে অনুযায়ী পৃথিবীতে এটি অন্যতম প্রাচীন প্রাণী হিসাবে পরিচিত।

অডানাটা শব্দের অর্থ দাঁত। আক্ষরিক অর্থে ম্যান্ডিবল বা নিম্ন চোয়ালে শক্ত দাঁত সম্পন্ন প্রাণীকে বোঝায়। এদের সাধারণত প্রিডেটরি ইনসেক্ট বা শিকারী পতঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। এরা অন্য পতঙ্গ ও ফড়িংদেরও শিকার করে খায়। তাই এদের নিচের ম্যান্ডিবল ধারালো ও প্রচুর শক্ত। এখন পর্যন্ত এদের মোট প্রজাতির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে ফড়িং প্রজাতির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এদের বর্ণিল বর্ণচ্ছটা দেশের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০৩ প্রজাতির ফড়িং (৫৮ প্রজাতির ফড়িং এবং ৪৫ প্রজাতির সূচফড়িং) রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংখ্যাটা প্রায় ১৫০ প্রজাতির বেশি হতে পারে।

নতুন আবিষ্কৃত ফড়িংগুলো হলো ফাইলোথেমিস এল্টোনি (Phyllothemis eltoni), ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি (Elattoneura campioni) ও অ্যানাক্স এফিপিগার (Anax ephippiger)

গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণী রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে আমাদের গবেষণাদলের গবেষণার একটা বড় অংশ ছিল বাংলাদেশের জলজ ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর। সম্প্রতি আমাদের বিস্তৃত গবেষণা হচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-মধ্য উপকূলীয় বন্যপ্রাণী, তথা জীববৈচিত্র্য নিয়ে। এর মধ্যে টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান, পাথরঘাটা জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, চরকুকরি মুকরি অন্যতম। পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলের আন্তঃসীমানা এলাকায় পাহাড়ি ছড়াকেন্দ্রীক জীববৈচিত্র নিয়েও আমরা গবেষণা করছি। ফাইলোথেমিস এল্টোনি, ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি ও অ্যানাক্স এফিপিগার

সম্প্রতি আমরা এই এলাকাগুলো থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শনাক্ত করেছি তিন প্রজাতির ফড়িং ও সূচ ফড়িং। এগুলো হলো ফাইলোথেমিস এল্টোনি (Phyllothemis eltoni), ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি (Elattoneura campioni) ও অ্যানাক্স এফিপিগার (Anax ephippiger)। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে আমরা খুঁজে পাই এ ফড়িংগুলো। এর আগেও ১০ বছরে আমরা আরও নতুন ১২ প্রজাতির প্রাণী শনাক্ত করেছি বাংলাদেশে। বিরল ও বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের এই ফড়িংগুলো বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। পাশাপাশি এ প্রজাতিগুলো সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ প্রয়োজন।

Elattoneura campioni
ছবি: আশিকুর রহমান

ফাইলোথেমিস এল্টোনি ও ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি প্রজাতি দুটি আমরা প্রথম দেখতে পাই মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রাজকান্দী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গহীনের ছড়ায়। গত ডিসেম্বরে আমাদের গবেষণা দল রাজকান্দী বনে জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহের অনুসন্ধান করে। বিশেষ করে পাখি, প্রজাপতি ও ফড়িংয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এ অনুসন্ধানে।

বনের গহীনে ছড়ায় যখন সবাই মহাবিপন্ন উল্লুকের ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন একটি অন্যরকম ছোট পতঙ্গ দেখতে পাই আমরা। আমাদের গবেষক দলের অনুসন্ধিৎসু মন ছুটে চলে ফড়িংয়ের পেছনে। কিছু দূর গিয়ে দেখা পাই একই প্রজাতির আরও দুটি ফড়িংয়ের। তিনটি ফড়িং দেখতে পিগমি স্কিমারের (Pigmy Skimmer, বৈজ্ঞানিক নাম: টেট্রাথেমিস প্ল্যাটিপটেরা—Tetrathemis platyptera) মতো হলেও এর রয়েছে দৈহিক সূক্ষ্ম ভিন্নতা। সময় ক্ষেপণ না করে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন মেনে, ফড়িংটির কোনো ক্ষতি না করে শরীরের বিভিন্ন অংশের ছবি তোলা হয়। এরপর আবারও শুরু হয় বনে অনুসন্ধান।

উদ্দেশ্য এরকম আরও কিছু ফড়িং খুঁজে পাওয়া। কিছু দূর গিয়ে দেখা মেলে ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি ফড়িংয়ের। এটি একটা তরুলতার ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার-এর তথ্য মতে, দুটি ফড়িংই বিশ্বে খুব বিরল। এমনকি এদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ঘাটতির কারণে আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় ডাটা ডেফিসিয়েন্ট (Data Deficient) প্রজাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফাইলোথেমিস এল্টোনি ফড়িংটি ইতিপূর্বে মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের আসাম থেকে শনাক্ত করা হয়েছে। আর ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি শুধু ভারত থেকে শনাক্ত করা হয়।

Phyllothemis eltoni
ছবি: আশিকুর রহমান

এর আগে, ২০১৭ সালে গবেষণা দলের একটি অনুসন্ধানে এ প্রজাতিটি মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া থেকে সংগ্রহ করা হলেও প্রজাতিটি পূর্ণাঙ্গভাবে শনাক্ত করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য তখন ছিল না। অ্যানাক্স এপিফিগার (Anax ephippiger) পরিচিত ভ্যাগরান্ট এম্পেরর (Vagrant emperor) নামে। এটি একটি পরিযায়ী ফড়িং। পতঙ্গের মধ্যে পরিযায়ন ব্যাপারটি প্রাণিবিজ্ঞানে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ছোট্ট একটি পতঙ্গ জীবনচক্র সম্পন্নে বা শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজনে অনেক দূর পরিভ্রমণ করে। গত নভেম্বরে কুয়াকাটার টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে উপকূলীয় বন্যপ্রাণীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নির্ণয়ে গবেষণার তথ্য সংগ্রহের সময় দেখা মেলে এই পরিযায়ী ফড়িংয়ের। মূলত প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্নের কাজে এটি বাংলাদেশে আসে। ওই প্রকল্পের সহ-তত্ত্বাবধানে ছিলেন মো. মাহাবুব আলম ও মো. ফজলে রাব্বি।

বিশ্বব্যাপী ফড়িংটি আইইউসিএন-এর তথ্য মতে, লিস্ট কনসার্ন (Least Concern)। ভারতীয় উপমহাদেশের ফড়িংবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ড্রাগনফ্লাই সাউথ এশিয়ার (Dragonfly South-Asia) বিশেষজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের সহযোগিতায় পূর্ণাঙ্গ রূপে ফড়িংগুলো শনাক্ত করা হয়।

বাস্তুতন্ত্রে ফড়িং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে এরা শিকারী বৈশিষ্ট্যের হওয়ায় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসল রক্ষা করে। পাশাপাশি এরা মশার লার্ভাও খায়৷ মশা দমনে বিভিন্ন দেশে ফড়িং খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শহরগুলোতে মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এ ফড়িং। এ জন্য আমাদের বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা পরিচালনা করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে আমরা হয়তো হারিয়ে ফেলব অজানা অনেক ফড়িংয়ের প্রজাতি। এ ছাড়া দেশব্যাপী ফড়িং সংরক্ষণে আরও বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা। তাহলেই এসব ফড়িংজাতীয় উপকারী পতঙ্গগুলো আমাদের দেশে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।

লেখক: মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;

আশিকুর রহমান সমী, বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) বাংলাদেশ