ঝুঁকিতে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

বাংলাদেশে তিনটি ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য ও শতাধিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, যা বঙ্গীয় অঞ্চলের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারের এই ভূখণ্ড পশ্চিম এবং উত্তর ও উত্তর–পূর্ব অঞ্চল ভারত এবং দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চল মিয়ানমার সীমান্ত পরিবেষ্টিত। উত্তর ও দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের কিছু পার্বত্য এলাকা ও উচ্চভূমি ব্যতীত সমগ্র দেশটি মোটামুটি সমতল ভূমি ও নিম্নাঞ্চল। সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ৪ থেকে ৫ মিটার। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৩৭ জন। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশের তালিকায় দশম স্থানে রয়েছে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে, যার ছোঁয়া আর্থসামাজিক ক্ষেত্রসমূহে পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ৮ শতাংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জলবায়ু প্রভাবিত দুর্যোগসমূহ যদি চলমান থাকে তবে ২০৩০ সালের মধ্যে এই ক্ষতি ২ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য এক ব্যাপক ঝুঁকি হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। এর ফলে ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে, বৃষ্টিপাতের তারতম্য হবে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে এবং ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহ ঝুঁকির মুখে পড়বে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই নগণ্য, সে জন্য এই ঐতিহ্যসমূহ সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ব্যাপক ঝুঁকির মুখোমুখি হবে বলে ইতিমধ্যেই প্রতীয়মান হয়েছে। ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যসহ যেসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহ বিশেষ বৈশ্বিক মর্যাদাপূর্ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা সংরক্ষণের জন্য ১৯৭টি রাষ্ট্রপ্রধানেরা সম্মত হয়েছেন। সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যগুলোর সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়টি এক দশকেরও আগে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির নজরে আনা হয়। সঙ্গে অনেকগুলো প্রতিবেদন ও বিষয়ভিত্তিক পর্যালোচনাও প্রকাশ করা হয়। ২০১৪ সালের একটি সমন্বিত জরিপে দেখা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ১৩০টি সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। প্যারিস চুক্তিতে বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও এর অনেক ধারায় এসব ঐতিহ্যের জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হয়েছে। প্যারিস চুক্তির আলোকে ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নের অ্যাজেন্ডা এবং এর লক্ষ্যসমূহের, বিশেষ করে লক্ষ্য ১১ দশমিক ৪-এ বিশ্ব ঐতিহ্যসমূহের সংরক্ষণ উদ্যোগ জোরদার করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঝুঁকির মুখে।

বন্যার কারণে সোনারগাঁ, পানাম নগর, ঢাকার পুরাকীর্তিসহ লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু দৃশ্যমান সাংস্কৃতিক নিদর্শন, যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন গান, খাদ্যাভ্যাস, আতিথেয়তা ও সামগ্রিকভাবে লোকজ সংস্কৃতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলবে। যেমন বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীদের চিরায়ত সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তনের ঝুঁকি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুটি উদাহরণ দেওয়া জরুরি। এক. বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ৪৬১টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে ১০৮টি স্থান খুলনা ও বরিশাল বিভাগে অবস্থিত। এই ১০৮টির মধ্যে ৫৯টি স্থান উপকূল প্রভাবিত অঞ্চলে অবস্থিত। এই ৫৯টি স্থানের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ও জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার একটি প্রাক্‌–সম্ভাব্যতা জরিপে ১৮টি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা মসজিদ নগরী বাগেরহাট অন্তর্ভুক্ত। যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পায়, তাহলে মসজিদ নগরী বাগেরহাটে অবস্থিত ষাটগম্বুজ মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, বিবি বেগুনি মসজিদ, রেজাখোদা মসজিদ, রনবিজয়পুর মসজিদ, নয়গম্বুজ মসজিদ, জিন্দাপীরের মাজার ও মসজিদ, সিঙ্গাইর মসজিদ, সাবেকডাঙ্গা নামাজ ঘর ও কোদলা মঠ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরার ঈশ্বরীপুর হাম্মামখানা, জাহাজঘাটা হাম্মামখানা, শ্যামসুন্দর মন্দির, প্রবাজপুর শাহি মসজিদ, তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ, অন্নপূর্ণা মন্দির, খুলনার মুসজিদকুর মসজিদ এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বসতভিটা ঝুঁকিপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার তালিকায় রয়েছে। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণ করতে না পারলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিশেষ করে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদিতার ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে, যা বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণভোমরা।

দুই

বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে কমপক্ষে ১৬টি সমতলের আদিবাসীদের বাসস্থান। এ অঞ্চলে প্রায় সাত লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে, যার অধিকাংশ কৃষিনির্ভর জীবিকায় অভ্যস্ত। ঐতিহ্যগতভাবে সহজ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী অত্যন্ত সমৃদ্ধ অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। অসংখ্য পার্বণ, নাচ, গান, রন্ধনপ্রণালি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আচার ও সামাজিক রীতিনীতি এই সাংস্কৃতির ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ভান্ডারের নিদর্শন বরেন্দ্র অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরাপ্রবণতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, যার কিছু আলামত ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। খরা বৃদ্ধির কারণে অনেক কৃষিভূমি যেখানে ধান বা সবজি চাষ হতো, সে রকম তিন ফসলি জমি এক ফসলি ফলদ উদ্যানে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ অস্থানীয় জমির মালিক ও জোতদার শ্রেণির মানুষ শ্রমনির্ভর কৃষিকাজের পরিবর্তে স্বল্প সেচভিত্তিক ফলদ বৃক্ষ রোপণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ভূ-উপগ্রহ চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় গত পাঁচ বছরে ১৩ শতাংশ কৃষিজমি স্থায়ী উদ্যানে পরিণত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ও খরাপ্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেলে এই রূপান্তর ত্বরান্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী ৫০ বছরে মোট বরেন্দ্র ভূমির ৫০ শতাংশ ফলদ বৃক্ষ বনায়নে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।

সমতলের আদিবাসী কৃষিজমির ওপর ভর করে পুরো সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেমন তাদের জীবন–জীবিকার ওপর প্রভাব পড়বে, বাধ্যতামূলক অভিযোজনে নিয়োজিত হয়ে তারা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে বসতে পারে। যদি বৃহদংশের আদিবাসীরা কৃষিকাজের জন্য যথেষ্ট সুযোগ না পায় এবং পেশা পরিবর্তন করে অকৃষিনির্ভর জীবনযাপনে বাধ্য হয়, তাহলে তাদের মূল্যবোধ, আচার–আচরণ, বিশ্বাস, জ্ঞান, খাদ্যাভ্যাস, সংগীত, রীতিনীতিসহ অনেক অদৃশ্য সাংস্কৃতিক উপাদান হারিয়ে ফেলতে পারে।

উপরিউক্ত দুটি বাস্তব উদাহরণ থেকে এটি নিশ্চিত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর একটি বড় ঝুঁকি রয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সচরাচর উন্নয়ন চিন্তার সময় এই ঐতিহ্যের ওপর উন্নয়নের কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বিবেচনা করা হয় না। ফলে এটা বলে দেওয়া যায় যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অসচেতন উন্নয়ন চিন্তার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক (দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান) ঐতিহ্যের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অবাক হলেও এটি সত্য যে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর কতটুকু পড়তে পারে, সে বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই। একই কারণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষাকল্পে কী ধরনের অভিযোজন পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে, এমন কোনো দিকনির্দেশনা নেই। উন্নয়ন ও জলবায়ুবিষয়ক পরিকল্পনায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে চোখ বুজে থাকার নীতি আমাদের শুধুই এক ঐতিহ্যবিহীন অর্থনৈতিক জাতিতে পরিণত করতে পারে। যে জাতির উন্নয়নধারা ও প্রগতি ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগহীন, চূড়ান্ত বিপদের সময় সে জাতি সর্বদাই দিশাহীন। তাই জলবায়ু পরিকল্পনায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

লেখক: জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বাংলাদেশ