দেহঘড়ি
টনসিল: কী ও কেন
শীত এলেই ফুলে যায় টনসিল। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরে ওঠেন অনেকে। এ ছাড়া আমাদের মনেই থাকে না অঙ্গটির কথা। কিন্তু কেন হয় টনসিল? এই অঙ্গের কাজই-বা কী? টনসিলের পরিচয়, গঠন ও কাজের সবিস্তার বিবরণ…
কম্বলের আরামদায়ক ওম, মজাদার পিঠাপুলি কিংবা পায়ের তলায় শর্ষে নিয়ে ঘোরাঘুরি করার যথার্থ সময়-সুযোগ শীতকালে উপভোগ করার মতো ব্যাপারের অভাব নেই। কিন্তু বিড়ম্বনায় পড়তে হয় ঠান্ডাজনিত নানা সমস্যা নিয়ে। বিশেষত যাদের প্রায়ই ঠান্ডা লাগার ধাত, তাদের তো শীত আসার আগে থেকেই শুরু হয় দুশ্চিন্তা। কারণ, অণুজীবদের জন্য অনুকূল এই আবহাওয়ায় এসব সমস্যা আর সাধারণ সর্দি–কাশি-গলাব্যথার মধ্যে আটকে থাকে না, তৈরি করে আরও জটিল পরিস্থিতি। টনসিলাইটিস, অর্থাৎ টনসিলের প্রদাহ বছরের যেকোনো সময়ে হতে পারে। তবে শীত এলে এর প্রকোপ যেন বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
টনসিলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় এই প্রদাহের সূত্রে। কারণ, স্বাভাবিক অবস্থায় মুখগহ্বরের একদম পেছনে দুই দিক থেকে ঝুলে থাকা মাংসপিণ্ডের মতো জিনিসগুলো বলতে গেলে নজরে আসে না, চিন্তায়ও তাই আসার কথা নয়। কিন্তু টনসিলাইটিসে তাদের আকার যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়, গলার পেছনে দুই দিক থেকে এগিয়ে এসে দেখা দেয় তারা। প্রদাহের মাত্রা বেশি হলে কখনো তাদের গায়ে দেখা যায় সাদা সাদা ছোপ। সঙ্গে থাকে প্রচণ্ড গলাব্যথা, জ্বরসহ নানা রকম সমস্যা। তখন মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে—কী এই টনসিল? শরীরের একটা অংশ রয়েছে শুধুই প্রদাহ আর সমস্যা সৃষ্টির জন্য—এমনটি তো হওয়ার কথা নয়! তবে কী কাজ তাদের?
আসলে টনসিল হলো শ্বাসনালি ও অন্ননালির প্রবেশপথ, অর্থাৎ ফ্যারিংকসের দেয়ালের সবচেয়ে ভেতরের অংশ, যাকে বলা হয় মিউকাস মেমব্রেন—তার নিচে জমা হওয়া একগাদা লসিকাকোষের সমষ্টি (Lymphatic Nodules)। অর্থাৎ তারা আসলে শরীরের ইমিউনিটি বা প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অংশ। শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ সিংহদুয়ারে একটা বলয় তৈরির মাধ্যমে তারা নিশ্চিত করে প্রথম সারির প্রতিরক্ষা।
আমরা টনসিল বলতে মূলত যাদের চিনি, তারা এই বলয়ের একটা অংশ—কোমল তালুর ঠিক নিচে আর সেখানকার দুটো মাংসপেশির পর্দার মাঝের কুঠুরিতে থাকে বলে তাদের পুরো নাম প্যালাটাইন টনসিল। তাদের সঙ্গীদের মধ্যে রয়েছে ফ্যারিঞ্জিয়াল, লিঙ্গুয়াল ও টিউবাল টনসিল—যারা খুব বেশি পরিচিত না হলেও তৈরি করে এই প্রতিরক্ষাবলয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
জিবের সবচেয়ে ভেতরের অমসৃণ অংশটুকুর আবরণীর ঠিক নিচে থাকে লিঙ্গুয়াল টনসিল। আর ফ্যারিঞ্জিয়াল টনসিলের অবস্থান ফ্যারিংকসের ছাদে। সব টনসিলের আকার শিশুদের ক্ষেত্রে বড় থাকে। বিশেষত ফ্যারিঞ্জিয়াল টনসিলগুলো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একরকম অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করে। পাঁচ-ছয় বছরের বেশি বয়সেও যদি এগুলোর আকার হ্রাস পাওয়ার বদলে বাড়তে থাকে, তখন তাদের বলে অ্যাডেনয়েড। গুরুতর অবস্থায় তারা শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে। অনেক সময় নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়া পুরোপুরি অসম্ভব হয়ে পড়ে, আর মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার কারণে মুখের অবয়বেও দেখা দেয় বিকৃতি। এই অবস্থার কেতাবি নাম ‘অ্যাডেনয়েড ফেস’।
রইল বাকি প্যালাটাইন টনসিল। টনসিলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এগুলো। তাদের পরিচিতি প্রায়ই প্রদাহ সৃষ্টির জন্য।
টনসিলাইটিসের আদ্যোপান্ত
ইমিউন সিস্টেম বা অনাক্রম্যতন্ত্রের অংশ হিসেবে শরীরকে ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচানো যাদের কাজ, তারাই আবার অনেক সময় ইনফেকশনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সৃষ্টি করে প্রদাহ। এই গোলমেলে বিষয় বুঝতে হলে তাদের কাজের ধরন একটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
টনসিলগুলো মূলত সেকেন্ডারি লসিকাগ্রন্থি। অর্থাৎ এখানে লিম্ফোসাইটের অ্যান্টিজেননির্ভর সক্রিয়তা ঘটে। শরীরে বহিরাগত যেকোনো বস্তু, হতে পারে অণুজীব, টক্সিন কিংবা ক্ষুদ্র অজৈব কণা—ইমিউনোলজির ভাষায় সব কটিকে বলা হয় অ্যান্টিজেন।
এই অ্যান্টিজেনের সঙ্গে যুদ্ধের হাতিয়ার হলো অ্যান্টিবডি, যা তৈরি হয় প্লাজমা কোষ থেকে। B লিম্ফোসাইটের বিভাজনে স্মৃতিকোষের সঙ্গে তৈরি হয় এই প্লাজমা কোষ। কিন্তু সে জন্য আগে লিম্ফোসাইটের সামনে সেই অ্যান্টিজেনকে প্রদর্শন করতে হয়। কারণ, নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে কেবল একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি।
এই প্রদর্শনের কাজটি করে একদল বিশেষায়িত কোষ। নাম তাদের অ্যান্টিজেন প্রেজেন্টিং সেল। এভাবে অ্যান্টিজেনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ভ্রাম্যমাণ কোনো লিম্ফোসাইট টনসিলের মতো কোনো সেকেন্ডারি লিম্ফয়েড অঙ্গে ফিরে এলে শুরু হয় রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া। সেই অ্যান্টিজেনের জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করে যে প্লাজমা কোষ, তার উৎপাদন বেড়ে যায় প্রচুর পরিমাণে। একই কারণে স্বাভাবিকভাবে বাড়ে লিম্ফোসাইটের সংখ্যা, আর এই লিম্ফয়েড অঙ্গগুলোর আকার।
কখনো ইনফেকশনের মাত্রা অনেক বেশি হলে কিংবা অ্যান্টিজেন বহনকারী অণুজীবগুলো সরাসরি এসব লিম্ফয়েড অঙ্গকে আক্রমণ করলে প্রতিক্রিয়াও হয় ব্যাপক। নতুন উৎপাদিত লিম্ফোসাইটগুলো যথাযথভাবে সংবহনে ছড়িয়ে যেতে পারে না, একই জায়গায় জমে থাকায় বাড়তে থাকে এই অঙ্গগুলোর আকার। টনসিলের ক্ষেত্রে এ অবস্থাকে বলা হয় টনসিলাইটিস। কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া, যেমন গ্রুপ এ বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস কিংবা কিছু ভাইরাস টনসিলাইটিসের বেশির ভাগ ঘটনার জন্য দায়ী।
টনসিলগুলো শ্বাসনালি ও অন্ননালির প্রবেশপথে থাকায় তাদের আকারের বৃদ্ধি শ্বাসপ্রশ্বাস ও খাদ্য গ্রহণে সমস্যা তৈরি করে। মিউকাস মেমব্রেনের নিচে জমে থাকা লসিকার চাপে দেখা দেয় অসহ্য ব্যথা, থাকে জ্বরের মতো প্রদাহের বিভিন্ন লক্ষণ। বেশির ভাগ সময় পরিমিত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার ও সাধারণ ব্যথানাশক এ সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে ওঠে যে টনসিল ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকে না। এই অপারেশনকে বলা হয় টনসিলেকটমি।
প্যালাটাইন টনসিলেকটমি বেশি পরিচিত হলেও অনেক সময় শিশুদের ফ্যারিঞ্জিয়াল টনসিলেকটমি করা হয়ে থাকে গুরুতর অ্যাডিনয়েডের ক্ষেত্রে।