আয় রে পাখি লেজ ঝোলা

খ্যরা হাড়িঁচাঁচা পাখিছবি: পিটার হিলস/ওয়ার্ল্ড বার্ড ফটো
লেজঝোলা পাখিকে নিয়ে ছড়া আছে অনেক। সেই ছড়ায় মা খোকনকে নিয়ে খেলা করার মিনতি জানিয়েছেন লেজঝোলা পাখির কাছে। সেই লেজঝোলা পাখি কোনটি। একেক বইয়ে একেক পাখির ছবি ছাপা হয় বিখ্যাত সেই ছড়ার সঙ্গে। সত্যি বলতে কি লেজঝোলা পাখি মাত্র একটি নয়। আমাদের দেশে বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির লেজ লম্বা হয়। একনজরে দেখে নেওয়া যাক লেজঝোলা পাখি কারা।

শাহ বুলবুল

লেজ লম্বা পাখির মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন পাখি শাহ বুলবুল। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এদের দেখা যায়। আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। মানুষকে এড়িয়ে চলে। ঘন বাঁশবাগানে ঘুড়ির মতো লেজ দুলিয়ে উড়ে বেড়ায়। শুধু পুরুষ পাখির লেজ লম্বা হয়। পাখির দেহের দৈর্ঘ্য মাত্র ২০ সেন্টিমিটার। কিন্তু পুরুষ পাখির শুধু লেজই ৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এদের গায়ের রং খয়েরি। পেটের দিকটা সাদা। কোনো কোনো পুরুষ পাখি ৩-৪ বছর বয়সে খয়েরি রং ঝরে সাদা রঙের পাখিতে পরিণত হয়। এই সাদা শাহ বুলবুলই এ দেশের সবচেয়ে সুন্দর পাখির একটা। এরা কীটপতঙ্গ খায়। ঘন ছায়াময় বাগানে বাসা বাঁধে। বৈজ্ঞানিক নাম Terpsiphone paradisi.

খয়রা হাঁড়িচাঁচা

গাঁয়ের লোকেরা একে বলে কুটুম্ব পাখি। লোকালয়ে তেমন আসে না। মাঝেমধ্যে লোকের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ক্যা ক্যা করে ডাকে তখন। এই ডাক শুনে লোকে বলে বাড়িতে কুটুম্ব আসবে। এরা সুযোগ পেলেই অন্য পাখির বাসায় হানা দেয়। ডিম-ছানা চুরি করে খায়। খায় কেঁচো, পোকা, ফল, ফুলের মধুও। টিকটিকি, ব্যাঙ, ছোট সাপ, ছোট বাদুড়, ইঁদুরও শিকার করে। এদের ডাক বেশ কয়েক রকমের হয়। কোয়াও কোউ, কো-কি-িল, চাটুক চুক, চ্যাক চ্যাক, কিটার কিটার ইত্যাদি। হাঁড়িচাঁচা ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। লেজই ২৩ সেন্টিমিটার। তাই একে লেজঝোলা বলা হয়। মার্চ থেকে জুলাই মাসের মধ্যে এরা বাসা বানায়। ৬ থেকে ৮ মিটার উঁচু ডালে বাসা বাঁধে। শুকনো পাতা ও গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি বাটির মতো বাসা। চার থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। ডিম সাদা রঙের। বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocitta vagabunda.

সবুজ টিয়া

লেজঝোলা পাখির ছড়াটা যেসব বইয়ে থাকে, সেখানে টিয়া পাখির ছবি আঁকা হয়। কিন্তু সব টিয়ার লেজ অত লম্বা নয়। তবে সবুজ টিয়ার লেজ বেশ লম্বা। ঢাকা শহরে প্রচুর সবুজ টিয়া আছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সবুজ টিয়ার দেখা মেলে। সবুজ লেজসহ পাখির দৈর্ঘ্য ৪২ সেন্টিমিটার। লেজের দৈর্ঘ্য ২৭ েসন্টিমিটার। দেশের সবচেয়ে সুদর্শন পাখিগুলোর একটা। গায়ের রং সবুজ। এদের গলায় কালো বলয় আছে। এরা নিরামিষভোজী। গাছের ফল, ফুল আর শস্যদানা খায়। ঝাঁক ধরে এসে গমখেতে হামলা করে। গমের শিষ কেটে উড়াল দেয় ঝাঁক বেঁধে। লম্বা গাছ, বিশেষ করে নারকেলগাছে ওপরের দিকে কোটরে বাসা বাঁধে। নিজেরা বাসা তৈরি করতে পারে না। বসন্তবাউরি কিংবা কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায় ডিম পাড়ে। বৈজ্ঞানিক নাম Pisttacula krameri.

সবুজ ঠোঁট মালকোয়া

দীর্ঘ লেজের এক বিশাল পাখি এই মালকোয়া। সাধারণত বনাঞ্চলে এদের দেখা মেলে। আবার ঢাকার পূর্বাচল আবাসিক এলাকায়ও কখনো কখনো এদের দেখা মেলে। ৫১ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এই পাখিটির শুধু লেজের দৈর্ঘ্য ৩৮ সেন্টিমিটার। ধূসর কালো এই পাখিটার মাথা-ঘাড়, গলা সাদা রঙের। ঠোঁট সাদাটে সবুজ। তাই এর এমন নাম। গাছের উঁচু ডালে লতাপাতা জড়িয়ে পেয়ালার মতো বাসা তৈরি করে। বৈজ্ঞানিক নাম Phaenicophaeus tristis.

বড় কুবো

গাঁয়ের বনে-বাদাড়ে কাকের মতো ঘুরে বেড়ায় খয়েরি-কালো রঙের পাখি। ভরাট গলায় কুব কুব করে ডেকে ভরদুপুরে কিংবা গোধূলির নির্জন মাঠের নীরবতা খান খান করে দেয়। আকারে কাকের সমান, দেখতেও কাকের মতো। সাধারণত মাটিতেই বেড়ায়। ঘাস-পাতার ভেতর থেকে কেঁচো, টিকটিকি, ব্যাঙ, পোকামাকড় ধরে খায়। সুযোগ পেলে অন্য পাখির বাসায় হামলা করে ডিম-ছানা সাবাড় করে। পাখিটার দৈর্ঘ্য ৪৮ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার। শুধু লেজের দৈর্ঘ্য ২৪ সেন্টিমিটার। উড়তে পছন্দ করে না। একান্ত প্রয়োজন হলে মাটি থেকে কয়েক মিটার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। বড় কলসাকৃতির অত্যন্ত আরামদায়ক বাসা বানায়। কবুতরের মতো বড় বড় সাদা ডিম পাড়ে। বৈজ্ঞানিক নাম Centropus sinensis.

পাকড়া পাপিয়া

পাকড়া পাপিয়া এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী হলেও আমাদের দেশি পাখি। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় জোড়া ধরে ঘুরে বেড়ায়। শীতকালে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে চলে যায় আফ্রিকায়। বসন্তের শুরুতে ঠিক যেখান থেকে গিয়েছিল, সেখানে আবার ফিরে আসে। পাকড়া পাপিয়া গ্রামে চাক পাখি নামে পরিচিত। কোকিল গোত্রের এই পাখিটার দৈর্ঘ্য ৩৩ সেন্টিমিটার। লেজের দৈর্ঘ্য ১৪ সেন্টিমিটার। কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে। কোকিলদের মতো এরাও নিজেরা বাসা বাঁধে না। ছাতারে পাখির বাসায় স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে। বৈজ্ঞানিক নাম Clamator jacobinus.

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত