শত বছরে ইনসুলিন

ফ্রেডেরিক বেন্টিং এবং চার্লস বেস্ট

আজ থেকে ১০০ বছর আগে, ১৯২১ সালের ১৭ মে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক জন মেক্লিওড একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর কয়েক মাস আগে তরুণ সার্জন ফ্রেডেরিক বেন্টিং এক অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তাঁর কাছে। অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন হরমোন উৎপাদনকারী বিশেষ বিটা সেলগুলোকে অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করে তা থেকে ইনসুলিন হরমোন নিষ্কাশন করা যায় কি না, বেন্টিং এটা পর্যবেক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি এই আইডিয়া পেয়েছেন একটি প্রবন্ধ পড়ে, যাতে বলা হয়েছিল, অগ্ন্যাশয়ের অন্যান্য কোষ থেকে বিটা কোষগুলো একটু বেশি সহনশীল, সহজে নষ্ট করা যায় না। কিন্তু বেন্টিং একজন অর্থোপেডিক সার্জন, এসব ল্যাবরেটরি গবেষণা সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই। তাই তিনি শরণাপন্ন হয়েছিলেন মেক্লিওডের। যদি তিনি একটা গবেষণাগার দিতেন, আর পরিচয় করিয়ে দিতেন এ–সংক্রান্ত এক্সপার্টদের সঙ্গে, তাহলে পরীক্ষাটা করে দেখতে পারতেন বেন্টিং।

বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারতেন মেক্লিওড। ডায়াবেটিস মানে তখন একটা ডেথ সেনটেন্স। বিশেষ করে টাইপ–১ ডায়াবেটিস। এটা মূলত শিশুদের হতো। আর এতে আক্রান্ত হওয়া মানে ডায়াবেটিক কিটো–অ্যাসিডোসিস নামের জটিলতায় ধুঁকে ধুঁকে বছরখানেকের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। এদিকে যে হরমোনের অভাবে এই রোগ হয়, মানে ইনসুলিন; তার উৎস, কার্যকারিতা ইত্যাদি সম্পর্কে নিত্যনতুন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ইনসুলিন তৈরি হয় যে অঙ্গে, মানে অগ্ন্যাশয়ে, তা খুবই নাজুক একটি অঙ্গ। চট করে নষ্ট হয়ে যায় এনজাইমের প্রভাবে। তা এই ছেলে যা বলছে, তা কি সত্যি সম্ভব?

বেন্টিং বোঝালেন, প্রথমে একটি কুকুরের প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের নালিগুলোকে বেঁধে দেওয়া হবে। এর ফলে অচিরেই গোটা প্যানক্রিয়াসটা যাবে নষ্ট হয়ে, কিন্তু বিটা কোষগুলো যেহেতু একটু বেশি সহনশীল, সেগুলো তখনো থাকবে ক্রিয়াশীল। সেই কোষগুলো বের করে এনে এরপর অগ্ন্যাশয় কেটে ফেলা হয়েছে, এমন কুকুরগুলোর শরীরে পুশ করা হবে। এবার দেখা যাক, সেই কুকুরগুলোর রক্তের শর্করার কী অবস্থা হয়! অগ্ন্যাশয় না থাকার কারণে ইতিমধ্যে সেগুলোর রক্তে শর্করা প্রায় আকাশচুম্বী।

মেক্লিওড এই স্বপ্নচারী তরুণকে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরি ব্যবহারের অনুমতি দিলেন ১৯২১ সালের ১৭ মে। সঙ্গে তাঁর সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন তাঁর ছাত্র চার্লস বেস্টকে। বেস্ট রক্তে শর্করা পরিমাপে এক্সপার্ট। শুরু হলো তিন বিজ্ঞানীর সাধনা। এর ফলে অচিরেই আবিষ্কৃত হলো ইনসুলিন, যাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবে ধরা হয় বিজ্ঞানের জগতে। সেই আবিষ্কারের কারণে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ডায়াবেটিসের রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে এক শতাব্দী ধরে।

বায়োকেমিস্ট জেমস কলিপ

ওই দিনের পরের ঘটনাগুলো বেশ চমকপ্রদ। শুরুতেই কিন্তু বেন্টিংয়ের গবেষণা সফল হয়নি। পরপর বেশ কিছু পরীক্ষা ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯২১ সালে ১০ নভেম্বর বেস্ট ও বেন্টিং আশার আলো দেখতে পেলেন। তাঁরা একটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কুকুরকে অগ্ন্যাশয় থেকে নিষ্কাশিত ইনসুলিন পুশ করে রক্তের শর্করার নিম্নহার লক্ষ করলেন। এরপর ৭০ দিনের মধ্যে কুকুরটির শর্করা একটু একটু করে কমে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এল। ডিসেম্বর মাসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন বায়োকেমিস্ট জেমস কলিপ। তাঁর সাহায্যে এই নিষ্কাশিত পদার্থকে আরও পিউরিফাই করা সম্ভব হলো। তবে নতুন গবেষণায় কুকুর থেকে নয়, গরুর প্যানক্রিয়াস থেকে তৈরি করা হলো ইনসুলিন। ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ লিওনার্দো থম্পসন নামের ১৪ বছরের মৃত্যুপথযাত্রী এক বালককে প্রথম ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া হলো। ছেলেটি তখন উচ্চমাত্রার শর্করার কারণে কিটো–অ্যাসিডোসিসে ভুগছে। প্রায় অচেতন আর কঙ্কালসার অবস্থা তার। ইনজেকশন পুশ করার পর তার রক্তে শর্করা কিছুটা কমে এল বটে, কিন্তু ইনজেকশনের জায়গায় সংক্রমণ হয়ে ফোড়ার মতো হয়ে গেল। অন্য প্রাণীর দেহ থেকে নিষ্কাশিত প্রোটিনজাতীয় হরমোন মানবদেহে প্রবেশ করানোর কারণে বেশ প্রতিক্রিয়াও হলো। জেমস কলিপ নিষ্কাশিত হরমোনকে আরও পিউরিফাই করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। এরপর লিওনার্দোকে দ্বিতীয় ডোজটি দেওয়া হলো ২৩ জানুয়ারি। এবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে লিওনার্দোর শর্করা কমতে কমতে প্রায় স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে এল। সে জ্ঞান ফিরে পেল আর সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। এই ঘটনার পর লিওনার্দো সুস্থভাবে আরও ১৩ বছর বেঁচে ছিল!

১৯২৩ সালে মেক্লিওড আর বেন্টিং যৌথভাবে ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন। বেন্টিং বেস্টের সঙ্গে নোবেলের সঙ্গে পাওয়া অর্থ ভাগ করে নেন। আর মেক্লিওড ভাগ করে নিলেন জেমস কলিপের সঙ্গে। এ তাঁদের উদারমনস্কতার পরিচায়ক। কিন্তু এর চেয়েও উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন বেন্টিং তাঁর আবিষ্কারের ফর্মুলা বা পেটেন্ট উন্মুক্ত করে দিয়ে। এলি লিলি কোম্পানি ইনসুলিন ইনজেকশনের উৎপাদন শুরু করে দ্রুতই, আর দেশে দেশে জীবন ফিরে পেতে থাকে ডায়াবেটিসের রোগীরা।

এভাবেই ১০০ বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল ইনসুলিনের। আর দিন দিন আরও আধুনিক আরও উন্নত আরও কার্যকর হয়েছে এই উৎপাদনক্রিয়া। প্রথমে প্রাণীর অগ্ন্যাশয় থেকে নিষ্কাশন করা হতো ইনসুলিন হরমোন, কিন্তু এতে মানবদেহে প্রায়ই অ্যালার্জিসহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেত। ১৯৭৮ সালে মানুষের ইনসুলিন প্রথম ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত হতে শুরু করল ই কোলাই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে। ১৯৮২ সালে এলি লিলি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে এই রিকম্বিন্যান্ট হিউম্যান ইনসুলিন। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একেবারেই কমে আসে। এরও পরে বিজ্ঞানীরা ইনসুলিন প্রোটিনের হরমোনের অ্যামিনো অ্যাসিডের শৃঙ্খলগুলোকে চিহ্নিত করলেন। শৃঙ্খলের দুয়েক জায়গায় সামান্য পরিবর্তন করে ইনসুলিন ইনজেকশনের কার্যকারিতায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন করা সম্ভব হলো। ফলে ল্যাবরেটরিতে তৈরি হতে লাগল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা র৵াপিড অ্যাক্টিং, লং অ্যাক্টিং, আলট্রা লং অ্যাক্টিং নানা ধরনের ইনসুলিন। ইনজেকশন ডেলিভারি সিস্টেমেও পরিবর্তন এল। সিরিঞ্জের বদলে এল পেন ডিভাইস, প্রায় ব্যথানাশক সুই, যা টিপকলমের মতোই সহজে ব্যবহারযোগ্য ও বহনযোগ্য। এরপর এল ইনসুলিন পাম্প। এটি একটি বিশেষ ডিভাইস, যা পেটের কাছাকাছি লাগিয়ে রাখলে তা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্তের শর্করার মাত্রা অনুযায়ী ত্বকের নিচে ইনসুলিন ডেলিভারি হতে থাকে। ইনসুলিন ইনহেলারও এরই মধ্যে বাজারজাত হওয়ার পথে। আসছে স্মার্ট ইনসুলিন, যা কিনা রোগীর শর্করার মাত্রা সেন্স করতে পারে।

২০২১ সালজুড়ে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে ইনসুলিনের শতবর্ষ উদ্‌যাপন। মানবেতিহাসে এই আবিষ্কার কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়ে চলেছে এখনো। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ডায়াবেটিসের রোগীদের জীবনকে আর দশজনের মতোই স্বাভাবিক করে তুলেছে এই আবিষ্কার। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ইনসুলিনের শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে তিন বছরব্যাপী ক্যাম্পেইন চালানোর ঘোষণা দিয়েছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা