যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশ্চর্যজনক ফল পেয়েছেন মলদ্বারের ক্যানসারের রোগীদের ওপর পরীক্ষামূলক ওষুধ ‘ডস্টারলিম্যাব’ প্রয়োগ করে। ১২ জন রোগী কমপক্ষে ছয় মাস ওষুধটি গ্রহণ করেছেন। তারপর তাঁদের প্রত্যেকের শরীর থেকে ক্যানসার উধাও হয়ে যায়। কোনোরকম সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন ছাড়া ওষুধ ব্যবহার করে এটি সম্ভব হয়েছে। এ রকম শতভাগ সাফল্যের ঘটনা ক্যানসার গবেষণার ইতিহাসে বিরল। কিন্তু ক্যানসারের চিকিৎসায় ঠিক কত দূর এগোলাম আমরা? বুঝতে হলে শুরু করতে হবে গোড়া থেকে।
ক্যানসার আসলে ‘একটি’ রোগ নয়; বরং বলা যায়, একই ধরনের ভিন্ন ভিন্ন রোগ। দেহের কোনো কোষগুচ্ছ যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে, তখন তাকে বলা হয় ক্যানসার। শুরুতে ক্যানসার একটি নির্দিষ্ট অঙ্গের নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে যেতে পারে। এ ছড়িয়ে যাওয়াকে বিভিন্ন ক্যানসার স্টেজ বা পর্যায়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে এর চিকিৎসাও হয় ভিন্ন ভিন্ন।
ক্যানসার হতে পারে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে। চিকিৎসকেরা ক্যানসারকে আক্রান্ত অঙ্গের নামে অভিহিত করেন। যেমন স্তন ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার কিংবা মলদ্বারের ক্যানসার। কিন্তু ক্যানসারের বৈচিত্র্য এখানেই শেষ নয়। ক্যানসারের কোষগুলোর যে অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন, তা হয় কোষের ডিএনএর মিউটেশনের কারণে। কোন জিনে এই মিউটেশন হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে ক্যানসারের স্বভাব কেমন হবে। একই অঙ্গের ক্যানসারের কারণ হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মিউটেশন। আবার একই মিউটেশনের কারণে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে ক্যানসার হতে পারে। এর চিকিৎসা তাই ক্যানসার কোন অঙ্গের ও কোন মিউটেশনের কারণে হয়েছে, এসবের ওপর নির্ভর করে।
ক্যানসারের কোষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের সময় দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেমও বসে থাকে না। যে ক্যানসারের কোষে মিউটেশন যত বেশি, সে কোষ তত বেশি নতুন ও অদ্ভুত প্রোটিন তৈরি করতে থাকে। এ প্রোটিন দেখে দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্যানসারের কোষকে চিনতে পারে এবং ধ্বংস করে ফেলে। তাই ক্যানসারের কোষগুলো নিজেদের রক্ষা করতে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে। এর একটি হলো পিডিএল-১ প্রোটিন তৈরি। এটি টি সেলের পিডি-১–এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে টি সেল নিষ্ক্রিয় করে ফেলে, থামিয়ে দেয় দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কার্যক্রম। বলে রাখা প্রয়োজন, টি সেল একধরনের লিম্ফোসাইট, অর্থাৎ দানাবিহীন শ্বেতকণিকা। দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এখন বিষয় হলো, পিডি-১ ব্লকার নামের একধরনের ওষুধ আছে। পিডি-১ প্রোটিনের ওপর কাজ করে এ ওষুধ, একে ক্যানসারের কোষের পিডিএল-১–এর সঙ্গে যুক্ত হতে বাধা দেয়। তখন দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আর বাধার মুখে পড়তে হয় না। অর্থাৎ ক্যানসারের কোষ চিনতে কোনো সমস্যা হয় না এর।
এ ধারণা কাজে লাগিয়ে ২০১৭ সালে ডা. লুইস এ ডিয়াজ জুনিয়র মলদ্বারের ক্যানসারের ওপর একটি গবেষণা চালান। গবেষণাটি চালানো হয় মেটাস্ট্যাটিক ক্যানসার, অর্থাৎ এক অঙ্গ থেকে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে যাওয়া ক্যানসারের ওপর। এই ক্যানসারের কোষগুলো আবার নিজেদের মিউটেশন ঠিকমতো করতে পারে না। ফলে তারা প্রচুর পরিমাণে নতুন ধরনের অদ্ভুত সব প্রোটিন উৎপন্ন করে। দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কাছে সহজেই ধরা পড়ে যায় এসব প্রোটিন। গবেষণাটিতে দেখা যায়, ২১ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন এবং ৫৩ শতাংশ রোগীর টিউমার আগের চেয়ে ছোট হয়ে এসেছে।
ডা. ডিয়াজ তখন ডা. আন্দ্রেয়া সার্সেকের সঙ্গে নতুন একটি গবেষণার পরিকল্পনা করেন। তাঁরা ভাবলেন, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার আগেই যদি পিডি-১ ব্লকার ব্যবহার করা যায়, তাহলে হয়তো আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে। তবে সে জন্য লাগবে বড় অঙ্কের অর্থ। অর্থাৎ বড় কোনো ওষুধ বা জৈবপ্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। কিন্তু প্রচলিত কোনো চিকিৎসাপদ্ধতিতে চেষ্টা করার আগেই একদম নতুন উপায়ে পিডি-১ ব্লকার ব্যবহার করে ক্যানসার চিকিৎসার ঝুঁকি নিতে কোনো প্রতিষ্ঠানই রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে টেসারো নামের ছোট একটি বায়োটেকনোলজি ফার্ম এ গবেষণার পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হয়। পরে টেসারোকে অধিগ্রহণ করে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন নামের এক ব্রিটিশ ওষুধ ও জৈবপ্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তারা এ পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যায়।
এ গবেষণায় শুধু সেসব রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাঁদের ক্যানসার আকারে বড় হলেও মলদ্বার থেকে অন্য কোনো অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েনি এবং ক্যানসারের কোষগুলো তাদের মিউটেশন নিজে নিজে ঠিক করতে পারে না। এ ছাড়া আরও শর্ত ছিল, রোগী এর আগে ক্যানসারের প্রচলিত চিকিৎসা, অর্থাৎ কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন কিংবা অন্য কোনো ধরনের ইমিউনোথেরাপি গ্রহণ করতে পারবেন না। এসব শর্ত মেনে মাত্র ১৬ জন রোগীকে এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই বছর।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত রোগীরা তিন সপ্তাহ পরপর ৬ মাসে মোট ৮ বার শিরায় ৫০০ মিলিগ্রাম করে ডস্টারলিম্যাব নামের একটি পিডি-১ ব্লকার গ্রহণ করেন। প্রতি ডোজ ডস্টারলিম্যাবের দাম প্রায় ১১ হাজার ডলার। অর্থাৎ ১০ লাখ টাকার বেশি। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত রোগীদের প্রতি চার মাসে একবার পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা হয়।
মূল পরিকল্পনা ছিল, এ ওষুধ গ্রহণের পরও যাদের ক্যানসার রয়ে যাবে, তাঁরা কেমোরেডিও থেরাপি এবং সার্জারির সাহায্য নেবেন। কিন্তু ১৬ জনের মধ্যে যে ১২ জনের ছয় মাসে সব ডোজ নেওয়া শেষ হয়েছে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা—এমআরআই, এন্ডোস্কপি ও ডিজিটাল রেক্টাল এক্সামিনেশন করে দেখা গেল, তাঁদের দেহে ক্যানসারের কোনো চিহ্ন নেই। রোগীভেদে ৬ থেকে ২৫ মাস পর্যবেক্ষণের পরও তাঁদের ক্যানসার ফিরে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তাই তাঁদের আর বিকল্প কোনো চিকিৎসা নিতে হয়নি।
বাকি চারজনের এখনো ওষুধের ছয় মাসের সব ডোজ নেওয়া শেষ হয়নি। তবে তাঁদেরও ক্যানসার আকারে ছোট হতে হতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
ডস্টারলিম্যাব গ্রহণের পরে রোগীদের র৵াশ, চুলকানি, অবসাদ, বমি বমি ভাবের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার মতো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
মলদ্বারের এ বিশেষ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মলদ্বারের ক্যানসারে আক্রান্ত মোট রোগীর ৫ থেকে ১০ শতাংশ। তবে ডা. সার্সেক আশাবাদী, এ চিকিৎসাপদ্ধতি বিশেষ এ ক্যানসারের পাশাপাশি অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী বা প্রোস্টেটের একই ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা সম্ভব হবে। ফলে শুধু ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমেই এ ক্যানসারগুলো হয়তো ভবিষ্যতে নিরাময় করা যাবে।
সার্জারি, কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন ব্যবহার করে ক্যানসারের চিকিৎসা নেওয়া রোগীর জন্য একদিকে যেমন কষ্টকর, তেমনি রোগীর জীবনে দীর্ঘ সময়ের জন্য এর প্রভাব থেকে যায়। মলদ্বারে ক্যানসার রোগীর একটি বড় অংশই নারী। প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি তাঁদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে। তা ছাড়া বর্তমানে কম বয়সে মলদ্বারের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডা. সার্সেক জানান, সব মিলিয়ে তাই এ অবস্থায় ক্যানসারের ওষুধভিত্তিক চিকিৎসা শুরু করা খুবই প্রয়োজন।
দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর সম্পাদকীয়তে ডা. হ্যানা সানোফ বলেন, এই গবেষণার ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এখনই প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতির পরিবর্তে এর ব্যবহার সম্ভব নয়। অন্যদিকে আমেরিকান সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি আমন্ত্রিত আলোচক কিমি অং বলেন, এ গবেষণার পরিসর অনেক ছোট আর রোগীদের পর্যবেক্ষণেও রাখা হয়েছে খুব অল্প সময়। তা ছাড়া সব রোগীর চিকিৎসা হয়েছে মাত্র একটি হাসপাতালে। এ গবেষণা ফলপ্রসূ করার জন্য আরও বেশি রোগীকে এই চিকিৎসা দিয়ে তাঁদের আরও দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন।
ডা. সার্সেক ও ডা. ডিয়াজ মোট ৩০ জন রোগীর ওপর ডস্টারলিম্যাব প্রয়োগ করা পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে যেতে চান। একই সঙ্গে তাঁরা পর্যবেক্ষণ করবেন কোনো রোগীর ক্যানসার আবার ফিরে এলো কি না। তাঁরা আশাবাদী, শিগগিরই ডস্টারলিম্যাব মলদ্বারের ক্যানসারের চিকিৎসায় গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে সমাদৃত হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, আমেরিকান সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস