দৈনিক কতটুকু পানি খেতে হবে?

পানির অপর নাম জীবন। কারণ পানি ছাড়া মানুষসহ কোন জীবের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সুখী ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য পানির ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু আমাদের দৈনিক আসলে কতটুকু পানি পান প্রয়োজন?

পানি নিয়ে একটি জনপ্রিয় ধারণা প্রচলিত আছে—প্রতিদিন পানি পান করতে হবে ৮×৮ নিয়ম মেনে । অর্থাৎ, প্রতিদিন ৮ গ্লাস পানি খেতে হবে। প্রতি গ্লাসে কমপক্ষে ৮ আউন্স পানি থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন ওঠে, আউন্স কী? চলুন, পুরো ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।

ভর ও আয়তন পরিমাপের একটি বিশেষ একক আউন্স। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে আউন্সের ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন আর এর ব্যবহার দেখা যায় না। কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে, ১ আউন্স প্রায় ২৮.৩৫ গ্রাম তরলের সমান। আর তরল পদার্থের ক্ষেত্রে, ১ আউন্স মানে ২৮.৪৩ ঘন সেন্টিমিটার। অর্থাৎ, প্রতিদিন ৮ আউন্স করে ৮ গ্লাস পানি পান করলে মোট ৬৪ আউন্স পানি করতে হবে। ৬৪ আউন্স প্রায় ১.৮৯ লিটার সমান। তার মানে, প্রতিদিন পান করতে হবে প্রায় ২ লিটার পানি।

এখন কথা হলো, প্রতিদিন কি আসলেই আমাদের ২ লিটার পানি পান করার প্রয়োজন আছে? এ ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে? বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে ওপরের ধারণাটি ভুল। কারণ আমরা প্রতিদিন যে স্বাভাবিক খাবার খাই, সেই খাবারেই অনেক তরল থাকে। এই তরল আমাদের দৈনিক পানির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করে। এছাড়া আমরা প্রতিদিন কিছু না কিছু তরল জাতীয় খাবার খাই। যেমন, দুধ, চা বা কফি, ফলের জুস ইত্যাদি। এগুলোও আমাদের পানির চাহিদা অনেকাংশে মেটায়।

আবার ব্যক্তিভেদে পানির চাহিদা ভিন্ন হয়। যে ব্যক্তি সারাদিন রোদের মধ্যে মাঠে কাজ করে তাঁর যতটুকু পানির প্রয়োজন হবে, এসির মধ্যে কাজ করা কোন কর্মীর তাঁর চেয়ে পানি কম লাগবে। নেদারল্যান্ডসের একটি শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল জার্নাল টাইডশ্রেফট ভো জিনিসকুন্দে (Tijdschrift voor Geneeskunde) জানিয়েছে, শরীরে তরলের ভারসাম্য রাখে কিডনি ও একটি হরমোন। এই হরমোনের নাম ভ্যাসোপ্রেসিন।

একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মিলিলিটার প্রসব করে। এই চাহিদা পূরণ করতে তাঁকে দৈনিক ২ হাজার থেকে ৩ হাজার মিলিলিটার তরল খাবার খেতে হয়। একটি বিষয় খেয়াল রাখবেন। এখানে কিন্তু বলা হয়েছে তরল, পানি নয়। সুতরাং প্রতিদিন ২ বা ৩ হাজার মিলিলিটার শুধু পানিই পান করতে বলা হয়নি, বরং এই পরিমাণ তরল আপনাকে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় যে খাদ্য থাকে সেখান থেকেই অনেকাংশ তরলের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।

অত্যাধিক পানি পান করা শরীরের জন্য ঝুঁকি। যদিও দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান করলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। জার্নাল অব ক্লিনিকাল প্যাথলজি-এর একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পানি পান করলে বমি বমি ভাব হতে পারে। এমনকি বমিও হতে পারে। আবার শরীরে খুব বেশি পরিমাণে পানি থাকলে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যেতে পারে। ফলে দেখা দিতে পারে হাইপোনাট্রেমিয়া। এতে কোমায় যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এমনকি চিকিৎসা না করালে মৃত্যুও হতে পারে।

পানি শরীরের জন্য অতাধিক গুরুত্বপূর্ণ এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু একজন মানুষের দৈনিক কতটুকু পানি পান করা দরকার সে ব্যাপারে আমাদের অবগত থাকা উচিৎ। তবে সবার জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা সমান নয়। ব্যক্তিভেদে জীবনযাত্রার মানের ওপর পানির প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করে।

আমাদের মধ্যে প্রচলিত একটি ধারণা আছে, ঘন ঘন তৃষ্ণার্ত হলে বুঝতে হবে ডিহাইড্রেশন হয়েছে। আমেরিকান জার্নাল অব ফিজিওলজি-এর এক আর্টিকেলে বলা হয়েছে, তাঁরা এই প্রচলিত মিথের সঙ্গে একমত নয়। কারণ তৃষ্ণার্ত হওয়া মানে প্রথমত ডিহাইড্রেশন রোধ করা। কিন্তু তৃষ্ণার্ত হলে সেটা উপেক্ষা না করে হালকা পানি বা তরল জাতীয় কিছু পান করা উচিৎ।

আমেরিকান জার্নাল অব ফিজিওলজি আরও ব্যাখা করেছে, বাসায় প্রস্রাবের রঙ দেখে ডিহাইড্রেশনের মাত্রা বিচার করার একটি ভালো উপায় হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিভেদে এটা পরিবর্তন হয়। প্রতিদিন কী পরিমাণ এবং কতবার প্রস্রাব হচ্ছে, তার ওপরেও নির্ভর করে প্রস্রাবের রং। সুতরাং প্রস্রাব গাঢ় হওয়ার মানেই ডিহাইড্রেশন নয়। প্রস্রাবের বেগ বেশি হলে তা গাঢ়ও হতে পারে। যেমন সাধারণত সকালে প্রসব গাঢ় থাকে। কারণেই সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের পানি পান করতে ইচ্ছে হয়। সুতরাং, বাসায় আপনি নিজের প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কিন্তু সেজন্য দৌড়ে ল্যাবে প্রসব পরীক্ষা করার দরকার নেই।

খাদ্যের সঙ্গে পানির সম্পর্ক

পানির অন্যতম উৎস খাদ্য। সারাদিন আমরা যে খাবার খাই তার মধ্যে থাকে পানি। ফলমূল ও শাকসবজিতে পানির পরিমাণ আরও বেশি থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, তরমুজ ও স্ট্রবেরিতে শতকরা ৯০ শতাংশ পানি থাকে। ২০০৪ সালে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স একটি প্রতিবেদনে বলেছে, উত্তর আমেরিকার মানুষ প্রতিদিন যে খাবার খায় তার মধ্যে ২০ শতাংশ পানি থাকে। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

এছাড়া প্রতিদিন আমরা চা, দুধ, কফি ও ফলের রস পান করি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কফি আমাদের শরীরকে ডিহাইড্রেট করে না। বরং কফি পানের মাধ্যমে শরীরের পানির অভাব দূর হয়। তবে বেশি মাত্রায় কফি পান করা উচিৎ নয়। কফিতে থাকে ক্যাফেইন। এর ফলে আপনার মাথা ব্যথা এবং ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে।

সুতারং প্রতিদিন আপনি যে খাবার এবং অন্যান্য তরল গ্রহণ করেন, তার মধ্যে কতটুকু পানি আছে তা আমাদের জেনে নেওয়া উচিৎ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমিকস অব সায়েন্স পরামর্শ দিয়েছে, মহিলাদের প্রতিদিন খাবারে থাকা তরল ও পানি মিলিয়ে ২.৭ লিটার পানি গ্রহণ করা উচিৎ। পুরুষদের ক্ষেত্রে দৈনিক ৩.৭ লিটার। তবে এটা শুধু সাধারণ পরামর্শ মাত্র। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে পাওয়া কোন ফল নয়।

আসল কথা হলো, পানি পানের নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই। প্রত্যেকের বয়স, স্বাস্থ্য, ওজন ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে পানি পান করতে হবে। এছাড়া শরীর বেশি ঘামলে পানি খেতে হবে বেশি। অর্থাৎ, গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার মানুষ শীতার্ত এলাকার মানুষের চেয়ে বেশি পানি পান করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স