২০১১ সালে এক দল গবেষক একটি সুগার বিটের শেকড়ে ৩৩ হাজারেরও বেশি ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়া প্রজাতি শনাক্ত করেছেন।
ছোট বেলা থেকেই আমরা জেনে এসেছি, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ জল, বাকি এক ভাগ স্থল। আরও সহজ করে বললে, পৃথিবীর ওপরিভাগের প্রায় ৭১ শতাংশ পানিতে নিমজ্জিত, আর অবশিষ্ট ২৯ শতাংশ স্থলভাগ। এই স্থলভাগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাটি, যা মূলত পৃথিবীর ওপরিভাগের নরম আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট খনিজ পদার্থ এবং জৈব যৌগ একসঙ্গে মিশে গঠিত হয় মাটি। রাশিয়ান বিজ্ঞানী ডকুশেভকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তাঁর মতে, ভূত্বক, জলস্তর, বায়ুস্তর এবং জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে ভূমিক্ষয়, আবহাওয়ার পরিবর্তন, বিচূর্ণিভবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাথর থেকে মাটির উদ্ভব।
মাটি প্রধানত খনিজ (৪৫%), জৈব পদার্থ (৫%), বায়ু (২৫%) ও পানি (২৫%)—এই ৪টি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। মাটিতে থাকা জৈব পদার্থগুলো সব ধরনের পুষ্টি উপাদানের গুদাম ঘর হিসেবে কাজ করে। যেমন অণুজীবের প্রধান শক্তি ও মাটিতে নাইট্রোজেনের প্রধান উৎস এই জৈব পদার্থ। মাটিতে বসবাসকারী লাখ লাখ জীব ও উদ্ভিদ মাটিতে থাকা জৈব পদার্থ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। তাই গুরুত্বের দিক দিয়ে জৈব পদার্থকে বলা হয় মাটির প্রাণ।
মাটির জৈব পদার্থের প্রধান উপাদান কার্বন। এটি মাটির জল-ধারণ ক্ষমতা ও এর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। করে তোলে উর্বর। মাটি প্রাকৃতিকভাবেই কার্বন সংরক্ষণের আধার। এতে পৃথিবীর প্রায় ২ হাজার ৫০০ গিগাটন কার্বন সংরক্ষিত আছে। অবাক করা বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বায়ুমণ্ডলের কার্বনের তিনগুণ আর জীবিত সব গাছপালা ও প্রাণীর মধ্যে সঞ্চিত পরিমাণের চেয়ে মাটি প্রায় চারগুণ বেশি কার্বন সংরক্ষণ করে। তাই মুক্ত কার্বন সংরক্ষণাগার হিসেবে মাটি হলো জলবায়ু যুদ্ধের নতুন অস্ত্র।
এটি পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আবাসস্থল। মাটির অভ্যন্তরে আছে অণুজীবের এক অজানা রাজ্য। গবেষণার মাধ্যমে এই অজানা রাজ্যের অল্প কিছুটা মানুষ জানতে পেরেছে। অবাক করা বিষয় হলো, এক গ্রাম মাটিতে থাকে প্রায় ৫০ হাজার অণুজীব প্রজাতি। ২০১১ সালে এক দল গবেষক একটি সুগার বিটের শেকড়ে ৩৩ হাজারেরও বেশি ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়া প্রজাতি শনাক্ত করেছেন। তা ছাড়া উদ্ভিদের মূলজ কোষ এবং এর আশেপাশের প্রতি গ্রাম মাটিতে ১০ বিলিয়নের মতো ব্যাকটেরিয়া বাস করতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এক চামচ মাটিতে অণুজীবের সংখ্যা পৃথিবীতে মোট মানুষের চেয়ে বেশি।
এই ক্ষুদ্র অণুজীবগুলো অনেক বড় বড় কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। মাটিতে থাকা অণুজীবগুলো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যাক্টিনোমাইসিটিস, শৈবাল ও প্রোটোজোয়া শ্রেণির। উল্লেখ্য, মাটিতে ছত্রাকের চেয়ে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। এদের প্রত্যেকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এসব বৈশিষ্ট্য থেকে তাদের আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। আর, এসব বৈশিষ্ট্য-ই নির্ধারণ করে দেয় মাটিতে তাদের কার্যকারিতা।
যেকোনো উদ্ভিদের শেকড়ের চারপাশে অবস্থিত মাটির অঞ্চলটুকুর জৈবিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য শেকড় দিয়ে প্রভাবিত হয়। ওই অঞ্চলটিকে বলে রাইজোস্ফিয়ার। এ অঞ্চলে নাইট্রোজেন সংবদ্ধনকারী ব্যাকটেরিয়াসহ নানা প্রজাতির অণুজীবের আধিক্য বেশি দেখা যায়। যেমন রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া, যা পরিবেশের মুক্ত নাইট্রোজেন সংবদ্ধন করে। উদ্ভিদের জন্য ফসফেট সহজলভ্যকারক হিসেবেও কাজ করে এরা। দলগতভাবে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো জৈবসার উৎপাদন করে। ফলে, এক দিকে বৃদ্ধি পায় মাটির সামগ্রিক উর্বরতা। অন্যদিকে, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে আসে। এর মাধ্যমে এরা পরিবেশ দূষণ রোধে ভূমিকা রাখে।
এক গ্রাম মাটিতে থাকে প্রায় ৫০ হাজার অণুজীব প্রজাতি
মাটিতে থাকা সায়ানোব্যাকটেরিয়াগুলো মূলত সালোকসংশ্লেষক। মানে, এরা নিজেদের জন্য পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করতে পারে। সঙ্গে উপজাত হিসেবে উৎপন্ন হয় অক্সিজেন। যা পরিবেশে অক্সিজেনের গৌণ উৎস হিসেবে কাজ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ বিক্রিয়া অক্সিজেনের প্রধান প্রাকৃতিক উৎস।
অ্যাকটিনোমাইসিটিস নামে মাটিতে বসবাসকারী এক ধরনের অণুজীব আছে। এদের কাছ থেকে জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন স্ট্রেপটোমাইসিন, নিওমাইসিন, ইরিথ্রোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন ইত্যাদি পাওয়া যায়। স্পোর তৈরি করে বলে ছত্রাকের সঙ্গে এদের দারুণ মিল। তবে প্রাককেন্দ্রিক কোষ হওয়ায় এরা এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া। অ্যাকটিনোমাইসিটিস-নিঃসৃত অ্যান্টিবায়োটিক মাটিতে অবস্থানকারী অন্য অণুজীব নিয়ন্তণ করে অণুজীবের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া বিভিন্ন জৈব সার, যেমন সবুজ সার, গোবর, কম্পোস্ট ইত্যাদি তৈরির সময় এরা উচ্চতাপমাত্রায় জৈবযৌগের পরিবর্তন ঘটায়।
মাটিতে থাকা ছত্রাক অন্যান্য বড় জীব ও অণুজীবের খাদ্যের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি গাছপালা, মাটির উপকারী অণুজীব বা অন্যান্য বড় জীবের সঙ্গে এদের রয়েছে মিথোজীবী সম্পর্ক। এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সকালের নাস্তায় আমরা যে পাউরুটি খাই, এটা তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় ‘ইস্ট’ নামে এক ধরনের ছত্রাক। আবার ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ হওয়ায় ট্যাবলেট হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। জনপ্রিয় খাবার ‘মাশরুম’ মূলত অ্যাগারিকাস নামে এক প্রকার ছত্রাক প্রজাতি। পেনিসিলিন নামে যে মূল্যবান ওষুধ আছে, এটাও পেনিসিলিয়াম ক্রাইসোজেনাম নামে এক ধরনের ছত্রাক থেকে তৈরি হয়। তা ছাড়া, ছত্রাক মাটিতে থাকা ময়লা-আবর্জনা পঁচিয়ে পরিবেশকে সুস্থ ও পরিষ্কার রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
আমরা মাটি থেকে উৎপাদিত ফুল, ফল, ফসল খেয়ে বেঁচে থাকি, বেড়ে উঠি। উর্বর মাটি বেশি খাদ্য উৎপাদন করে, জীববৈচিত্র্যকে উন্নত করে, ভালোভাবে ধরে রাখে আর্দ্রতা। তাছাড়া মাটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মরুকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও পরিবেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। মাটিতে সংরক্ষিত প্রচুর কার্বন ও মাটিস্থ অণুজীব থেকে প্রাপ্ত দ্রবীভূত অ্যান্টিবায়োটিক পরিশুদ্ধ করে পানিকে। আর মাটিতে বসবাসকারী অণুজীব উদ্ভিদের শেকড় ব্যবস্থাকে করে তোলে উন্নত, যা তাদের খরা ও কীটপতঙ্গ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়। মাটি ও মাটিতে থাকা অণুজীবদের অজানা রহস্যভেদ করতে তাই অব্যহত রাখতে হবে নিত্য নতুন গবেষণা।
আবার, অতিরিক্ত নগরায়ন, মাটি দূষণ, মাটিতে অত্যাধিক চাষাবাদ প্রকৃতিতে কার্বন মুক্ত করে। এতে মাটিতে জৈব পদার্থ কমে উর্বরতা নষ্ট হয়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় মাটিতে থাকা অণুজীব। অধিক চাষাবাদে মাটির কার্বন অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে ও জারণ বিক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নামের গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপন্ন করে। এতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর।
সব মিলে বলা যায়, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে মাটি ও মাটিতে থাকা অণুজীব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। তাই উজ্জ্বল আগামীর জন্য মাটি দূষণ প্রতিরোধ ও মাটিতে থাকা অণুজীবদের প্রতি আমাদের যত্নশীল হতে হবে।
লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি বিভাগ, এনআইবি