সাক্ষাৎকার

শেখার কোনো শর্টকাট পথ নেই—উপমা গুহ, ডেন্টিস্ট ও গবেষক

উপমা গুহ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা মেডিকেল সেন্টার (ইউএনএমসি) কলেজ অব ডেন্টিস্ট্রির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। ২০১৫ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ইউএনএমসি কলেজ অব ডেন্টিস্ট্রির ক্লিনিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

উপমা গুহ ডেন্টাল ম্যাটেরিয়াল, ডিজিটাল ডেন্টিস্ট্রি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইন ডেন্টিস্ট্রি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি ডেন্টাল ডিগ্রি নিয়েছেন বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ থেকে। মাস্টার্স করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার চ্যাপেল হিল অ্যাডামস স্কুল অব ডেন্টিস্ট্রি থেকে।

সম্প্রতি এই গবেষক এসেছিলেন বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে। এ সময় তাঁর সাক্ষাৎকার নেন বিজ্ঞানচিন্তার

নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ

ছবি তুলেছেন জাহিদ হোসেন সেলিম

বিজ্ঞানচিন্তা:

কত বছর পর বাংলাদেশে এলেন? 

উপমা গুহ: প্রায় ছয় বছর। 

বিজ্ঞানচিন্তা:

এবার দেশের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?

উপমা গুহ: অনেক পরিবর্তন। আগে ঢাকায় নামার পর এয়ারপোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত বিশাল জ্যাম থাকত। এবার তেমন জ্যামে পড়িনি। রাস্তাঘাটও খুব সুন্দর। চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে সুন্দর রাস্তা হয়েছে। ফলে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যে শুনতাম, দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, তা এবার দেখলাম। মেট্রোরেলে অবশ্য এখনো চড়া হয়নি। তবে দেখেছি। খুব ভালো লাগল এগুলো দেখে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

পেশা হিসেবে ডেন্টিস্ট্রি বেছে নিলেন কেন?

উপমা গুহ: আমার গল্পটা খুব মজার। তার আগে বলি, আমি যেহেতু পড়াই, তাই শিক্ষার্থীরা আমার কাছে প্রথমে এলে আমি ওদের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই, ওরা কেন আমার কাছে এসেছে পড়তে। ওদের বুঝতে চাই।

আমি সম্ভবত কোনো দিন আর কিছু হতে চাইনি। সব সময় ডেন্টিস্টই হতে চেয়েছি। আর দেখুন, ছোটবেলা থেকে কেউ কিছু চিন্তা করে ভবিষ্যতে সেটা হতে পারা কিন্তু দারুণ ব্যাপার। বাবা চাইতেন, আমি ডেন্টিস্ট হই। কারণ, উনি খুব ভালো ডেন্টিস্ট কোথাও খুঁজে পেতেন না। ফলে ওনার মাথায় ছিল যে তিন মেয়ের কাউকে বা সবাইকে ডেন্টিস্ট বানাবেন। যদিও আমার বোনেরা কেউ এই পেশা পছন্দ করত বলে মনে হয় না। আমার যেকোনো রকমের হেলথ সায়েন্স খুব ভালো লাগত। দেখলাম, ডেন্টিস্ট্রিতে সায়েন্স ও আর্টের খুব সুন্দর একটা যোগাযোগ আছে। এখানে কিছুটা ইঞ্জিনিয়ারিংও আছে। ফলে আমার কোনোভাবে পেশাটা খুব পছন্দ হয়ে যায়।

ছোটবেলায় আমার যে ডেন্টিস্ট ছিলেন, তিনি ছিলেন ঢাকা ডেন্টালের প্রিন্সিপাল, ডক্টর জাকির হোসেন। উনি এত ভালো ডেন্টিস্ট ছিলেন যে আমার ওনাকে দেখে মনে হয়েছিল, হ্যাঁ, আমিও এমন হতে পারি। এ ছাড়া ছোটবেলায় তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতে আমার এক বন্ধু অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। তখন ওকে আমি চিঠি লিখতাম। প্রতি দুই মাসে একটা চিঠি। ওর ইচ্ছা ছিল ডেন্টিস্ট হবে। ফলে আমরা দুজনে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতাম। তাই আমি বলব, তিনটি জিনিস আমাকে ডেন্টিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে—বাবা, ডেন্টিস্ট জাকির হোসেন ও আমার বন্ধু।

আমার শিক্ষার্থীদের এই প্রশ্ন করলে ওদের কাছে শৈশবে ভালো ডেন্টিস্টের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা বেশি শুনতে পাই। মানে, প্রায় সবার মধ্যে এটা কমন। আমারও মনে পড়ে না যে আমি কখনো ডেন্টিস্ট ছাড়া আর কিছু হতে চেয়েছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

একটা প্রবাদ আছে, ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই’। এই পেশায় থেকে আপনার এ ব্যাপারে কী মনে হয়?

উপমা গুহ: একদম ঠিক কথা। এটা শুধু বাঙালি নয়, সব দেশের সবার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু অনেক দেশ আছে, সেসব দেশের মানুষ দাঁত থাকতেই দাঁতের মর্ম বোঝেন। বলা হয়, দাঁতের ব্যথা বিশ্বের দ্বিতীয় যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা। প্রথমটা মায়েদের সন্তান প্রসবের ব্যথা। আমাদের দাঁতের সবচেয়ে বাইরের যে গঠন, একে ‘অ্যানামেল’ বলি আমরা, ওটার মধ্যে অনুভব করার জন্য কোনো স্নায়ু নেই। এটা মানবদেহের সবচেয়ে শক্ত অঙ্গ। হাড়ের চেয়ে শক্ত। একটা দাঁতের অ্যানামেল ক্ষয় হতে সাত-আট বছর লেগে যায়। কিন্তু তারপরও মানুষ বুঝতে পারেন না, তাঁর একটা সমস্যা হচ্ছে। পরে যখন ব্যথা শুরু হয়, তখন ডাক্তারের কাছে যান। কিন্তু এটা তো এক দিনে হয়নি। বহুদিন ধরে ক্ষয় হয়ে এই অবস্থায় এসেছে।

আরেকটা ব্যাপার বলি। আমাদের দেশে কোনো আর্টিস্টকে একজন দাদি বা নানির ছবি আঁকতে বললে তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন ফোকলা দাঁতের দাদি বা নানি আঁকবেন। কারণ, আমরা ভাবি, ৭০ বছর বয়সে একজনের চার-পাঁচটি বা সব কটি দাঁত পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে যদি বলি, এটা ঠিক নয়। আপনি দাঁতের সামান্য যত্ন নিলে ৭০-৮০ বছর বয়সেও দাঁত পড়বে না। আমাদের দেশে দাঁতের যত্ন করা হয় না বলেই বৃদ্ধ ব্যক্তিদের দাঁত থাকে না। 

বিজ্ঞানচিন্তা:

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যথা বললেন, তাই জানতে চাই, দাঁতের ব্যথা পরিমাপের কি কোনো একক আছে?

উপমা গুহ: না, কোনো একক নেই। কিন্তু ব্যথার একটা লেভেল (মাত্রা) থাকে। আমরা রোগীদের তাঁদের ব্যথার ব্যাপারে বলতে বলি। তাঁরা নিজেরাই বলেন। বলার সময় কোন কোন শব্দ বলছেন, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমরা ব্যথার লেভেল বুঝতে পারি। আবার কেউ কোনো শব্দ না বললে বা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হলে তাঁকে গাইড করি বা জিজ্ঞেস করি। যেমন কেউ যদি বলেন তিনি ঘুমাতে পারছেন না, ব্যথার কারণে সারা রাত জেগে থাকেন, ওটাকে বুঝব একরকমের ব্যথা। আবার কেউ যদি বলেন, তাঁর শুধু পানি খাওয়ার সময় ব্যথা হয়, তাহলে বুঝতে হবে, এটা তুলনামূলক কম ব্যথা। এভাবে বোঝা যায়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

সম্প্রতি আপনি এআই নিয়ে কাজ করেছেন। আপনার কাজের কথা বলুন।

উপমা গুহ: বাংলাদেশেও অনেকে এআই নিয়ে কথা বলছেন, কাজ চলছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এটা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নয়, বর্তমান। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে সব জায়গায় এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। আমার গবেষণার মূল চিন্তা হলো এআইকে সাহায্যকারী হিসেবে ব্যবহার করা। আমরা রোগীদের এক্স-রে করি। সেগুলো এত দিন মানুষ পর্যবেক্ষণ করতেন। কিন্তু এই ডেটা পর্যবেক্ষণের কাজটা আমি এআই দিয়ে আরও দ্রুত করতে পারি। শেষে অবশ্যই একজন মানুষ তা আবার বিশ্লেষণ করে দেখবেন, সব ঠিক আছে কি না; অর্থাৎ অবশ্যই সেটা আমাকে আবার চেক করতে হবে।

এআই দিয়ে এখন আমরা আরও একটা কাজ করি। ধরুন, একজন রোগী প্রথমবার আমাদের কাছে এলেন। তখন আমরা তাঁর দাঁত, মাড়ি ও গামের হেলথ (স্বাস্থ্য) দেখি। এই হেলথ দেখার জন্য মাড়ির সঙ্গে দাঁতের একটা জয়েন্ট (জোড়া) থাকে সাধারণভাবে। কিন্তু মাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে দাঁতের সঙ্গে মাড়ির একটা গ্যাপ (ফাঁকা) তৈরি হয়। ওই গ্যাপ কতটুকু বা কতটা গভীর, তা পরীক্ষা করে দেখতে হয়। এটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রতিটি দাঁতের গোড়ায় গিয়ে একটু একটু করে পরীক্ষা করতে হয়। এখানে আমরা এআই ব্যবহার করি। আপনি দেখে দেখে গ্যাপ কতটুকু তা বলবেন এবং এআই তা নোট করবে। পরে আপনি শুধু চেক করবেন। এআই এটা খুব কম সময়ে ছক আকারে তৈরি করে দেয়। তবে আমরা কিন্তু পরে তা আবার পরীক্ষা করে দেখি যে এটা ঠিক আছে কি না। ভবিষ্যতে হয়তো রোবটের সাহায্যেই এ চিকিৎসা সম্পূর্ণভাবে করা যাবে। এমনও হতে পারে যে আমি হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশি কারও দাঁতের চিকিৎসা করলাম একটা রোবোটিক আর্মের মাধ্যমে। ভবিষ্যতে এমনটা হবে বলে আশা করি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এ ছাড়া আলাদাভাবে এআই নিয়ে কোনো গবেষণা করছেন?

উপমা গুহ: আমার বর্তমান গবেষণা হচ্ছে এআই কাজটা কতটা সঠিকভাবে করতে পারে, তা পরীক্ষা করা। এখনো কিন্তু এআই নতুন, শিখছে। ফলে আমি বোঝার চেষ্টা করছি, এআই এখন যে রেজাল্ট (ফলাফল) আমাদের দিচ্ছে, তা কতটা সঠিক। দেখুন, এআইকে তো যে কেউ প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এবং ওটা সেভাবেই শিখছে। ফলে আমাদের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, এমন রোবটকে যদি কোনো ডেন্টিস্ট প্রশিক্ষণ না দেন, তাহলে ভুল হতে পারে। তাই আমি খুঁজে দেখছি, আমাদের এআই কতটা সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। যেহেতু নতুন, তা-ই এখনো ওদের তথ্য চোখ বন্ধ করে বিশ্বাসের সময় হয়নি। আমাকে দেখতে হবে, এআইকে কী ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে, কে দিয়েছেন এবং তা কতটা সঠিক।

বিজ্ঞানচিন্তা:

চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে কি মানুষ কোনো দিন অমরত্বের স্বাদ পেতে পারে?

উপমা গুহ: আমি এখনো অমরত্বে বিশ্বাস করি না। যখন করোনা এল, তখন আমরা কেউ বুঝতে পারছিলাম না যে ওটা কী। এরপর হঠাৎ দেখলাম, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়াতে ছড়াতে বাংলাদেশে চলে এল। কয়েক দিনের মধ্যে সব বন্ধ হতে শুরু করল। কোটি কোটি মানুষ মারা গেল। আমাদের কী আক্রমণ করছে, তা বুঝতেই অনেক দিন লেগে গেল। ফলে মহামারি কোন দিক থেকে যে আসবে, তা আমরা জানি না। তাই অমরত্বের বিষয়টি আমি বিশ্বাস করি না। তবে হয়তো আর্টিফিশিয়াল হার্ট (কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড) বা এমন কৃত্রিম অঙ্গের সাহায্যে একজন মানুষকে খুব সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। বাড়ানো যাবে মানুষের আয়ু। অমরত্ব পর্যন্ত এখনো ভাবতে পারছি না।

আমরা নিজেদের যত স্মার্ট ভাবি, আসলে কি আমরা ততটা স্মার্ট? করোনার কথা চিন্তা করলে সেটা আরেকটু ভালোভাবে বুঝতে পারি। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস কিন্তু আমাদের ভাবনার চেয়ে বেশি স্মার্ট। ওরা যে কীভাবে আমাদের কখন আক্রমণ করবে, তা আগেভাগে বলা খুব মুশকিল।

আরেকটা বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় আয়ু বেশি। কারণ, তাঁরা সচেতন। এটা শুধু অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের মানুষ খুব বিপদে না পড়া পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যান না। তাঁরা অপেক্ষা করেন কখন বড় কিছু হবে, তারপর ডাক্তারের কাছে যাবেন। আমাদের নিয়মিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেকআপ করা দরকার। এটা যে প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করার মতোই সাধারণ ঘটনা, তা আমরা বুঝতে চাই না। এটাকে সাধারণভাবে দেখলে এমনিতেই গড় আয়ু বাড়বে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির চেয়ে মানুষের সচেতনতার ভূমিকা বেশি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি শিক্ষকতা করছেন। আবার ডিরেক্টর। প্রশাসনিক নানা কাজ তো থাকে। এত কিছুর পর কি রোগী দেখার সময় পান?

উপমা গুহ: হ্যাঁ এবং আমি এটা করে খুব মজা পাই। কারণ, আমার কাজের কয়েকটা ভাগ আছে। প্রথমত, ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কার মেডিকেল সেন্টারের অধীনে রয়েছে কলেজ অব ডেন্টিস্ট্রি। ক্লিনিকের ডিরেক্টর হিসেবে আমার দায়িত্ব, এখানে যত শিক্ষক আছেন, তাঁরা কোথায় কোন শিক্ষার্থীকে সুপারভাইজ করছেন, সেটা আমাকে দেখতে হয়। এটা একটা লিডারশিপ রোল। তাই আমি এটা এনজয় করি। আরেকটা দিক হচ্ছে শিক্ষকতা। একটা কোর্স আমার পড়াতে হয়। আমি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের একটা কোর্স নিই। ক্যারিওলজি পড়াই আমি। কীভাবে দাঁতে পোকা হয়, কেন হয়, কীভাবে এটা থামানো যায়, কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে—এসব বিষয় নিয়েই ক্যারিওলজি। এ ছাড়া আরেকটা টেকনিক্যাল ক্লাস নিই। মানে হাতে-কলমে শেখাতে হয় শিক্ষার্থীদের। এটা হলো দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত। তৃতীয় বর্ষে গেলে আবার আমাকে পাবে ওরা। সেখানে ওরা সরাসরি রোগীকে চিকিৎসা দেবে। এগুলোই করি আমি। এসব কাজের জন্য আমার সময় ভাগ করা আছে। সপ্তাহের কোন দিন কী কাজ করব, তা রুটিন করা আছে। পাশাপাশি রোগী দেখি আমি, সপ্তাহে দুই দিন। এটা আমার প্র্যাকটিস (রোগী দেখা)। 

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার শৈশব-কৈশোরের গল্প শুনতে চাই। কীভাবে বেড়ে উঠলেন?

উপমা গুহ: আমি কয়েকটা স্কুলে পড়েছি। ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ে উদয়ন স্কুলে ভর্তি হয়েছি। সেখান থেকে এসএসসি পাস করেছি। ইন্টার (এইচএসসি) পাস করেছি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। এরপর বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজে দাঁত নিয়ে পড়াশোনা করে আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাই।   

বিজ্ঞানচিন্তা:

আগে থেকেই অনার্স শেষ করে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, নাকি হঠাৎ চলে গেলেন?

উপমা গুহ: ২০০৯ সালে অনার্স পাস করার পর বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ, আমার তো ছোটবেলা থেকেই ডেন্টিস্ট হওয়ার স্বপ্ন। তাই দ্বিতীয় বর্ষে থাকতেই আমি জাপানি ভাষা শেখা শুরু করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে। জাপানে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, তাই জাপানি ভাষা শিখেছিলাম। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে সহজে যাওয়া যেত না ডেন্টিস্ট্রির জন্য। পাস করে আমি জাপানে যাই। কিন্তু সেখানে পড়া শেষ করিনি। কারণ, আমার হাজব্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন তখন। তাই আমিও সেখানে চলে যাই। ওখানে গিয়ে আবার রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলাম। এটা খুব কঠিন পরীক্ষা ছিল। মাত্র তিনজন ভর্তি হন প্রতিবছর এই রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে। ওদের দেশের মানুষদের আবার বেশি সুযোগ দেয়। তিন বছরের কোর্স ছিল। ২০১২ সালে আমরা তিন ক্লাসমেট শুরু করলাম। ২০১৫ সালে জয়েন করি ফ্যাকাল্টি হিসেবে। তখন শুরু করলাম ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফেলোতে। এটা ছিল আমার প্রথম চাকরি। চার বছর পড়ালাম সেখানে। সেখান থেকে ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডাতে যাই। তিন-চার বছর ছিলাম। সেখান থেকে এখন যেখানে আছি, মানে ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কায় চলে আসি। 

বিজ্ঞানচিন্তা:

ছোটবেলায় কি কখনো ভেবেছেন গবেষক বা বিজ্ঞানী হবেন? 

উপমা গুহ: ছোটবেলায় কখনো ভাবিনি। আসলে ওই বয়সে আমরা যা হতে চাই, তা না ভেবেই হতে চাই। পরে বড় হতে হতে বুঝতে পারি, ওটা আসলে কী। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ডেন্টাল স্কুলে রিসার্চ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে থাকতে তা পাইনি আমি। কিন্তু বাবাকে আমার শৈশবে জার্নাল লিখতে দেখেছি। তখন বুঝেছি যে এগুলো জার্নাল, এভাবে গবেষণাপত্র লিখতে হয়। এরপর ডেন্টাল স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বুঝতে পারলাম, পোস্টগ্র্যাজুয়েট হতে হলে আমাকে কী কী করতে হবে। সব সময় আমার কেউ না কেউ আইডল ছিলেন। আমি তাঁদের অনুসরণ করতাম। যেমন আমার ডেন্টিস্ট জাকির হোসেনের কাছে জেনেছিলাম, তিনি পিএইচডি করতে জাপানে গিয়েছিলেন। সুতরাং রিসার্চ করতে হবে—এই চিন্তা আমার এসেছে ডেন্টাল স্কুলে আসার পর।  

বিজ্ঞানচিন্তা:

গবেষক হওয়ার পেছনে কোনো বিশেষ ঘটনা ছিল? 

উপমা গুহ: হ্যাঁ। আমার শিক্ষক মাহফুজুল হক স্যার বলেছিলেন, ‘তোমাকে একটা আর্টিকেলের আইডিয়া দেব, তুমি ওটা নিয়ে কাজ করতে পারো।’ এর আগে আমি কখনো ওভাবে গবেষণা করিনি। উনি আমাকে পদ্ধতিটা বলে দিলেন। রিসার্চ পেপার পড়তে হবে, নিজের পড়াশোনা করে গবেষণাপত্র লিখতে হবে। তিনিই আমাকে মোটামুটি একটা ধারণা দিলেন, সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন কীভাবে করতে হয়। ওনার সঙ্গেই আমি প্রথম এ নিয়ে কাজ করি। আমি তখন ডেন্টাল স্কুল শেষ করেছিমাত্র। ওটাই আমার প্রথম গবেষণার কাজ। আর আমার ওই শিক্ষকের হাত ধরেই গবেষণার কাজে হাতেখড়ি হয়েছে। এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমি আমার শিক্ষককেই দেব।

আরেকটা জিনিস বলতে চাই, ছোটবেলায় আমরা কচি–কাঁচার মেলায় যেতাম। সেখানে সুফিয়া কামাল আসতেন, বক্তৃতা দিতেন। প্রফেসর আনিসুজ্জামান, আবদুল্লাহ আল–মুতী স্যার আসতেন। ফলে ছোটবেলায় বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী হয়েছি আবদুল্লাহ আল–মুতী স্যারকে দেখে। তিনি নিয়মিত আসতেন কচি–কাঁচার মেলায়। তখন এর গুরুত্ব বুঝতাম না। কিন্তু এত বড় মানুষের কাছাকাছি থেকে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছি বলে এটা হয়েছে সম্ভবত।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে বর্তমানে ডেন্টিস্ট্রি নিয়ে কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে? দেশের গবেষণার মান কেমন?

উপমা গুহ: দেশের গবেষণার মান এখন অনেক ভালো হয়েছে এবং বেড়েছে। গবেষণাগুলো মূলত পাবলিক হেলথের মধ্যে আছে। যেমন কোনো একটা রোগ আগের চেয়ে কতটা বেড়েছে। কত ভাগ রোগী একটা নির্দিষ্ট রোগ নিয়ে এসেছেন এবং কত ভাগ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, এগুলো নিয়ে গবেষণা অনেক বেড়েছে। তবে ল্যাবে রিসার্চের সংখ্যা অনেক কম। আমার ধারণা, এটার নির্দিষ্ট কারণ আছে। যেমন যন্ত্রপাতি তৈরি নেই, হয়তো অভিজ্ঞ লোকও কম। মূল কথা, আমাদের গবেষণাগুলোর বেশির ভাগ জরিপধর্মী।  

বিজ্ঞানচিন্তা:

ল্যাবভিত্তিক গবেষণা বাড়াতে হলে আমাদের কী করা উচিত? আমাদের দেশে ল্যাবভিত্তিক গবেষণা কেন জরুরি?

উপমা গুহ: ল্যাবভিত্তিক গবেষণা করতে হলে প্রথমে ভাবতে হবে, আমাদের কী কী যন্ত্রপাতি লাগবে। সেই পরিমাণ বাজেট তৈরি করতে হবে। সরকারি পর্যায় থেকে চিন্তাটা করতে হবে। যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জানা এবং সেগুলোর নৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে যেকোনো রোগীকে নিয়ে কাজ করতে হলে একটা বোর্ড আপনার আইডিয়া সম্পর্কে প্রথমে জানবে। তারা নিশ্চিত হবে, আপনার কোনো কিছুতে রোগীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না অর্থাৎ আমার কাজটা নৈতিক হবে কি না, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে দক্ষ রিসার্চার বা গবেষক থাকতে হবে। তাঁদের ঠিক জায়গায় বসাতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, নাম কামানো মূল বিষয় নয়। মূল বিষয়টা হলো রোগীর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এ জন্য ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ড থাকতে হবে। রোগীর সেফটির জন্য এ ধরনের কাজ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

আর এটা করা জরুরিও। যেমন ধরুন, কতজন মানুষের দাঁতের ক্ষয় হয়, কোন খাবারে ক্ষয় বেশি হয়, কেন হয়—এগুলো আপনি ল্যাবে কাজ করলে বুঝতে পারবেন। ল্যাবে স্যাম্পল নিয়ে কাজ না করলে আপনি নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারবেন না। হয়তো শুধু জরিপ করে বলতে পারবেন, এত ভাগ মানুষের দাঁতের ক্ষয়রোগ আছে। কিন্তু এই ক্ষয়রোগ কেন হয়, তা কিন্তু বলতে পারবেন না। এর পেছনের কারণ জানতে পারবেন না ল্যাব টেস্ট ছাড়া।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনাদের ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষার্থী যৌথভাবে কাজ করতে পারবেন কি? যদি করা যায়, তাহলে কী ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে? 

উপমা গুহ: কাজ করার মতো অনেক জায়গা আছে। ধরুন, প্রথমে ভাবতে হবে কোনো একটা রোগের কোন দেশে কী অবস্থা। ধরে নিচ্ছি, জাপান, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থা আমরা জানতে চাই। তাহলে ওসব দেশে সে রকম গবেষক থাকতে হবে। এরপর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একসঙ্গে কাজ করা খুব সম্ভব। কিন্তু সে জন্য বাংলাদেশে ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ড থাকতে হবে। বাংলাদেশে এটা আছে বলে আমি জানি না। যদি না থাকে, তাহলে এখনই একটা ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ড বানাতে হবে। সব দেশের বোর্ড থেকে আমাদের স্যাম্পল দেবে। এরপর সেগুলো নিয়ে আমরা গবেষণা করতে পারব। যদি এখনো এই বোর্ডের চিন্তা দেশে বাস্তবায়িত না হয়ে থাকে, তাহলে এখনই আমাদের তা করা উচিত। কারণ, এটা ছাড়া আপনি কোনো গবেষণা কোনো জার্নালে প্রকাশ করতে পারবেন না। এখন এত খাটুনির কাজ করে কেউ যদি তা প্রকাশ করতে না পারেন, তাহলে কাজের আগ্রহ হারাবেন। আশার কথা হলো বাংলাদেশের অনেক গবেষণা কিন্তু ভালো ভালো জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ফিল্ডে এ রকম কাজ দেখেছি। সুতরাং বাংলাদেশে কাজ করার মতো অনেক জায়গা আছে। কোথাও বাধা নেই।

বিজ্ঞানচিন্তা:

দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু করার ইচ্ছা আছে?

উপমা গুহ: হ্যাঁ, এ ইচ্ছা আমার সব সময়ই আছে। দেশে এসে আমি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, যাই। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলি। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পড়াতেও চাই। এত দিন যা শিখেছি, তা দেশের শিক্ষার্থীদের শেখাতে চাই। তবে সেটা যে দেশে এসেই করতে হবে, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই আমি জুমে একটা ক্লাস নিতে পারি। এ ব্যাপারে আমি বাংলাদেশে আমার ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কথা বলেছি। এখনো কোনো সমাধান হয়নি। আশা করি, শিগগিরই সমাধান হতে পারে। এর পাশাপাশি দেশের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার খুব ইচ্ছা আমার। যুক্তরাষ্ট্রে যখন কোনো বাংলাদেশি রোগী আমার ওখানে চিকিৎসা নিতে যান, আমি যতটুকু পারি তাঁদের জন্য করি। 

বিজ্ঞানচিন্তা:

একটা বইয়ের নাম বলুন, যেটা সবার পড়া উচিত।

উপমা গুহ: স্কিল ও লাইফস্টাইল (দক্ষতা ও জীবনযাপন) সম্পর্কিত বই আমার পছন্দ। তবে শুধু একটা বইয়ের নাম বলা কঠিন। সে ক্ষেত্রে অ্যাটমিক হ্যাবিট বইটা পড়া যেতে পারে। শুধু পড়লে হবে না, ওখান থেকে শিখতে হবে। আরেকটা বই হলো মেক ইয়োর বেড। এই বই শেখায়, আপনি যদি কিছু পরিবর্তন করতে চান, তাহলে নিজের বিছানা থেকে পরিবর্তন শুরু করতে হবে (গোছগাছ, সুবিন্যস্ত রাখা ইত্যাদি)।  

বিজ্ঞানচিন্তা:

শৈশবে আপনার পছন্দের লেখক কে ছিলেন?

উপমা গুহ: আবদুল্লাহ আল–মুতী ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ ছাড়া আরও অনেকের বই পড়তাম। তবে এই দুজনের বই সবচেয়ে বেশি পড়েছি।  

একনজরে

নাম: উপমা গুহ

জন্ম: ১৯৮৭ সাল 

বাবা: বিমল গুহ 

মা: মীনা গুহ

প্রিয় বই: ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, অ্যাটমিক হ্যাবিট

প্রিয় সিনেমা: টুয়েলভ ফেল

অবসর: পশুপাখিকে সাহায্য করি এবং বই পড়ি

প্রিয় লেখক: আবদুল্লাহ আল–মুতী (বাংলাদেশ), অ্যাডাম গ্র্যান্ড (বিদেশ)

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার কি মনে হয় বই কখনো বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

উপমা গুহ: বিলুপ্ত হবে না। তবে বইয়ের ফরম্যাট পরিবর্তন হবে। এখন যেমন ডিজিটাল বই—পিডিএফ বা ই–পাব পাওয়া যায়, তেমনি আরও পরিবর্তন হবে হয়তো। কাগজের বইয়ের পরিবর্তে ডিজিটাল বই বাড়বে।  

বিজ্ঞানচিন্তা:

বই পড়ার কারণে আপনি কর্মজীবনে কোনো সুবিধা পেয়েছেন? 

উপমা গুহ: হ্যাঁ, অনেক শেখা হয়েছে বই পড়ে এবং এখনো শিখি। জীবনী পড়ে কিংবা সায়েন্স ফিকশন থেকে শিখছি। বই না পড়লে অনেক কিছু অজানা থাকবে। নতুন কিছু শিখতে হলে বই পড়ার বিকল্প নেই।   

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর ও তরুণ, তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

উপমা গুহ: পৃথিবীতে কোনো শর্টকাট নেই। কেউ যদি ভাবে, আমি এত বছর পড়ালেখা করে একটা চাকরি করব, তা না করে সহজে কিছু পড়ে একটা চাকরি নিয়ে নেওয়া যাক। তাতে কিন্তু ভালো কিছু হবে না। জীবনের যেকোনো পর্যায়ে গিয়ে আপনাকে শিখতেই হবে। হয়তো আমাদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নৈতিকতা একই রয়েছে। একটা বই পড়ে যা শেখা যাবে, ১০ মিনিটের ইউটিউব ভিডিও দেখে তা শেখা সম্ভব নয়। আমার কাছে মনে হয়, শেখার কোনো শেষ নেই এবং শর্টকাটও নেই। আর এটা যদি আমরা মাথায় রাখি, তাহলে জীবনে কোথাও আটকাতে হবে না।

অনুলিখন: অনিক রায়, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, তিতুমীর কলেজ