মানুষ কতটা গরম সহ্য করতে পারে

আইস্টোক

২০২৩ সালের গ্রীষ্মে কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে, মানুষ কতটা গরম সহ্য করতে পারে। গরমে মানুষের টিকে থাকার সীমা পরীক্ষা করা হয়েছে সে পরীক্ষায়। এতে স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছেন এক ডজন স্বেচ্ছাসেবী। একটি ইস্পাতমোড়ানো কক্ষে স্বেচ্ছাসেবীদেরকে প্রবেশ করানো হয়েছিল। তাঁদের শরীরে হার্টবিট মিটার ও তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র লাগানো ছিল। কক্ষের তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এরপর ধীরে ধীরে সেখানকার আর্দ্রতা বাড়ানো হয়েছিল। 

তীব্র গরমের কারণে ঘামে ভিজে যাচ্ছিল তাঁদের শরীর। তারপর তাদের চামড়ার ওপরে বাষ্প জমা শুরু হয়। কয়েক ঘন্টা পর দেখা যায়, তাঁদের শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বাইরের তাপের কারণে ভেতর থেকে যেন ধীরে ধীরে রান্না হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজির পোস্টডক্টোরাল গবেষক এবং এই গবেষণার প্রধান রবার্ট মিড বলেছেন, ‘পৃথিবীতে খুব অল্প মানুষই এমন তাপমাত্রা অনুভব করেছেন। গরমের দিনে যেভাবে পানির গ্লাসের বাইরের দেয়ালে পানি জমে, তেমনি এই তাপে ত্বকের ওপরেও পানি জমছিল। ত্বকের তাপমাত্রার তুলনায় বাইরের তাপ এত বেশি ছিল।’

এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, চরম তাপের সঙ্গে শরীরের লড়াই করার ক্ষমতা যাচাই করা। এই গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রোসেডিং অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরের পক্ষে সহ্য করার এই বিপজ্জনক সীমা আগের ধারণার চেয়ে অনেক কম। এই সীমাকে বলা হয় ‘ওয়েট বাল্ব’ তাপমাত্রা। এতে তাপ ও আর্দ্রতা—উভয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই সীমা ২৬-৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।

বিজ্ঞানীরা এই সীমাকে বলেন ‘আনকমপেনসেবল হিট স্ট্রেস’। মানে এটি এমন এক অবস্থা, যে অবস্থায় শরীর আর তাপকে সামাল দিতে পারে না। রবার্ট মিড বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গরম বাড়ছে। তাই এই সীমাগুলো এখন চিহ্নিত করা খুব জরুরি।’

তাপমাত্রার স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করতে হলে ‘ওয়েট বাল্ব’ সামনে আসে। কারণ, বাতাসে আর্দ্রতা থাকলে শরীর ঘামের মধ্য দিয়ে তাপ বের করে দিতে পারে না। ফলে তাপপ্রবাহ আরও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, মানুষ সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এই মাত্রা তখনই প্রকৃতিতে পাওয়া যাবে, যখন পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা শিল্পপূর্ব সময়ের চেয়ে প্রায় ৭ ডিগ্রি বেশি বেড়ে যাবে। মনে করা হতো, এমন তাপমাত্রা আসতে অনেক দেরি হবে।

কিন্তু ২০২২ সালে গবেষকরা যখন এই সীমা মানুষের ওপর পরীক্ষা করেন, তখন দেখা যায় বিপদ আসতে পারে আমাদের ভাবনার চেয়ে অনেক আগেই। মাত্র ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রাও মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর মানে, যদি গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, আর গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো না হয়, তাহলে ২০৪৫ সালের মধ্যেই এটি ঘটতে পারে। এটি হলে পৃথিবীর অনেক অংশে জীবনযাপন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

তাপমাত্রা যত বাড়বে, জলবায়ু পরিবর্তনের তত দ্রুত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও গবেষণার সহ-লেখক টনি উলফ বলেছেন, ‘তাপপ্রবাহের সময় আরও বাড়বে, আরও বেশি দিন স্থায়ী হবে।’

আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল মানুষ সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে
ইস্টমোজো

উলফ এবং তাঁর সহকর্মীরা আগেও তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা কয়েক ঘন্টার জন্য পরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু এই নতুন গবেষণাই প্রথম, যেখানে টানা ৯ ঘন্টা এই সীমায় মানুষকে রাখা হয়েছে। বাস্তব জীবনে তাপপ্রবাহের সময় একজন মানুষ যেটা সহ্য করেন, এই তাপমাত্রা ও সময় তার কাছাকাছি।

গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু অংশগ্রহণকারী পুরো ৯ ঘন্টা তাপ সহ্য করতে পারেননি। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন, ১০ ঘন্টা টানা এই তাপমাত্রায় থাকলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। আর সামান্য কম তাপমাত্রায় থাকলে শরীর ৩৫ ঘণ্টার মধ্যে হিটস্ট্রোকে পৌঁছাবে।

রবার্ট মিড বলেছেন, ‘প্রকৃতিতে এমন উচ্চ তাপমাত্রা বা ওয়েট বাল্ব টানা একদিনের বেশি স্থায়ী হওয়া বিরল ঘটনা। কিন্তু ভাবুন, যদি কেউ এমন পরিবেশে আটকে যায়, তাহলে কী হবে? এই সীমা নির্দেশ করে, তার দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কীভাবে পাগলা ঘোড়ার মতো বেড়ে যেতে থাকবে, যেটাকে আর থামানো যাবে না।’

বিভিন্ন কারণে কম তাপমাত্রাতেও হিট স্ট্রেস বা তাপজনিত চাপ বেশি হতে পারে। বাইরে কাজ করা, আগে থেকেই কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা কিংবা এয়ার কন্ডিশনার বা শীতল পরিবেশের অভাব থাকলে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। রবার্ট মিডের গবেষণায় যদিও তরুণ ও সুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল, টনি উলফের গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্করা অনেক কম তাপমাত্রাতেই হিট স্ট্রেসে ভোগেন।

পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ ভূমিই বসবাসের জন্য অতিরিক্ত গরম হয়ে উঠবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ক্লাইমেট স্কুলের অধ্যাপক র‍্যাডলি হরটন বলেছেন, ‘বয়স্ক মানুষের রক্ত সঞ্চালনব্যবস্থা তাপ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ততটা কার্যকর নয়। যখন তাপমাত্রা অত্যন্ত চরমে পৌঁছায়, তখন শরীরকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়’। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হরটনের একটি গবেষণা নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তাহলে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ ভূমিই বসবাসের জন্য অতিরিক্ত গরম হয়ে উঠবে। গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো আর্দ্র ও গরম অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তানের করাচি শহরে প্রতিবছর প্রায় ২০ শতাংশ সময় এমন তাপমাত্রা থাকবে, যা বয়স্কদের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা যায়, তাহলে ব্যাপক পরিসরে আনকমপেনসেবল হিটে’র ঝুঁকি কমবে। কিন্তু গত এক বছরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বেড়েছে। ২০২৪ সাল হয়ে উঠেছে ইতিহাসের প্রথম বছর, যখন গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে।

এই তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। ১৯৯৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হিট স্ট্রেসজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। একই সময়ে বিশ্বজুড়ে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ তাপের কারণে প্রাণ হারিয়েছে। শুধু ২০২৩ সালেই ইউরোপে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ হিট ওয়েভে মারা গেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, যেটি পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি হারে উষ্ণ হচ্ছে। এই অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

উলফ বলেছেন, ‘মানুষ এখনই হিট ওয়েভে মারা যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতের জলবায়ু যাই হোক না কেন, এখনই আমাদের বুঝতে হবে, কোন তাপমাত্রার পর থেকে হিটজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি ভয়াবহ হয়ে ওঠে’।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: পপুলার সায়েন্স