দুঃসাহসী দুধরাজ

সাদা রঙের তিরের ফলাকে ধেয়ে আসতে দেখে ভয়ে বাজটি দিল উড়াল। দুঃসাহসী, কুশলী ও লড়াকু পাখিটি বাজটির পিঠের ওপরে উড়তে উড়তে ‘থপ থপ’ শব্দে গোটাকয় ঠোকর মেরে দিল।

প্রচণ্ড ধমক মেরে আমগাছের মাথা থেকে ছিটকে ওপরে উঠল দুধসাদা লম্বা লেজের পাখিটি। তিরবেগে ধেয়ে গেল অন্দরের পুকুরপাড়ের মরা খেজুরগাছের মাথায় বসা মেছো বাজটির দিকে। ওটা বসে ছিল ছোঁ মেরে মাছ তুলে নেওয়ার আশায়, বাসায় ওর ‘খাই খাই’ স্বভাবের তিনটি ছানা। সাদা রঙের তিরের ফলাকে ধেয়ে আসতে দেখে ভয়ে বাজটি দিল উড়াল। দুঃসাহসী, কুশলী ও লড়াকু পাখিটি বাজটির পিঠের ওপরে উড়তে উড়তে ‘থপ থপ’ শব্দে গোটাকয় ঠোকর মেরে দিল। কী প্রচণ্ড চিত্কার আর ধমক যে! ‘চেক্ চেক্’ ধাতব কণ্ঠে যে ধমক মারে, তার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া চলে ‘ভাগ ভাগ, ভেগে যা’ শব্দকে। এই শব্দ আশপাশের নিরীহ পাখিদের মনে আনন্দ জাগায়। সাহস জোগায়। কেননা পাখির রাজাখ্যাত ফিঙে তো বটেই, সিংহরাজ, কেশরাজ, কাক, কুকো, চিল-বাজ-ইগলসহ বনবিড়াল, বেজি, গুইসাপকেও আচমকা ধমকসহ প্রচণ্ড আক্রমণে ভড়কে দিতে ওস্তাদ সুন্দর এই পাখি। চোখভরা রোষ এদের, বুকভরা সাহস। আকস্মিক আক্রমণে পিলে চমকে যায় উল্লিখিত পাখি ও প্রাণীদের। তবে বাসা বা সেই বাসায় ডিম, ছানা না থাকলে আক্রমণে আসে না সহজে। পাখিটির সাহসের কথা জানে নিরীহ পাখিরা। জানে বলেই পাতিঘুঘু, বাঁশঘুঘু, টুনটুনি, কমলাবউ, শ্যামাসহ আরও অনেক নিরীহ পাখি এই দুধসাদা পাখিটির বাসার আশপাশে বাসা বাঁধে। এতটা দূরত্বে বাসা বাঁধে, যেখান থেকে নিরীহ পাখিরা বিপত্সংকেত দিলে দুধসাদা পাখিটির কানে পৌঁছায়। দুধসাদা পাখিটির এমনই গুণ, যেকোনো নিরীহ পাখির বিপত্সংকেত পেলেই সে সাড়া দেবে। ধমক-ধামক মারতে মারতে নিরীহ পাখিটির সাহায্যে অবশ্যই এগিয়ে যাবে, ডিম-ছানাখেকো পাখি-প্রাণী বা দাঁড়াশ সাপকে এলাকাছাড়া করে তবেই ফিরবে।

দুধসাদা পাখিটির নাম দুধরাজ। এটি পুরুষ। মেয়েটি হলো দুধরানি।

এমনিতেও দুধসাদা পাখিটি বাগানের মাথার ওপর দিয়েই ওড়ে, প্রয়োজন ছাড়া ভেতরে নামে না। নিরীহ প্রজাদের খোঁজখবর রাখে। টহল দেয়। যে গাছে বাসা করে, সে বাসার বৃত্তাকার চারপাশের বিশাল একটা এলাকাকে এরা ‘বাবার তালুক’ বলে মনে করে। আমি ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে আসি ১৯৭৪ সালে। ঢাকার কেন্দ্রস্থলসহ শহরতলির অনেক এলাকায় দুধসাদা পাখিটিকে দেখেছি কখনো কখনো। সর্বশেষ বাসা দেখি বাসাবো কদমতলাসংলগ্ন রাজারবাগের গঙ্গাসাগর দিঘিরপাড়ের (ওখানে কালীমন্দির ও অন্যান্য মন্দির আছে) কাঁঠালগাছে ১৯৯৭ সালে। ১৯৯২ সালে একটি পাখি ডেমরার দিক দিয়ে উড়ে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে আসছিল। ওটাকে ঘিরে ফেলেছিল পাতিকাক বাহিনী। ‘নগরীতে অতিথি’ নামের ওই পাখিকে নিয়ে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় (১১.০৩.১৯৯২)।

দুধসাদা পাখিটির নাম দুধরাজ। এটি পুরুষ। মেয়েটি হলো দুধরানি। ও বেচারি নিরীহ। ব্যস্ত থাকে সংসারধর্ম ও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। এগুলোর ইংরেজি নাম Indian Paradise-Flycatcher। বৈজ্ঞানিক নাম Terpsiphone paradisi । ওজন ২০ গ্রাম। পুরুষটি সত্যিই যেন স্বর্গীয় পাখি! লম্বা লেজের মখমলি পাতলা ফিতে পালক ৫০-৬০ সেমি লম্বা হয়। মূল বডি ২০ সেমি। অর্থাৎ শরীরের চেয়ে লেজের পালক তিন গুণ লম্বা। গলা-বুক-পেট-পিঠ ও পাখা ধবধবে ধাতব সাদা; লেজের পালকও সাদা; পাখার অগ্রভাগ ও লেজের তলায় সামান্য কালচে রঙের আভা; ঘাড়-গলা-চিবুক ও লম্বাটে পেছনমুখী খোঁপা-পালক লালচে কালো। পা ও ঠোঁট নীল। চোখের বৃত্ত বা Eye ring হালকা নীল। পুরুষটি আড়াই-তিন বছর পর্যন্ত লালচে বাদামি রঙের থাকে, তারপর পুরো শরীর সাদা হয়। মেয়েটির রং ওই লালচে বাদামিই। ওটার লেজের লম্বা ফিতে পালক থাকে না। মূল খাদ্য এদের নানা রকম প্রজাপতি, বিটল পোকা, ড্রাগন মাছি এবং অন্য উড়ন্ত পোকামাকড় ও ফুলের নির্যাস। তাল-খেজুরের রস পান করে ক্বচিৎ।

দুধসাদা পাখিটির নাম দুধরাজ
আদনান আজাদ

বাসা বাঁধার ভরা মৌসুম এদের মে মাস। তবে মৌসুমটা হলো মার্চ-আগস্ট। গাছের ঝুলন্ত ডালের প্রান্ত থেকে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে যে দু-চারখানা খাড়া সরু ডাল গজায়, সেখানেই চায়ের কাপের মতো চমত্কার বাসা করে তাতে ডিম পাড়ে চারটি। নিজের ‘বাবার তালুক’ ডিম থেকে শুরু করে ছানারা উড়তে না শেখা পর্যন্ত পুরুষটি কড়া পাহারায় রাখে। অতিসাবধানী দুধরাজেরা গোয়েন্দাদের মতো চলাফেরা করে, লোকচক্ষু এড়িয়ে বাসা বাঁধতে চায়। দুষ্টু ছেলেদের তিরের ফলা, ঢিল বা গুলতির আঘাতে যদি দুটি পাখির একটিও মাটিতে পড়ে বা মরে যায়; তাহলে অন্যটি মাটিতে নেমে কী করুণ বিলাপ যে করে! প্রেমে এরা লাইলি-মজনু ও শিরি-ফরহাদকেও হার মানায়। আবাসিক এই পাখিকে ঢাকা শহরতলি থেকে শুরু করে সারা দেশেই দেখা যায়। এই পাখির ওড়ার দৃশ্য নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। তাল-লয় ও ছন্দ মিলে মনে হয় কাগজ দিয়ে বানানো খেলনা পাখি।

লেখক: পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ