এ পর্যন্ত বিশ্বে ঠিক কয়টি প্রাণী আছে (জীবিত ও মৃতসহ)? গুনতে হলে প্রথমে জানতে হবে, পৃথিবীতে এ যাবত কত প্রাণী জন্মেছে। আর এ তথ্য বের করতে হলে খুঁজতে হবে জীবাশ্ম বা ফসিলের ইতিহাস। কাজটা মোটেও সহজ নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কী আর কঠিন কাজ ভয় পান! তাঁরা ইতিমধ্যেই সেই চেষ্টা করেছেন। এ লেখায় সে বিষয়টা জানার চেষ্টা করা যাক।
পৃথিবীতে এখন ৮০০ কোটির বেশি মানুষের বাস। তবে কালে কালে জন্মেছেন এর চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি মানুষ। কালের আবর্তে তাঁরা আবার মারাও গেছে। মানে বোঝাতে চাইছি, পৃথিবীতে এ যাবত যত মানুষ বা প্রাণী জন্মেছে, সেই সংখ্যার তুলনায় পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা অতিনগণ্য। তবে পৃথিবীতে বর্তমানে কত মানুষ আছে, তা নির্ণয় করা গেলেও এতদিনে মোট কত মানুষ জন্ম নিয়েছে, তা হিসাব করা প্রায় অসম্ভব। অনুমান করাও বেশ কঠিন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপ্রকৃতিবিদ ডেভিড জাবলোনস্কি বলেন, ‘বিশ্বের মোট প্রাণীর সংখ্যা বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে বর্তমানে পৃথিবীতে কত প্রজাতির প্রাণী আছে।’
পৃথিবীর ইতিহাসে ঠিক কত প্রজাতির প্রাণী ছিল, তা নির্ধারণ করতে হলে ঘাঁটতে হবে জীবাশ্মের রেকর্ড। কারণ, আগে যত প্রাণী এসেছে, তাদের চিহ্ন রয়ে গেছে জীবাশ্ম বা ফসিল হিসেবে।
আইইউসিএন-এর তালিকা অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ ৬০ হাজার প্রজাতির প্রাণী ছিল পৃথিবীতে। তবে এ তালিকা নিয়েও আছে বিতর্ক। সায়েন্স জার্নালে ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের দাবি, এ ধরনের তালিকার ২০ শতাংশ পুনরাবৃত্তি হয়। অর্থাৎ একই প্রাণীর নাম একাধিক বিজ্ঞানী তালিকাভুক্ত করেন, অবশ্যই অনিচ্ছাকৃতভাবে। কিন্তু সায়েন্স জার্নালের এ কথা সত্যি ধরে নিলে, বর্তমানে প্রজাতির সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৭ লাখ। যদিও এ সংখ্যাটা স্থিতিশীল নয়। কারণ, প্রতিবছর বিজ্ঞানীরা প্রায় ১৪ থেকে ১৮ হাজার নতুন প্রজাতির প্রাণী তালিকাভুক্ত করেন।
২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োজিওগ্রাফার (জীবভূগোলবিদ) ক্যামিলো মোরা ও তাঁর সহকর্মী পিএলওএস বায়োলজি জার্নাল-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন। ওই প্রবন্ধে তাঁরা ইউক্যারিওটিক বা প্রকৃত কোষবিশিষ্ট প্রজাতির মোট সংখ্যা অনুমানের চেষ্টা করেন। যেসব কোষের নিউক্লিয়াস সংগঠিত, মানে নিউক্লীয় পর্দা, নিউক্লিওপ্লাজম ও নিউক্লিওলাস থাকে, তাকে ইউক্যারিওটিক বা প্রকৃত কোষ বলে। আর যেসব প্রাণীর এসব বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলোই প্রকৃত কোষবিশিষ্ট প্রাণী। ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে প্রায় ৭৭ লাখ প্রজাতির প্রাণী আছে। এর মধ্যে আবার অর্ধেকই পোকামাকড়।
তবে পৃথিবীর ইতিহাসে ঠিক কত প্রজাতির প্রাণী ছিল, তা নির্ধারণ করতে হলে ঘাঁটতে হবে জীবাশ্মের রেকর্ড। কারণ, আগে যত প্রাণী এসেছে, তাদের চিহ্ন রয়ে গেছে জীবাশ্ম বা ফসিল হিসেবে। তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। কারণ, যেসব প্রাণিদেহ নরম, সেগুলো সরংক্ষণ করা খুব কঠিন। তা ছাড়া নিয়মিত টেকটোনিক প্লেট বা মহাদেশীয় পাতের পরিবর্তনের ফলে ফসিলের ছাপও মুছে যায়।
আসলে পৃথিবীর প্রাণীর সংখ্যা ঠিক কত, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ, নানা কারণে জীববৈচিত্র্য পরিবর্তন হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় করা, দূষণ ও অন্যান্য কারণে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নিয়তই।
গবেষক জাবলোনস্কির মতে, পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি। সেই সঙ্গে ৪২ হাজার ৮০০ কোটির মতো পাখি ও ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি মাছ আছে। আর পোকামাকড়? আপনার অনুমানের চেয়েও বেশি। ১০ কুইন্টিলিয়ন পোকামাকড় আছে পৃথিবীতে। এক কুইন্টিলিয়ন মানে ১-এর পরে ১৮টি শূন্য। বুঝুন এবার!
এবার একটু গণিতের সাহায্য নিয়ে অতীতের প্রাণীদের সংখ্যা বের করার চেষ্টা করা যাক। জাবলোনস্কির মতে, বর্তমানে পৃথিবীতে ৩৮ লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির পোকামাকড় থাকলেও অতীতে ছিল ৩ হাজার ৮৫০ লাখ প্রজাতির কীটপতঙ্গ। তাহলে বর্তমানে এগুলোর সংখ্যা হবে ১০ কুইন্টিলিয়নের ৩ হাজার ৮৫০ লাখ গুণ। মানে ৩.৮৫ × ১০২৭টি! তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি, পৃথিবীতে অন্যান্য আর্থ্রোপোডা, অমেরুদণ্ডী ও মেরুদণ্ডী প্রাণীসহ মোট প্রাণী আছে ৪.৫ × ১০২৭টি।
আসলে পৃথিবীর প্রাণীর সংখ্যা ঠিক কত, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ, নানা কারণে জীববৈচিত্র্য পরিবর্তন হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় করা, দূষণ ও অন্যান্য কারণে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে নিয়তই।
বায়োজিওগ্রাফার ক্যামিলো মোরা এ ব্যাপারে আরও বলেন, ‘হয়তো এমন অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তি হয়ে গেছে, যাদের শ্রেণিবিন্যাস করার সুযোগও আমরা পাইনি।’
সে হিসেবে অতীতে পৃথিবীতে কত প্রজাতির প্রাণী ছিল, প্রত্যেক প্রজাতির কতটি প্রাণী ছিল, তা এখন অনুমান করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে এটাও বলে রাখছি, এই অনুমান সঠিক নাও হতে পারে। তবু অনুমানের ওপর ভর করে আমরা বলতে পারি, পৃথিবীতে বর্তমানে মোট প্রাণীর সংখ্যা ৪.৫ × ১০২৭টি।