ভূপৃষ্ঠের সবচেয়ে নিচু জায়গা কোনটি

পৃথিবীর স্থলভাগের সবচেয়ে নিচু স্থান কোথায়? কীভাবে এটি এমন গভীর হলো?

মৃত সাগরের পাড়ে লবণে ঢেকে থাকা পাথর দেখা যায়। এটিই পৃথিবীর স্থলভাগের সবচেয়ে নিচু স্থানছবি: ইদো মেইরোভিচ/গেটি ইমেজেস

পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জায়গা মাউন্ট এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় নয় হাজার মিটার ওপরে এর অবস্থান। এ তথ্য সবারই জানা। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চে অবস্থিত। সেটাও প্রায় ১১ হাজার মিটার খাদের গভীরে। এর বাইরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানা প্রয়োজন। ভূমিতে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু জায়গা কোনটি?

পৃথিবীর ভূমিতে এমন এক জায়গা আছে, যেটা দেখলে মনে হবে পৃথিবীর বুকে যেন বিশাল এক ভাঁজ তৈরি হয়েছে। এই ভাঁজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্থলভাগের সবচেয়ে নিচু জায়গা। জায়গাটি ডেড সি বা মৃত সাগরের তীরে অবস্থিত। এর পূর্বে জর্ডান এবং পশ্চিমে ইসরাইল ও ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীর। মাঝখানে মৃত সাগর। এই মৃত সাগরের তীরই স্থলভাগের সবচেয়ে নিচু জায়গা, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ফুট নিচে নেমে গেছে। এখানে লুকিয়ে আছে লাখো বছরের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস।

মৃত সাগর আসলে কোনো সমুদ্র নয়। এটি এক বিশাল লবণাক্ত হ্রদ। এই হ্রদের পাশের পাথরগুলো সাদা লবণের আস্তরণে ঢাকা। হ্রদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিলোমিটার এবং সবচেয়ে চওড়া অংশে এর প্রস্থ প্রায় ১৫ কিলোমিটার। মৃত সাগরে তেমন কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে এখানে কোনো মাছ বাঁচে না বা শৈবাল জন্মায় না। বহুকাল আগে এই পানির নিষ্প্রাণ অবস্থা দেখেই এর নাম দেওয়া হয়েছিল মৃত সাগর।

প্রশ্ন হলো, ভূপৃষ্ঠ থেকে এই জায়গা এত নিচে নেমে গেল কীভাবে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের ধীর এবং প্রায় অদৃশ্য নড়াচড়ায়। মৃত সাগরের অবস্থান মৃত সাগর ফল্ট নামে এক বিশাল ভাঙনরেখার ওপর। রেড সি থেকে শুরু করে তুরস্কের টরাস পর্বত পর্যন্ত প্রায় হাজার কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত এই ফল্ট বা চ্যুতি আজও পৃথিবীর ভূত্বকে নীরবে খাদ তৈরি করছে। প্রায় দুই কোটি বছর আগে এই ফল্টের জন্ম। পশ্চিমে আফ্রিকান প্লেট আর পূর্বে অ্যারাবিয়ান প্লেট এখানে পাশাপাশি অবস্থান করছে। প্লেট দুইটি ধীরে ধীরে সরছে। পূর্বদিকে থাকা অ্যারাবিয়ান প্লেট আফ্রিকান প্লেটের তুলনায় সামান্য দ্রুত গতিতে সরছে। যদিও বছরে মাত্র ৫ মিলিমিটার। খালি চোখে দেখা যায় না। তবে ভূতত্ত্বের হিসাবে এই পাঁচ মিলিমিটারই বড় ঘটনা। নাসার মতে, মৃত সাগর গ্রেট রিফ্ট ভ্যালির মধ্যে অবস্থিত। এটি বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশকে ধীরে ধীরে বিভক্ত করছে।

তীব্র বাষ্পীভবনের ফলে মৃত সাগরের পানির স্তর প্রতি দিন প্রায় ১ ইঞ্চি করে কমে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে ভাবতেন, এই চ্যুতিরেখার একটি বাঁকের কারণে দুই প্লেট সরে যাওয়ার সময় মাঝখানে ফাঁকা জায়গা বা গর্ত তৈরি হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক ভাষায় একে ‘পুল-অ্যাপার্ট বেসিন’ বলে। এমন জায়গায় চারপাশে খাড়া পাহাড় তৈরি হয় এবং কেন্দ্রে গভীর অববাহিকা তৈরি হয়। মনে করা হতো, এভাবেই মৃত সাগর এতটা নিচে নেমে গেছে।

কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, পুরোনো ধারণার সঙ্গে মৃত সাগরের গঠন মেলে না। সাধারণভাবে পুল-অ্যাপার্ট বেসিন প্রথমে লম্বা হয়, তারপর গভীর। কিন্তু মৃত সাগরের অববাহিকার ক্ষেত্রে বিপরীত ঘটনা দেখা গেছে। মৃত সাগরর দক্ষিণ অংশে সঞ্চিত পলিমাটি প্রায় ১৫ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত নেমে গেছে। অথচ ওই অংশের প্রস্থ মাত্র দশ কিলোমিটার। গভীরতার সঙ্গে প্রস্থের এই অমিল বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে।

তেল আভিভ ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা একটি নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, প্লেট দুটি যখন একে অন্যের পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছিল, তখন মাঝখানে থাকা একটি বিশাল শিলার খণ্ড ধসে নিচে নেমে যেতে শুরু করে। যেন পৃথিবীর বুক থেকে বড় একটি টুকরো খসে নিচে পড়ে গেছে। এই পতনের কারণে অববাহিকাটি গভীর হতে থাকে, কিন্তু এর প্রস্থ বাড়েনি। এই ধারণাকে ‘ড্রপ-ডাউন বেসিন’ তত্ত্ব বলা হয়।

অপরদিকে মৃত সাগরের প্রকৃতিও বদলে যাচ্ছে। এটি প্রতিদিন সামান্য বদলায়। তীব্র বাষ্পীভবনের ফলে মৃত সাগরের পানির স্তর প্রতি দিন প্রায় ১ ইঞ্চি করে কমে যাচ্ছে। পানি যত কমছে, স্থলভাগের নিচু অংশটি ততই উন্মোচিত হচ্ছে। আবার চারপাশের প্লেট চলতে থাকে ধীরে ধীরে। বছরে যদিও মাত্র কয়েক মিলিমিটার। এসব প্রক্রিয়া এত ধীরে ঘটে, তাৎক্ষণিক এগুলো মাপা খুব কঠিন। এসব গবেষণা করতে খরচও অনেক বেশি।

মৃত সাগর পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় ভূতাত্ত্বিক এলাকা। লবণ, পাহাড়, হ্রদ, সব মিলিয়ে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু জায়গা।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স