নতুন গবেষণায় জানা গেল মানুষের ভাবনার গতিসীমা

সম্প্রতি মানুষের চিন্তাভাবনার গতিসীমা নির্ণয় করেছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেকের নিউরোবায়োলজির পিএইচডি গবেষক জিয়েও এবং একই প্রতিষ্ঠানের বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক মার্কাস মেইস্টার এ গবেষণা করেন। ১৭ ডিসেম্বর তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিওরোসায়েন্সের আন্তর্জাতিক জার্নাল নিউরন-এ।

প্রতিনিয়ত আমরা চারপাশ থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করি। দেহের পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্র পরিবেশ, মস্তিষ্ক ও শরীরের মধ্য তথ্য আদান প্রদানের কাজ করে। এর পাশাপাশি পরিবেশ থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ কোটি বিট বা ১ বিলিয়ন বিট তথ্য সংগ্রহ করে। বিষয়টা অতি উচ্চগতির ইন্টারনেটের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত খুব অল্প তথ্যই থাকে স্মৃতিতে। বাকি সব হারিয়ে যায়। নতুন এ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, আমাদের মস্তিষ্ক প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ১০ বিট তথ্য প্রক্রিয়া করতে পারে।

নেটফ্লিক্সে আমরা যে সিনেমা দেখি, সেখানে উচ্চগতির ইন্টারনেটে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ মেগা বিট বা ১০০ মিলিয়ন বিট ডাটা আদান-প্রদান হয়। এই গতির সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র প্রায় এর ১০০ গুণ বেশি গতিতে পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্র তথ্য গ্রহণ করতে পারে। তবে মনে রাখবেন, শুধু তথ্য গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সেকেন্ডে মাত্র ১০ বিটের বেশি তথ্য প্রক্রিয়া করতে পারে না।

গবেষণাটির লেখকেরা মানব মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়ার গতি বের করার জন্য প্রথমে কোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য কত বিট তথ্য প্রয়োজন, তা বের করেছেন। তাঁদের উদ্ভাবিত গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে রুবিকস কিউব মিলিয়ে কিংবা কার্ডের ক্রম মনে রেখে বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখেছেন। কোন কাজে সেকেন্ডে কত বিট তথ্য প্রক্রিয়া করতে পারে তা রেকর্ড করেছেন। এরপর পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত চিন্তার মানুষ, অর্থাৎ যারা অতি দ্রুত রুবিকস কিউব মেলাতে পারেন কিংবা কার্ডের ক্রম যারা সবচেয়ে ভালো মনে রাখতে পারেন, তাঁদের দিয়ে একইভাবে কাজগুলো করানো হয়। সেগুলোও রেকর্ড রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের মস্তিষ্ক সেকেন্ডে প্রায় ১০ বিট তথ্য প্রক্রিয়া করতে, এর বেশি নয়।

স্বাভাবিকভাবেই এ গবেষণায় নতুন কিছু প্রশ্নও তৈরি হয়েছে। যেমন কীভাবে ও কেন মস্তিষ্ক অতিরিক্ত তথ্যগুলো বাছাই করে বাদ দেয়। আবার, মস্তিষ্কের একটি নিউরন একাই যেহেতু প্রতি সেকেন্ডে ১০ বিট তথ্য পাঠাতে পারে, প্রক্রিয়া করতে পারে ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে; তাহলে কোটি কোটি নিউরনের কাজ কী? নিউরনের এত বিশাল নেটওয়ার্ক থাকা সত্ত্বেও মস্তিষ্ক কেন সেকেন্ডে কেবল ১০ বিট তথ্য প্রক্রিয়া করে?

আউটার ব্রেন বা বহিঃমস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে আসা তথ্যগুলো সংগ্রহ করে এবং ইনার ব্রেন বা অন্তঃমস্তিষ্ক আগত তথ্যের ক্ষুদ্র অংশে একক সময়ে মনোযোগ দেয়।

তবে এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওযা যায়নি। এই দুই গবেষক জানান, এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ কেন একসঙ্গে একাধিক চিন্তা করতে পারে না, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। যেমন, ভিড়ের মধ্য সবাই কথা বললে সেটা একবারে বোঝা যায় না। কিন্তু নির্দিষ্ট কারো প্রতি মনোযোগ দিলে তার কথা বোঝা যায়। গবেষকদ্বয় মনে করেন, কালক্রমে মানুষের মধ্যে এককেন্দ্রিক মনোযোগী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। জীবন বাঁচাতে মানুষকে খাবার খুঁজতে হতো, আবার বিপদ থেকে সরে যেতে হতো দূরে। এই কাছে আসা ও দূরে সরার চিন্তাটাই ধীরে ধীরে একমুখী মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে।

গবেষকদের মতে, মস্তিষ্ক একই সঙ্গে দুটি আলাদা অংশে ভাগ কাজ করে। আউটার ব্রেন বা বহিঃমস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে আসা তথ্যগুলো সংগ্রহ করে এবং ইনার ব্রেন বা অন্তঃমস্তিষ্ক আগত তথ্যের ক্ষুদ্র অংশে একক সময়ে মনোযোগ দেয়। বহিঃমস্তিষ্ক আর অন্তঃমস্তিষ্ক নিজেদের মধ্যে কীভাবে যোগাযোগ করে তা জানতে গবেষকদের আরও গবেষণা করতে হবে বলে জানিয়েছেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, নিউরন জার্নাল