পৃথিবীর ৭০ ভাগের বেশি জল, বাকিটা স্থল। কিন্তু এই পানির বেশির ভাগটা সম্পর্কেই আমরা জানি না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গভীর সমুদ্রের তলদেশের প্রায় ৯৯.৯৯৯ শতাংশ জায়গাই আজও মানুষ দেখেনি। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন সায়েন্স অ্যাডভান্সেস পিয়ার-রিভিউড জার্নালে।
১৯৫০ সাল থেকে মানুষ নিয়মিত গভীর সমুদ্রে যাওয়া শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত কতবার মানুষ গভীর সমুদ্র অনুসন্ধানে গিয়েছে, তা হিসাব করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওশান ডিসকভারি লিগের ক্যাথেরিন বেল ও তাঁর সঙ্গীরা। এ গবেষণার ফল চমকে যাওয়ার মতো। দলটি ৪৩ হাজার ৬৮১টি গভীর সমুদ্র অভিযান বিশ্লেষণ করে দেখেছে, মানুষ মাত্র ২ হাজার ১৩০ থেকে ৩ হাজার ৮২৩ বর্গকিলোমিটার দেখেছে। বাকিটা এখনো অজানা।
১৯৭৭ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের গ্যালাপাগোস দ্বীপের কাছে প্রথম হাইড্রোথারমাল ভেন্ট আবিষ্কৃত হয়। গভীর সমুদ্রে গরম পানির ঝর্ণার মতো কিছু জিনিস আছে, সেগুলোই হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট।
এই যে ‘দেখা’ বনাম ‘অজানা’—এখানে শব্দ দুটি দিয়ে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে, তা একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। গভীর মহাকাশে অনেক টেলিস্কোপ পাঠানো হয়েছে। সরাসরি চোখে না দেখলেও নভোযানে বসানো ক্যামেরা দিয়ে সৌরজগতের গ্রহগুলোর ছবি তোলা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আবার মহাকাশের অনেক অংশের—যেমন সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর—একটু ভিন্ন ধরনের ‘ছবি’ আমরা পাই। সেগুলো ঠিক ছবি নয়, সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন তথ্য খুঁজে বের করা বা মানচিত্র তৈরি করার মতো ব্যাপার। এই দ্বিতীয় কাজটি সাগর-মহাসাগরের বেলায়ও করা হয়েছে, তবে ক্যামেরা দিয়ে সরাসরি ছবি তোলা বা সেখানে যাওয়ার সুযোগ মানুষ আজও পায়নি।
বিষয়টা আরেকটু খুলে বলা যাক। পৃথিবীর প্রায় ৭১ শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে মহাসাগর। এর প্রায় ৯৩ শতাংশ অঞ্চল ২০০ মিটার বা তারচেয়ে গভীর। একে আমরা বলি ‘ডিপ সিফ্লোর’। এই বিশাল অঞ্চলের কিছুটা স্যাটেলাইট আর জাহাজ থেকে পাঠানো সোনার যন্ত্র দিয়ে ম্যাপিং করেছে মানুষ—অর্থাৎ সিগন্যাল বা ডেটা থেকে মানচিত্র তৈরি করেছে। কিন্তু সরাসরি সেখানে গিয়ে বা ক্যামেরা পাঠিয়ে এ অঞ্চলের খুব কমই দেখেছি আমরা। অর্থাৎ আমরা যতটা দেখেছি, তা প্রায় না দেখার মতোই। ক্যাথেরিন ও তাঁর সঙ্গীদের হিসাব বলছে, আমরা এখনো ডিপ সিফ্লোরের ৯৯.৯৯৯ শতাংশ জায়গাই দেখিনি।
এ ব্যাপারে নিউ সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনকে ক্যাথেরিন বেল বলেছেন, ‘এটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমরা সমুদ্রতলের কতটা জানি, আর কত বিশাল অংশ এখনো অজানা!’
৬৭ বছরে যতবার গভীর সমুদ্রে যাওয়া হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই হয়েছে কিছু নির্দিষ্ট দেশের জলসীমায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও নিউজিল্যান্ডের কাছাকাছি সমুদ্রের তলদেশেই বেশি যাওয়া হয়েছে।
একটা দারুণ উদাহরণও দিয়েছেন ক্যাথেরিন। ১৯৭৭ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের গ্যালাপাগোস দ্বীপের কাছে প্রথম হাইড্রোথারমাল ভেন্ট আবিষ্কৃত হয়। গভীর সমুদ্রে গরম পানির ঝর্ণার মতো কিছু জিনিস আছে, সেগুলোই হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট। ওতে সমুদ্রের তলদেশ থেকে গরম ও খনিজসমৃদ্ধ পানি বের হয়। সেই পানি ঘিরে গড়ে ওঠে অন্ধকারে জন্ম নেওয়া এক বিশাল ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থান। আলো ছাড়া শুধু পানির ওপর নির্ভর করে সেখানে অনেক জীব বেঁচে থাকে।
এ গবেষণা আরও দেখিয়েছে, ৬৭ বছরে যতবার গভীর সমুদ্রে যাওয়া হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই হয়েছে কিছু নির্দিষ্ট দেশের জলসীমায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও নিউজিল্যান্ডের কাছাকাছি সমুদ্রের তলদেশেই বেশি যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক জলসীমায় সমুদ্রতলে যাওয়া হয়েছে খুব কম। সমুদ্রের যে অঞ্চলে কোনো দেশের অধিকার নেই, সেই অঞ্চলকে বলে আন্তর্জাতিক জলসীমা অঞ্চল।
ক্যাথরিন বেল আরও বলেন, ‘শুধু উত্তর আমেরিকা, জাপান আর নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রের তলদেশ দেখেই যদি আমরা ভাবি পৃথিবীটা চিনে ফেলেছি, তাহলে আফ্রিকার সাভানা বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনের খবর কীভাবে জানব?’
ক্যাথেরিনের মতে, আমাদের আরও বেশি সমুদ্রের তলদেশ নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। যত বেশি সমুদ্রের তলদেশ সম্পর্কে জানা যাবে, পৃথিবী সম্পর্কে আমরা তত বেশি জানতে পারব।