হিটওয়েভে মানুষ দ্রুত বুড়ো হয়, বলছে নতুন গবেষণা

ইদানীং আমাদের দেশের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেছে। ৪০ ডিগ্রি সেলসেসিয়াসে পৌঁছে গেছে তাপমাত্রা। সপ্তাহজুড়ে এমন প্রবণতা চলতে দেখা গেছে। এটি মূলত হিটওয়েভ বা তাপদাহের কারণে হয়। অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ তাপমাত্রার সময়কে বলে হিটওয়েভ। কয়েক দিন ধরে স্থানীয় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলে। বাতাসের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি বা কিছু ক্ষেত্রে আর্দ্রতা বেড়ে গেলে হিটওয়েভ তৈরি হয়। 

হিটওয়েভে জীবনযাত্রা খুব কঠিন হয়ে যায়। বাইরে বের হওয়া যায় না। তাপে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এই প্রবণতা এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু হিটওয়েভ আঘাত হেনেছে। ইউরোপের অনেকগুলো প্রধান শহরের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। হিটওয়েভ নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চ তাপমাত্রা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ক্ষতির কারণ হতে পারে এই হিটওয়েভ।

একটি নতুন গবেষণা অনুযায়ী, হিটওয়েভের মধ্যে বাস করা মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছেন। গবেষকরা বলছেন, এর প্রভাব অনেকটা ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা ব্যায়াম না করলে স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয়, তার সঙ্গে তুলনীয়। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, জলবায়ু সংকটের কারণে হিটওয়েভ এখন আরও ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে। ফলে এটি সম্ভবত কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

এই গবেষণাটি তাপমাত্রার প্রভাব আর ভয়াবহতা নিয়ে আমাদের ধারণায় বড় পরিবর্তন এনেছে। আগে আমরা জানতাম, তাপপ্রবাহের কারণে মানুষের অকালমৃত্যু বেড়ে যায়। যেমন ইংল্যান্ডে গত জুন মাসের এক তাপপ্রবাহে প্রায় ৬০০ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু এই নতুন বিশ্লেষণটি দীর্ঘমেয়াদে তাপের প্রভাব নিয়ে কাজ করেছে। 

গবেষণার ফলাফল

গবেষকেরা তাইওয়ানের ২৫ হাজার মানুষের ওপর ১৫ বছর ধরে গবেষণা করেছেন। তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাইওয়ানবাসীর জৈবিক বয়সের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। জৈবিক বয়স হলো স্বাস্থ্যের একটি সামগ্রিক পরিমাপ। গবেষকরা দেখেছেন, যারা দুই বছরের মধ্যে অতিরিক্ত চার দিন তাপপ্রবাহে ছিল, তাদের জৈবিক বয়স প্রায় নয় দিন বেড়ে গেছে। বাইরে বেশি সময় কাটান এমন কায়িক শ্রমিকরা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এমন শ্রমিকদের জৈবিক বয়স বেড়েছে ৩৩ দিন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জৈবিক বয়সের এই বৃদ্ধি অল্প মনে হলেও এটি মাত্র দুই বছরের সময়ের হিসাব। এখন পুরো জীবনে তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে গবেষণা চলছে। তাঁরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যার ওপর এর মোট প্রভাব অনেক বেশি। কারণ তাপপ্রবাহের সময় সবাই কষ্ট পায়। এটি মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার একটি শক্তিশালী লক্ষণ উচ্চ জৈবিক বয়স। 

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কুই গুও বলেছেন, ‘যদি কয়েক দশক ধরে হিটওয়েভের মধ্যে কেউ বেশি সময় থাকে, তবে তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব আমদের রিপোর্টের চেয়ে অনেক বেশি হবে। তাপপ্রবাহ আরও ঘন ঘন এবং দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব আরও ব্যাপক হতে পারে।’

দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি

বিজ্ঞানীদের মতে তাপপ্রবাহে অনেকের মৃত্যু হয়। যারা বেঁচে থাকে, তারা ভাবতে পারে, এবার বুঝি এই গরমের মধ্যেও বেঁচে গেলাম। আসলে গবেষণা বলছেন, তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে এলে আমাদের বার্ধক্যের গতি প্রভাবিত হয়। দ্রুত বুড়িয়ে যাই আমরা।

২০২৪ সালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, শৈশবে তাপের সংস্পর্শে আসা শিশুদের মস্তিষ্কের শ্বেত পদার্থের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই নতুন গবেষণার সঙ্গে আগের গবেষণা মিলিয়ে ভয়ংকর কিছু অনুমান করা সম্ভব। যেমব তাপের প্রভাব স্বাস্থ্যের ওপর জটিল এবং গুরুতর। এই প্রভাব যেকোনো বয়সে ঘটতে পারে। সারাজীবন ধরে এর জন্য ভুগতে হতে পারে। 

নতুন এই গবেষণাটি নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে মানুষের জৈবিক বয়স নির্ণয় করার জন্য রক্তচাপ, প্রদাহ, কোলেস্টেরল, ফুসফুস, যকৃত এবং কিডনির কার্যকারিতাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষকরা এই ফলাফলগুলোকে প্রতিটি ব্যক্তির প্রকৃত বয়সের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছেন। তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে দ্রুত বার্ধক্যের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তাও খুঁজে দেখেছেন। তাঁরা দেখেছেন, মোট তাপপ্রবাহের দিনগুলোর সংখ্যা দ্রুত বার্ধক্য নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাপপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব সময়ের সঙ্গে কিছুটা কমে যায়। পুরোপুরি কমে না। এর কারণ হতে পারে, মানুষ তাপপ্রবাহ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন ছায়ায় বেশি সময় কাটানো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ব্যবহার করা ইত্যাদি। তবে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা সাধারণ জনগণের চেয়ে বয়সে তরুণ, স্বাস্থ্যবান এবং বেশি শিক্ষিত ছিল। তাই বয়স্ক, অসুস্থ এবং দরিদ্র মানুষের ওপর এর প্রভাব আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এই গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত একটি মার্কিন গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়। এই গবেষণায় দেখা গেছে, বাইরের তাপমাত্রা বয়স্কদের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে। ২০২৩ সালের আরেকটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তীব্র তাপের সংস্পর্শে আসা কৃষ্ণাঙ্গ এবং দরিদ্র এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে দ্রুত স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার প্রভাব দেখা গেছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান