রাশিয়ার ছোট্ট একটি গ্রামের নাম মেনিপিলগাইনো। সেই গ্রাম থেকে চামুচঠুঁটো বাটান নামের একটি পাখির পায়ে রঙিন ফ্ল্যাগ পরিয়ে দেওয়া হলো। পাখিটি ৭ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে বাংলাদেশের সোনাদিয়া দ্বীপে এল শীতকাল কাটানোর জন্য। ঘটনাটি গত বছর শীতের। এ বছরও হেমন্তের শুরুতে গেলাম সোনাদিয়ায়। সৈকত পাখি দেখতে। হেমন্তের বিকেলটা ছিল দারুণ উপভোগ্য। সাঁঝের রক্তিম আলো গায়ে মেখে একঝাঁক কাস্তেচরার দল বেঁধে উড়ে চলা, গোধূলিতে রাখালের ঘরে ফেরা, জিরিয়া বা বাটানের দল শেষ মুহূর্তে খাবারের জন্য তাড়াহুড়ো, শীতের হালকা আমেজ—সবই যেন খুঁজে পাওয়া যায় হেমন্তের বিকেলটায়।
জোয়ারের সময় কাটালাম বেলেকেরদিয়ায়। তখন হাজারও সৈকত পাখি গায়ে গা লাগিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। পুরোপুরি শীত নামলে পাখির সংখ্যাও বাড়বে। সৈকত পাখির দলে জিরিয়া, বাটান আর গুলিন্দার সংখ্যায় বেশি ছিল। একেকটি পাখির ওজন ২০-৩০ গ্রামের মতো হবে। এমন ছোট্ট একটি পাখি, যাকে খালি চোখে সামান্য দূর থেকে চেনাও মুশকিল, সে কীভাবে হাজার হাজার মাইল উড়ে আমাদের দেশে আসে, তা সত্যিই এক বিস্ময়! দুই বছর আগে কালালেজ জৌরালি নামের একটি পাখিতে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে দেওয়া হলো। দেখা গেল পাখিটি একটানা ৯ হাজার মাইল উড়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে গিয়ে পরিযাণ করেছে। ঠিক সে রকমই চামুচঠুঁটো বাটানের বেলায়। হাজারও মাইল পথ অতিক্রম করে এ দেশের সীমানায় আসে খাবারের খোঁজে।
শীতেই মূলত পাখিরা পরিযাণ করে। শীতপ্রধান এলাকা থেকে তারা খাবারের সন্ধানে আমাদের দেশে দলে দলে আসে। এ দেশে প্রায় ২৯০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি শীতে আসে। বেশির ভাগই খাবারের খোঁজে এ দেশে এলেও ব্যতিক্রমও আছে কোনো কোনো প্রজাতির বেলায়। যেমন পালাসের কুড়া ইগল। শীতে পাখিটিকে দেখা যায় এ দেশে বাসা বেঁধে বাচ্চা ফোটাতে। আমাদের দেশের হাওরাঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। গ্রীষ্মে এরা তিব্বতের হ্রদে খাবারের জন্য চলে যায়।
হাঁস পরিবারের পরেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সৈকত পাখির দল। প্রতিবছর কয়েক লাখ পাখি এ দেশে আসার তথ্য রেকর্ড করা হয়। মূলত এরা দ্বীপাঞ্চলে এবং উপকূলীয় দ্বীপে খাবারের সন্ধান করে।
বাংলাদেশে দুই গোত্রের পাখিই বেশি পারিযায়ী হয়ে আসে। সবচেয়ে বেশি আসে হাঁস পাখি। প্রায় ২৪ প্রজাতির হাঁস পাখি এ দেশে আসে শীতকালে। এদের মধ্যে গাডওয়াল, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, ভূতিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস উল্লেখযোগ্য। হাওরাঞ্চলেই পরিযায়ী হাঁসের প্রধান বিচরণস্থল। টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি বিলেই ১ লাখের মতো হাঁস দেখা যায়। এ ছাড়া হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিলসহ বিভিন্ন হাওর ও বিলে পরিযায়ী হাঁসগুলো খাবার খোঁজে। প্রতিবছর প্রায় তিন-চার লাখ পরিযায়ী হাঁস এ দেশে আসে। হাওরাঞ্চল ছাড়াও কিছু কিছু হাঁস আসে উপকূলীয় চরাঞ্চলে।
হাঁস পরিবারের পরেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সৈকত পাখির দল। প্রতিবছর কয়েক লাখ পাখি এ দেশে আসার তথ্য রেকর্ড করা হয়। মূলত এরা দ্বীপাঞ্চলে এবং উপকূলীয় দ্বীপে খাবারের সন্ধান করে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সোনাদিয়া দ্বীপ, হাতিয়ার দমারচর, চর শাহজালাল, সোনারচর, পদ্মা-যমুনার বিভিন্ন চরাঞ্চলে। ছোট চা পাখি, পাতি নথজিরিয়া প্রায় সবখানেই পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে প্রতিবছর দুর্লভ ও অতিবিপন্ন কিছু পাখি আসে। এ রকমই একটি পাখি চামুচঠুঁটো বাটান। সংখ্যায় মাত্র ৬০০ পাখি টিকে আছে। বাংলাদেশে প্রাতিবছর দেখা মেলে ৫০টির মতো। এ ছাড়া আছে নর্ডম্যানের গ্রিনস্যানক। মাত্র কয়েক শ পাখি টিকে আছে পৃথিবীতে। এক সোনাদিয়া দ্বীপে পাওয়া যায় ৮ প্রজাতির দুর্লভ পাখি। হাওরের একটি হাঁস আছে। এর নাম বেয়ারের ভূতিহাঁস। গোটা পৃথিবীতে মাত্র কয়েক শ হাঁস টিকে আছে। এ ছাড়া বড় নথ, লাল নথ, ইউরেশীয় গুলিন্দা, কালালেজ জৌরালি সৈকত পাখির মধ্যে বিপন্ন প্রজাতি। এ ছাড়া প্রতিবছরই কিছু নতুন নতুন পাখিরও দেখা মেলে। গত বছর পদ্মার চরে দেখা গেছে সাইস্কের রাতচরা। এটি একটি পরিযায়ী রাতচরা। গত মাসে পদ্মার চরে দেখা মিলেছে একটি বিরল পেলিক্যান।
পরিযায়ীর ওপর গবেষণা হচ্ছে বাংলাদেশেও। পরিযায়ী পাখির পায়ে রিং পরিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে পাখি ধরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পাখিদের পরিযাণের রহস্য খুঁজতে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে কাজ করছেন। অনেক রহস্যের জটও খুলেছে। শীতপ্রধান দেশে যখন চারপাশ বরফে ঢেকে যায়, তখন ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পাখিরা সাধারণত দেশান্তরী হয়। শীতে বরফঢাকা আবাসস্থলে পাখিদের খাবারের সংকট দেখা দেয়। সাইবেরিয়া, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া বা তিব্বতের বরফঢাকা এলাকা থেকে পাখিরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চলে আসে। এই পাখিগুলো চলাচলের জন্য মূলত দুটি ফ্লাইওয়ে রুট ব্যবহার করে। একটি হলো ইস্ট-এশিয়ান অস্ট্রেলেশিয়ান ফ্লাইওয়ে, অন্যটি সেন্ট্রাল এশিয়ান ফ্লাইওয়ে। পাখিরা হাজার হাজার মাইল ওড়ার আগে পর্যাপ্ত খাবার খেয়ে শরীরে অধিক চর্বি জমায়। যাত্রাপথে খাবারের অভাব পূরণ করে এই চর্বি থেকে। মজার ব্যাপার হলো, পাখিরা কীভাবে তাদের পথ চেনে? কোটি বছরের তাদের আত্মিক আচরণই পথ চলতে সাহায্য করে। আলো, তারা, রাত, দিন—এগুলো থেকেই পাখিরা পথচলায় নির্দেশনা পায়। পরিযায়ী হিমালয়ের পাদদেশের বিভিন্ন দেশেই বেশি আসে। পাখিরা হিমালয়ের ওপর দিয়ে পরিযাণ করলে তাদের অনেক বেশি উড়তে হয় এবং বেশি শক্তি ব্যয় হয়। এ কারণেই শীতে বাংলাদেশে বেশি পাখি দেখা যায়।
পরিযায়ীর ওপর গবেষণা হচ্ছে বাংলাদেশেও। পরিযায়ী পাখির পায়ে রিং পরিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বৈজ্ঞানিক উপায়ে পাখি ধরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। গত এক যুগে প্রায় কয়েক হাজার পাখির পায়ে রিং ও ফ্ল্যাগ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত পাখির গতিপথের তথ্য সংগ্রহই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে রোগের তথ্যও সংগ্রহও করা হয়। পরিযায়ী হাঁসে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে এর গতিপথ দেখার চেষ্টা চলছে। শীতের শেষ ভাগে যেসব পাখি ধরা হয়, তাদের শারীরিক তথ্য দেখে দেখা যায়, এসব পাখি দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য শরীরে চর্বি জমা করে।
একটি জলাশয়ের স্বাস্থ্য কেমন আছে, তা পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি দেখেই বলে দেওয়া যায়। জলাশয়টি ভালো থাকা মানেই ওই জলাশয়ে পাখির উপস্থিতি বেশি। নতুন চরগুলোয় তাই পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি বেশি থাকে। টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির খাবার ভালো বলে এখানে পাখির সংখ্যাও বেশি। আর পাখি আছে বলেই এই হাওরে সবচেয়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়। পাখির বিষ্টায় ইউরিয়ার উপাদান থাকে। ফলে হাওর ও তথ্যসংলগ্ন এলাকায় ধানও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
বর্তমান পৃথিবীতে পরিযায়ী পাখিরাই সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছে। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত দল বেঁধে চলাচল করে, খাবার খোঁজে এবং বিশ্রাম নেয়। তাই পাখি শিকারিরা সহজেই তাদের শিকার করতে পারে।
একটি পরিযায়ী পাখি জানে সে কত দিন কত দূর উড়ে কোন জায়গায় গিয়ে খাবার পাবে। সেই অনুপাতে তারা খাবার খায় বা শরীরে চর্বি সঞ্চয় করে। এখন যদি একটি পাখি সাইবেরিয়া থেকে ওড়া শুরু করে একসঙ্গে বিভিন্ন পথ অতিক্রমের পর বাংলাদেশের হাতিয়ার একটি চরে আসে খাবারের সন্ধানে এবং নেমে দেখে যে চরটি আর নেই বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; তাহলে ওই পাখির মৃত্যু হয়। পাখিরা দুর্বল হয়ে পড়ে বা আর উড়তে পারে না। তাই পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ খুবই জরুরি।
বর্তমান পৃথিবীতে পরিযায়ী পাখিরাই সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছে। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত দল বেঁধে চলাচল করে, খাবার খোঁজে এবং বিশ্রাম নেয়। তাই পাখি শিকারিরা সহজেই তাদের শিকার করতে পারে। এ ছাড়া আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ার কারণেও তারা দিনে দিনে হুমকির মুখে পড়ছে। আমাদের দেশে শীতে যেসব পাখি আসে, সেগুলো আমাদেরই পাখি। এসব পাখির টিকে থাকার জন্য আমাদের আবাসস্থল দরকার। তাই তাদের অতিথি পাখি বলে অবহেলা করার উপায় নেই।