আমার কন্যার জন্মের মাস দুয়েক আগের কথা। ডাক্তার কর্ড ব্লাড বা নাড়ির রক্ত সংরক্ষণের প্রসঙ্গ তুললেন। স্টেম-সেল গবেষণা নিয়ে খানিকটা জানতাম, তাই আগ্রহ নিয়ে তাঁর উপদেশ শুনলাম। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, কন্যার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নাড়ির রক্ত ও টিস্যু সংরক্ষণ করব। ২০২২ সালে এরকম ক্রায়োজেনিক সংরক্ষণ পশ্চিমাবিশ্বে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। অভিভাবক হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব বলে মনে হলো।
আগামী শিশুর জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার বাসনা হয়তো আমাদের প্রায় সবারই। তবে শিশুর জীবনের ও তার স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য তেমন কিছু করার সুযোগ বেশিরভাগেরই থাকে না বা হয়ে ওঠে না। গত কয়েক দশকের স্টেম-সেল গবেষণার ফলে আজ ও আগামী কয়েক দশকের ভেতর মানবদেহের প্রায় প্রতিটি ক্ষয়িষ্ণু অঙ্গের প্রতিস্থাপন সম্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেহের রক্ত, হৃৎপিণ্ড, কিডনি, এমনকি মস্তিষ্ক পর্যন্ত প্রতিস্থাপন সম্ভব হতে পারে ২০৮০ সালের ভেতর—এমনটাই ধারণা করেছেন ইউভাল নোয়া হারারি। হোমো ডিয়াস বইয়ে তিনি এ কথা লিখেছেন। তবে মানবদেহ যেন গবেষণাগারে সংশ্লেষিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বচ্ছন্দে নিজ দেহে গ্রহণ করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ স্টেম-সেল। ভূমিষ্ট হওয়ার সময়েই তাই শিশুর জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে মায়ের নাড়ির রক্ত। প্রশ্ন হলো, স্টেম-সেল কী? কী করেই-বা একটি কোষ থেকে বহুকোষী অঙ্গ সংশ্লেষিত হয়? আরও প্রশ্ন আছে। স্টেম-সেল গবেষণার বর্তমান অবস্থা কী? এর ভবিষ্যৎ কী ধরনের মানব সভ্যতার ইঙ্গিত বহন করে? আগামীর গিলগামেশরা কি অমরত্বের খোঁজ সত্যিই পাবেন মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই?*
স্টেম-সেলের বাংলা প্রতিশব্দ করলে দাঁড়ায় ‘কাণ্ডসম-কোষ’। অর্থাৎ, এমন এক কোষ, যেটা থেকে তৈরি হতে পারে একাধিক ও নানারকম কোষ। গাছের কাণ্ড থেকে যেমন বেড়ে ওঠে শাখা প্রশাখা, যারা নিজস্ব স্বকীয়তায় বিস্তৃত হয়, এই কোষও ঠিক সেরকম।
সিদ্ধার্থ মুখার্জি তাঁর দ্য সং অব দ্য সেল বইয়ের স্টেম-সেলের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ১৮৯২ সালে জার্মান প্রাণিবিদ ভেলেন্টাইন হ্যাকারের সাইক্লপস নিয়ে গবেষণার কথা টেনেছেন।
স্টেম-সেলের প্রথম ধারণা আসে ১৮৬৮ সালে আর্নস্ট হাকল নামে একজন জার্মান এমব্রিয়োলজিস্ট বা ভ্রূণ-বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। তিনি ধারণা করেন, বেশিরভাগ বহুকোষী প্রাণী যেহেতু একটি কোষ থেকে জন্ম নেয়, তাই ভ্রূণ হলো এমনি বহুকোষসৃষ্টিকারী কোষ বা ‘স্টামজালেন’। অর্থাৎ স্টেম-সেল। তবে তাঁর ধারণা ছিল কেবলই কল্পনাপ্রসূত। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও সংজ্ঞাগত ভিত্তি ছিল অসমাপ্ত। স্টেম-সেল এমনি কোষ, যা কেবল বহুকোষ (প্লুরিপোটেন্ট) বা সর্বকোষ (টোটিপটেন্ট) সৃষ্টি করার ক্ষমতাই রাখে না, বরং এটি নিজেও স্ববিভাজন করতে পারে। হাকলের এই ধারণা জীববিজ্ঞানে তেমন সাড়া ফেলেনি পরের প্রায় আট দশক অব্দি, দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত। সিদ্ধার্থ মুখার্জি তাঁর দ্য সং অব দ্য সেল বইয়ের স্টেম-সেলের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ১৮৯২ সালে জার্মান প্রাণিবিদ ভেলেন্টাইন হ্যাকারের সাইক্লপস নিয়ে গবেষণার কথা টেনেছেন। উল্লেখ করেছেন ১৮৯৬ সালে মার্কিন জীববিদ এডমন্ড উইলসনের গবেষণার কথা। সিদ্ধার্থ মুখার্জি স্টেম-কোষ গবেষণার মূল প্রণোদনা হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ও এর ফলে সৃষ্ট রক্তকোষের বিনাশ রোধ বা মেরামতের উপায় আবিষ্কারের প্রেরণাকে চিহ্নিত করছেন। তিনি বলছেন, পারমাণবিক বিকিরণের প্রভাবে মানবদেহে রক্তকোষ তৈরির ক্ষমতা লোপ পায়। পরে তা রক্তকোষজনিত ক্যান্সার বা লিউকেমিয়ায় রূপ নিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপানে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে যে যুদ্ধবিরোধী সুর সৃষ্টি হয়, তা বহু বিজ্ঞানীকেই রক্তকোষজনিত রোগের সমাধান আবিষ্কারের খোঁজে উৎসাহিত করেছে।
এমন দুই কানাডীয় বিজ্ঞানী ছিলেন আর্নেস্ট ম্যাককুলো ও জেমস টিল। কানাডার টরন্টো শহরে তাঁরা পারমাণবিক বিকিরণে আক্রান্ত ইঁদুরের শরীরে বোনম্যারো ইনজেক্ট করে, মানে প্রবেশ করিয়ে প্রমাণ করেন, বোনম্যারো বা অস্থিমজ্জায় এমন কোষ রয়েছে, যা ইঁদুরের প্লীহায় রক্তের সব কোষ (অর্থাৎ লাল রক্তকোষ, শ্বেত রক্তকোষ ও প্লেটলেট) নতুনভাবে সঞ্চার করতে সক্ষম। তবে অস্থিমজ্জার কোন কোষ এসব নতুন কোষ জন্ম দিতে পারে, তা তাঁরা তখনও খুঁজে পাননি। ১৯৬০ সালে গবেষণা শুরু করে ১৯৯০ সালে আরভিং ওয়াইজম্যান যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত ফ্লো সাইটোমিটার ব্যবহার করে মজ্জার স্টেম-কোষ আলাদা করেন। তিনি অস্থিমজ্জায় এমন একটি কোষ খুঁজে পান, যা আলাদা করে মানবদেহে প্রবেশ করালে তা রক্তকোষ তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, এই মজ্জাস্থিত কোষ রক্তের লাল রক্তকোষ, শ্বেত রক্তকোষ ও প্লেটলেট তৈরি করতে প্রস্তুত। এই কোষই প্রথম স্টেম-সেল, স্টামজালেন বা প্লুরিপোটেন্ট কোষ। অর্থাৎ এই কাণ্ড-সম কোষ রক্তধারার সব শাখা-প্রশাখা বিস্তারে সক্ষম। রক্ত পরিসঞ্চালন বা ব্লাড ট্রান্সফিউশন আজ বিশ্বজুড়ে একটি বহুল প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি মানবদেহের রক্তজনিত রোগের সমাধান করে। এই জটিল কোষ সঞ্চারের কাজটি করে রক্তে পরিসঞ্চালিত স্টেম-সেল।
স্টেম-সেল কি তবে কেবল রক্তকোষ সঞ্চারেই সীমাবদ্ধ? তাহলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করার যে স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে বিজ্ঞান, তা বাস্তব হয়ে উঠবে কিসের জোরে?
প্রশ্ন হলো, রক্ত পরিসঞ্চালন কি তবে রক্তকোষ সংশ্লিষ্ট সব রোগ সারিয়ে তুলতে পারে? এর উত্তর এখনো একটি জোরালো ‘না’। এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় মানবদেহের ‘অন্য’ বা ‘দি আদার’ হিসেবে বাইরের কোষকে চিহ্নিত করার সহজাত প্রবণতাকে। অর্থাৎ, আমার দেহে অন্যের কোষকে দেহনিবাসী কোষগুলো চিহ্নিত করতে পারে সহজেই। তবে আগন্তুককে সাদরে গ্রহণ করার প্রবণতা মানবদেহে সবসময় বিরাজ করে না। আর এ জন্যই বোধ করি, ১৯৬০ সালে ন্যান্সি লাউরি নামের একটি ছয় বছরের মেয়ের দেহে তার যমজ বোনের অস্থিমজ্জা পরিসঞ্চালন করা হয়। ন্যান্সি অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগে ভুগছিল। ফলে তার মজ্জা রক্ত তৈরি করতে পারছিল না ঠিকভাবে। যমজ বোনের মজ্জাকে তার দেহ অনায়াসে গ্রহণ করেছিল বলে ন্যান্সির নিরাময় সম্ভব হয়। তবে এরকম সামঞ্জস্যতা সব মানুষে-মানুষে থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। আর এই আপাতঃ অসামঞ্জস্যই স্টেম-সেলের মজ্জা-জনিত রোগের ব্যাপক নিরাময়ের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করছে। এ নিয়ে গবেষণা চলমান।
স্টেম-সেল কি তবে কেবল রক্তকোষ সঞ্চারেই সীমাবদ্ধ? তাহলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করার যে স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে বিজ্ঞান, তা বাস্তব হয়ে উঠবে কিসের জোরে? অন্য অঙ্গেও স্টেম-সেলের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর ভেতর এমব্রিয়োনিক (ইএস) স্টেম-কোষ এবং ইন্ডিউসড প্লুরিপোটেন্ট (আইপিএস) স্টেম-কোষের গবেষণায় দুটি সমান্তরাল ধারা তৈরি করেছে। মায়ের গর্ভে ভ্রূণ থেকে যেহেতু মানবশিশুর দেহের প্রতিটি কোষের উৎপত্তি হয়, তাই ভ্রূণজাত কোষ থেকে স্টেম-কোষ তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নেন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রিজিওনাল প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টারে গবেষণারত জেমস থম্পসন, ১৯৯৮ সালে। তিনি আইভিএফ প্রক্রিয়ার পরিত্যক্ত ভ্রূণ সংগ্রহ করেন এবং তা থেকে ব্লাস্টোসিস্টের বিস্তার ঘটান। ব্লাসটোসিস্ট বলয় আকৃতির একটি বহুকোষবিশিষ্ট জৈব অস্তিত্ব, যার পর্দার মতো বহিরাবরণ মায়ের গর্ভে থাকলে প্লাসেন্টা তৈরি করে। আর ভেতরের কোষ-সমন্বয় তৈরি করে ভ্রূণ। ভ্রূণ বিশেষজ্ঞ ব্লাসটোসিস্টের ভেতরের কোষগুলো সংগ্রহ করেন এবং ইমিউনোকম্প্রোমাইজড ইঁদুরে সংস্থাপন করেন। ফলাফল অভিনব! ইঁদুরের ভেতরে এইচ-৯ নামের এই স্টেম-কোষ তৈরি করতে সক্ষম হয় পাকস্থলীর টিস্যু, কার্টিলেজ, হাড়, পেশী ইত্যাদি।
কৃত্রিম উপায়ে ভ্রূণকোষের বিস্তার আজ খুব একটা জটিল না হলেও স্টেম-কোষ সঞ্চারের আরও সহজ উপায় খুঁজতে কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে স্টেম-কোষের ডিএনএ ক্রম মানবদেহের অন্য যেকোনো কোষের ডিএনএ ক্রম থেকে অভিন্ন। কোষভেদে পার্থক্য হলো, কিছু জিন আপ কিংবা ডাউন রেগুলেটেড থাকে, অর্থাৎ চালু বা বন্ধ থাকে। কোন জিন কীভাবে রেগুলেটেড থাকবে, তার ওপর ভিত্তি করে কোষের ধরন পাল্টায়। মানে, যদি একটি কোষের কিছু বিশেষ জিন ইন্ডাকশন প্রক্রিয়ায় চালু করে দেওয়া যায়, তাহলে ত্বকের কোষ পাল্টে ভ্রূণ কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। এমন অভিনব ভাবনা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেন জাপানি স্টেম-কোষগবেষক সিনইয়া ইয়ামানাকা, ২০০৬ সালে। তিনি সহজলভ্য ত্বকের ফাইব্রোব্লাস্ট কোষে ওসিটি৩/৪, এসওএক্স২, সি-এমওয়াইসি এবং কেএলএফ৪ জিনগুলোকে ইন্ডিউস করেন, যা এই সরল সাধারণ ত্বকের ফাইব্রোব্লাস্ট কোষকে অভিনব স্টেম কোষে রূপান্তরিত করে। এই পদ্ধতিকে তাই বলা হয় আইপিএস স্টেম-কোষ সঞ্চারণ পদ্ধতি। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রক্রিয়া স্টেম-কোষ থেকে মানবদেহের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পথ আরও সুগম করবে।
আমার কন্যার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার মায়ের নাড়ির রক্ত ও টিস্যু যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে সিবিআর-এর ক্রায়োজেনিক সংরক্ষণাগারে রক্ষিত আছে। কন্যার যখন বয়স হবে, তখন তাঁর প্রয়োজনমতো যেকোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সহজতর হবে এই সংরক্ষিত রক্তে থেকে যাওয়া স্টেম-কোষ ব্যবহারের মাধ্যমে।
মানব সভ্যতা আজ এক বিশেষ লগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। আজকের ভূমিষ্ট শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার সঞ্চয়ের খাতা খোলে। এ সঞ্চয় আজন্মের সঞ্চয়। এ সঞ্চয় এমন সম্পদের সঞ্চয়, যা তাকে দীর্ঘায়ু দিতে পারে। বিজ্ঞান আজকের নবজাতককে অমরত্বের দোরগোড়ায় প্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এখন কেবল অপেক্ষার পালা।