'এভাবে চলতে থাকলে ক্রনিক পয়জনিং হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে' —অনিরুদ্ধ সরকার, গবেষক

অনিরুদ্ধ সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস, রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পোস্টডক্টরাল গবেষক। সম্প্রতি নেচার প্রকাশনা সংস্থার বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিঙ্গার–এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলামসহ আটজন গবেষক মিলে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে ওই গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন অনিরুদ্ধ সরকার। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

বিজ্ঞানচিন্তা: এই গবেষণা কেন ও কীভাবে করলেন?

অনিরুদ্ধ সরকার: বাংলাদেশের মাটি, পানি ও খাদ্যশস্যে ভারী ধাতু দূষণ এখন একটি বড় সমস্যা। সামগ্রিকভাবে তা আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষভাবে যখন নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি এখন বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যদ্রব্যে ভারী ধাতু ও বালাইনাশকের মাত্রারিক্ত উপস্থিতি পাচ্ছি। এটি এখন আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বিগত এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে বিভিন্ন গবেষক দল এই ভারী ধাতুর দূষণ কীভাবে মাটি, পানি, নদী, সাগর, মাছ, মাংসে পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা করছে। প্রায় প্রতিটি গবেষণায় খাদ্য ও পরিবেশের এসব উৎসে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ভারী ধাতু তারা পেয়েছে। কিন্তু এই গবেষণাগুলোর সার্বিক সংকলন ও ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে একটি পর্যালোচনামূলক মূল্যায়ন হয়নি। যা আমরা এই গবেষণায় করার চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে দু–তিনটি সাম্প্রতিক গবেষণায় ভারী ধাতু কীভাবে দূর করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে এর নীতিকাঠামো কীরকম হতে পারে, তা নিয়ে একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা আমরা এ গবেষণায় করেছি।

বিজ্ঞানচিন্তা: গবেষণাগুলোকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে?

অনিরুদ্ধ সরকার: এই মূল্যায়নধর্মী গবেষণাটি করার জন্য আমরা জনপ্রিয় গবেষণাগুলোর তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহকারী অনলাইন ও অফলাইন গবেষণা পোর্টালের সাহায্য নিয়েছি। যেমন স্কুপাস, ওয়েব অব সায়েন্স, সায়েন্স ডিরেক্টসহ সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার অফিশিয়াল ওয়েবসাইট (যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএস এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি ইত্যাদি) থেকে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করেছি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধগুলো মূল্যায়ন করেছি। এ পর্যন্ত যেসব খাদ্যদ্রব্য ও সংশ্লিষ্ট উৎসে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে ভারী ধাতু পাওয়া গেছে, তা কীভাবে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করেছি।

বিজ্ঞানচিন্তা: কী ধরনের ভারী ধাতু আপনারা বেশি পেয়েছেন?

অনিরুদ্ধ সরকার: বাংলাদেশে ভারী ধাতুর মধ্যে আর্সেনিক সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানিতে এই আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাব আমাদের সবারই জানা। কিন্তু আরও কিছু ভারী ধাতু, যেমন ক্রোমিয়াম, লেড, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি আমাদের মাটি, পানি ও খাদ্যদ্রব্যে পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি সহনীয় মাত্রার চেয়েও বেশি। তাই এই গবেষণাপত্রে এসব খাদ্যদ্রব্য ও সংশ্লিষ্ট সব উৎসে কীভাবে ভারী ধাতুর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এ বিষয়ে পরিবেশগত পরামর্শ এবং এ থেকে উত্তরণের পথ বের করার চেষ্টা করেছি।

বিজ্ঞানচিন্তা: এ গবেষণা থেকে মূলত কী পেলেন?

অনিরুদ্ধ সরকার: বাংলাদেশ মূলত প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট খাদ্যশৃঙ্খল আমাদের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ। নিরাপদ খাদ্যের জন্য কৃষিপণ্যে (ফল, সবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি) কীটনাশক ও ভারী ধাতুর (হেভি মেটাল) উপস্থিতি ও মাত্রাতিরিক্ত দূষণ প্রধান হুমকিস্বরূপ।

যেহেতু কৃষক সরাসরি কীটনাশক ব্যবহার করেন, তাই কীটনাশকের সহনীয় মাত্রা খুব সহজেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কারণ, কীটনাশকের উৎস (মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার) জানা ও নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। অন্যদিকে ভারী ধাতুর উৎস কারখানার দূষিত বর্জ্য, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, কয়লা কিংবা খনিজ দ্রব্যের জন্য খনি খনন, ট্যানারি কিংবা মিউনিসিপ্যাল বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বর্জ্য ফেলা। এ পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমাগতভাবে জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ছে। তাই কৃষিপণ্যগুলো কৃষক পর্যায়ে এবং বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা পর্যায়ে নিয়মিত মনিটরিং জরুরি। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য অধিদপ্তরের (FAO) নিয়ম অনুযায়ী কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে ভারী ধাতু দূষণ সহনীয় মাত্রায় রাখবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখন পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশিত গবেষণাগুলো এই আন্তর্জাতিক আইন মেনেই গবেষণালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করে আসছে।

বিজ্ঞানচিন্তা: ভারী ধাতু পাওয়া যাওয়ার মূল কারণ কী?

অনিরুদ্ধ সরকার: আমাদের এই রিভিউ গবেষণার মূল কথা হচ্ছে, হেভি মেটাল কৃষক পর্যায়ে প্রয়োগ না করলেও কীভাবে আমাদের জনপ্রিয় সবজি, ফল কিংবা জলাভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা। আমাদের নীরব বিষের অন্যতম প্রধান সব ক্ষতিকর পদার্থ খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। কলকারখানা কিংবা খনি ছাড়াও অনেক কৃষিজমি ও সেখানকার ফসলে ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক যেমন নিষিদ্ধ হওয়ার ৩০-৪০ বছর পরও ডিডিটি, হেপ্টাক্লোর ইত্যাদি কীটনাশক আমাদের ফসল ও জমিতে পাওয়া যাচ্ছে। তাই দূষণের উৎস নির্দেশ ও ফুড চেইনে এ রকম দূষণ কমিয়ে আনাই হচ্ছে আমাদের পরবর্তী করণীয়।

বিজ্ঞানচিন্তা: ছাদকৃষিকে অনেকে নিরাপদ বলছেন, আপনারা কী পেলেন?

অনিরুদ্ধ সরকার: মাঠে উৎপাদিত ফসলে ভারী ধাতু দূষণ শহরকেন্দ্রিক জনপ্রিয় ‘ছাদকৃষি’তে উৎপাদিত ফল কিংবা সবজিতেও পাওয়া যাচ্ছে। ভারী ধাতুসহ আরও কিছু দূষিত পদার্থ (পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন) ছাদে উৎপাদিত ফসলে পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো আসলেই নিরাপদ খাদ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা চেষ্টা করেছি এই বিষয়গুলোকে সামনে আনতে। এই হেভি মেটাল হয়তো একটু একটু করে আমাদের খাদ্যদ্রব্যে প্রবেশ করছে। তাই আমরা এটার সরাসরি ক্ষতি কিংবা ভয়াবহতা বুঝতে পারছি না। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে ক্রনিক পয়জনিং হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিজ্ঞানচিন্তা: সমাধান কী?

অনিরুদ্ধ সরকার: আমাদের সচেতনতা ও গবেষণার অভাব এবং এসব গবেষণার ফলাফল নিয়ে সঠিক আলোচনা ও পলিসি মেকিংয়ের সমন্বয়তার অভাবে এ রকম দূষণ বাড়ছে।

সমাধানের পথ হিসেবে খাদ্যদ্রব্যে হেভি মেটাল দূষণ নিয়ে ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রস্তুতি ও আলোচনা দরকার—

এক. হেভি মেটালের সম্ভাব্য উৎস, সেখানে উৎপাদিত ফসল, জমি, নদী, মাছ ইত্যাদিতে হেভি মেটালের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা এবং সঠিক উৎস ও খাদ্যশৃঙ্খলে হেভি মেটালের সম্ভাব্য প্রবেশপথগুলো চিহ্নিতকরণ।

দুই. দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর (BAEC, BCSIR, BSTI, BFSA, MoA, MoF, MoH) সমন্বয় সাধন করে গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ করা ও আলোচনা উন্মুক্ত করা।

তিন. ভারী ধাতু দূষণের সহনীয় মাত্রা নিয়ন্ত্রণ আইনগুলোর (Bangladesh Food Safety Act, 2013; Food Safety (Contaminants, Toxins, and Harmful Residue) Regulations, 2017) সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা।

চার. হাইপারঅ্যাকোমোলেটিং প্ল্যান্ট (যেমন সানফ্লাওয়ার, দূর্বাঘাস, গাঁদা ইত্যাদি) গাছের মাধ্যমে হেভি মেটালে দূষিত কৃষিজমি পরিশোধন করলে (Phytoremediation) খুব সহজে ও কম খরচে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

পাঁচ. ঢাকাসহ মেগা সিটিগুলোতে মিউনিসিপ্যাল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোতে সঠিকভাবে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা ও নিয়মিত মনিটর করা। অনেক হেভি মেটাল টলারেন্ট ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগে বিভিন্ন দেশে হেভি মেটাল দূষিত বর্জ্য ও পানি পরিশোধন করা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব উপায়ে। এসব ইকো ফ্রেন্ডলি নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ।

ছয়. সার্বিকভাবে গবেষণালব্ধ ফলাফল ও ফুড সেফটি আইনের সঠিক ব্যবহার, সচেতনতা বৃদ্ধি ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে হেভি মেটাল দূষণ ও সংশ্লিষ্ট খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

* লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত