ভিটামিন ডি এবং জিনরহস্য

ভিটামিন ডি মানুষের শরীরের অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। ১৯৩৬ সালে প্রথম ভিটামিন ডি-এর গঠন আবিষ্কৃত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে আবিষ্কৃত হয় এর সক্রিয়করণ প্রক্রিয়া। তখন থেকেই ডি ভিটামিনকে শারীরবৃত্তির জন্য একটি অপরিহার্য পুষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ভিটামিনের অভাবে রিকেটস, অস্টিওম্যালাসিয়া হতে পারে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ডি-এর অভাবে ক্যানসার, অটোইমিউন ডিজিজ ও কার্ডিওভাসকুলার রোগ হতে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ ভিটামিন ডি-এর অভাবে ভুগছে।

সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসা, ঋতুগত তারতম্য, ত্বকের রং, বয়স, জাতি, লিঙ্গ, বিএমআই, ভিটামিন ডি–যুক্ত খাবার বা ভিটামিন ডি-এর সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব পূরণ করা যায়। বর্তমানে আরেকটি তথ৵ জানা গেছে। মানুষের জেনেটিক প্যাটার্ন রক্তে ভিটামিন ডি-এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।

আগে বাংলাদেশের মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব–সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা হতো। কিন্তু এর সঙ্গে জেনেটিক প্যাটার্ন নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। সিঙ্গেল নিউক্লিওটাইড পলিমারফিজম (SNPs) নামে একধরনের মিউটেশন জিন রক্তে ভিটামিন ডি-এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে ভিটামিন ডি নিয়ন্ত্রণকারী আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিন হলো CYP2R1। এই জিন লিভারে 25-হাইড্রোক্সিলেজ এনজাইমের জন্য জন্য দায়ী। এ কারণেই সিরাম 25(OH)D বা ভিটামিন ডি তৈরি হয়।

CYP2R1 জিনে rs10741657 (SNP)-এর ভিন্নতার কারণে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের পরও মানুষের শরীরে সিরাম 25(OH)D মাত্রার ঘাটতি দেখা যেতে পারে। সিরাম 25(OH)D CYP2R1-এর rs10741657-এর জেনেটিক প্রভাব সম্পর্কিত কোনো গবেষণা বাংলাদেশে এর আগে করে দেখা হয়নি। জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত একটা গবেষণা চালায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগ। এতে ট্রাফিক পুলিশের সদস্য, কমিউনিটি এনজিও কর্মী (স্বাস্থ্যকর্মী), ক্রিকেট ও ফুটবল খেলোয়াড়দের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। এর লক্ষ্য ছিল সিরাম 25(OH)D স্বল্পতার সঙ্গে CYP2R1 (rs10741657)-এর জিনোটাইপগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক খুঁজে বের করা।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে CYP2R1 (rs10741657)-এর জেনেটিক রূপগুলো ছিল জিনোটাইপ GG, GA এবং AA। CYP2R1 জিনে rs1041657 এর ‘GG’ এবং ‘GA’ জিনোটাইপের উপস্থিতির সঙ্গে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সিরাম 25(OH)D স্বল্পতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের মানুষ পর্যাপ্ত সূর্যের আলট্রাভায়োলেট বেটা রশ্মি পায়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সিরাম ক্যালসিয়াম লেভেল এবং অন্যান্য প্যারামিটার (SGPT, PT, FBS, Serum Creatinine)-এর মান ছিল স্বাভাবিক। তাই বলা যেতে পারে, তাদের রক্তে সিরাম 25(OH)D-এর মাত্রা কম হওয়া সত্ত্বেও ভিটামিন ডি-এর অভাবজনিত রোগ তাদের ছিল না। সুতরাং অনুমান করা যায়, অংশগ্রহণকারীদের রক্তে ভিটামিন ডি কম হলেও তারা স্বাভাবিকভাবেই শারীরবৃত্তীয় কাজগুলো সম্পাদন করতে পারছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই গবেষণার ফলাফল বেশ প্রভাব ফেলতে পারে। এ থেকে জানা যায়, পলিমরফিক ভিটামিন ডি-সম্পর্কিত জিনযুক্ত ব্যক্তি কম সেরাম ভিটামিন ডি দিয়ে তার স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারে।

গবেষণার ফলাফল থেকে উপসংহারে আসা যেতে পারে, সিরাম 25(OH)D লেভেলর প্রয়োজনীয়তা মানুষের শারীরবৃত্তীয় কার্যসম্পাদনের জন্য ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হতে পারে। তবে গবেষণায় নমুনার সংখ্যা কম ছিল এবং অন্যান্য ভিটামিন ডি–সম্পর্কিত জিনের বৈচিত্র্য বিবেচনা করা যায়নি। আরও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন। যাতে সিরামের ভিটামিন ডি-এর রেফারেন্স মানগুলোকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার জন্য বিবেচনা করা যায়।

লেখক: চিকিৎসক ও গবেষক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা

*লেখাটি ফেব্রুয়ারি ২০২২ সংখ্যায় বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত