ঠান্ডা পানি পান করা কি ক্ষতিকর

আমাদের দেহের প্রায় ৬০ শতাংশই পানি। দেহে পানির ঘাটতি হলে জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। এ জন্যই পানির আরেক নাম জীবন। সবসময় পর্যাপ্ত পানি পান করা তাই খুব জরুরি।

দেশে প্রায় মাসখানেক যাবত তীব্র তাপদাহ চলছে। ঘরের বাইরে সূর্য যেন জলন্ত আগুন উগলে যাচ্ছে দিনজুড়ে। রাতের বড় অংশজুড়ে ভূপৃষ্ঠের বিকিরিত তাপের কারণে আবহাওয়া তপ্ত থাকছে। প্রচণ্ড গরম এই পরিবেশে যেমন প্রচুর ঘাম হয়, তেমনি পিপাসাও লাগে অনেক বেশি। আর পিপাসার সময় ঠান্ডা পানির মতো লোভনীয় জিনিস আর কী আছে? অনেকেই তাই পিপাসা মেটাতে ফ্রিজের হিমশীতল পানি বেছে নেন। মনে করেন, শীতল পানি পান করা মানে শরীর-মন সব জুড়িয়ে যাওয়া।

এদিকে, শীতল পানি শরীরের জন্য ক্ষতিকর—এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষ করে গরম পরিবেশ থেকে এসে হঠাৎ ঠান্ডা পানি পান করাকে ক্ষতিকর বলেন অনেকেই। আসলেই কি তাই? পাল্টা প্রশ্ন আসে, তাহলে কি গরম পানি শরীরের জন্য ভালো? বিজ্ঞান কী বলে? আসুন, জানার চেষ্টা করা যাক।

অনেকে আবার এটাও মনে করেন যে বরফশীতল পানি (৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে) পানের ফলে শরীর তার অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ঠিক রাখতে হিমশিম খায়। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এসব কথার খুব কমই তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়

প্রথমে দেখে নেওয়া যাক, ঠান্ডা পানি পান করা নিয়ে মানুষের প্রচলিত ধারণাটা কেমন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে তাকালে বিষয়টা বোঝা যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঠান্ডা পানির ক্ষতিকর দিক নিয়ে অনেক ভিডিও দেখা যাচ্ছে। এসব ভিডিওতে ঠান্ডা পানির অপকারিতা নিয়ে যেসব কথা বলা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো, ঠান্ডা পানি রক্তনালীকে সংকুচিত করে এবং হজমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। অনেকে আবার এটাও মনে করেন যে বরফশীতল পানি (৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে) পানের ফলে শরীর তার অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ঠিক রাখতে হিমশিম খায়। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এসব কথার খুব কমই তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।

ব্যথার জন্য ঠান্ডা পানিকে সরাসরি দায়ী করার সুযোগ না থাকলেও, মাইগ্রেনের রোগীদের জন্য ঠান্ডা পানি ভালো কিছু নয়
প্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন

ঝুঁকি

ঠান্ডা পানি পান করার কিছু ঝুঁকি রয়েছে। সেটা অবশ্য প্রচলিত অর্থে যে তাপীয় ভারসাম্যহীনতার কথা বলা হয়, সেরকম কিছু নয়। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের জার্নাল পাবমেড-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ঠান্ডা পানি পানের কারণে নাকের ভেতরে থাকা শ্লেষ্মা বা মিউকাস ঘন হয়ে যায়। এতে ফুসফুসে বাতাসের প্রবাহ কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৫ জন অংশগ্রহণকারীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া যায়।

এর বিপরীতে গবেষকেরা দেখেন, মুরগির স্যুপ আর গরম পানি পানের ফলে মানুষ আরও সহজে শ্বাস নিতে পারে। এদিক থেকে ঠান্ডার ধাত আছে, এমন মানুষের জন্য ঠান্ডা পানি পান করা ক্ষতিকর হতে পারে, সেটা বলা যায়।

আরও কিছু গবেষণা ঠান্ডা পানি পানের ঝুঁকির কথা বলে। ২০০১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বরফশীতল ঠান্ডা পানি পান করার পর ৬৬৯ নারীর মধ্যে মাত্র ৫১ জনের মাথাব্যথা অনুভূত হয়। শতকরা হিসেবে সংখ্যাটা ১০০ জনে ৭.৬ জন। তবে পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা যায়, তাঁদের বেশির ভাগই আগে থেকে মাইগ্রেনের ব্যথায় ভুগছিলেন। ঠান্ডা পানি সেই ব্যথাকে জাগিয়ে তুলেছে। ব্যথার জন্য ঠান্ডা পানিকে সরাসরি দায়ী করার সুযোগ না থাকলেও, মাইগ্রেনের রোগীদের জন্য ঠান্ডা পানি ভালো কিছু নয়। সুইডেনের আপসালা ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের পক্ষ থেকে এই সমীক্ষা চালানো হয়। আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব মেডিকেল সায়েন্স, নিউরোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট ও ডোসেন্ট পিটার ম্যাটসন এই সমীক্ষার তত্ত্বাবধানে ছিলেন।

ব্যথার জন্য ঠান্ডা পানিকে সরাসরি দায়ী করার সুযোগ না থাকলেও, মাইগ্রেনের রোগীদের জন্য ঠান্ডা পানি ভালো কিছু নয়। সুইডেনের আপসালা ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের পক্ষ থেকে এই সমীক্ষা চালানো হয়

এ ছাড়া, অ্যাকাইলেশিয়া বা কোনো কিছু গিলতে অসুবিধা হয়, এমন সমস্যা যাদের আছে, তাদের জন্য ঠান্ডা পানি পান করাটা অস্বস্তির কারণ হতে পারে। ২০১২ সালে চীনা গবেষকদের পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। তবে সে গবেষণায় মাত্র ১২ জন অংশগ্রহণকারীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়।

চীনের প্রথাগত চিকিৎসাবিদ্যায় বিশ্বাস করা হয়, গরম খাবারের সঙ্গে ঠান্ডা পানি পানের বিষয়টি শরীরে একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। ফলে চীনা সংস্কৃতিতে গরম খাবার সাধারণ গরম পানি ও গরম চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। পৃথিবীর আরও কিছু সংস্কৃতিতে এই রীতি মানা হয়।

অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন, গরমের দিনে ঠান্ডা পানি পান করলে আসলে শরীরের তাপমাত্রা কমে না। যেমন আছে তেমনই থাকে। এ বিশ্বাসের পক্ষে-বিপক্ষে অবশ্য যথেষ্ট গবেষণা নেই। তাই নিশ্চিত করা বলার উপায় নেই, এ ধারণা সত্য নাকি মিথ্যা। শুধু এটুকু বলা যায়, ঠান্ডা পানির বিপাকে দেহের একটু বেশি শক্তি ক্ষয় হয়।

এসব কথার মাধ্যমে তাহলে কী সিদ্ধান্তে আসা যায়? ঠান্ডা পানি পান করাকে ঢালাওভাবে যে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে প্রচার করা হয়, সেটার স্বপক্ষে তেমন কোনো জোরালো গবেষণা নেই। তবে ঠান্ডার ধাত আছে অথবা শারীরিক জটিলতা আছে, এমন মানুষদের জন্য ঠান্ডা পানি থেকে দূরে থাকাই উচিত সতর্কতা হিসেবে
আরও পড়ুন

ভালো দিক

ঠান্ডা পানি পান করার তেমন ভালো দিকও আসলে নেই। তবে কিছু ভালো দিক উঠে এসেছে ২০১২ সালেরই আরেক গবেষণায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের করা ওই গবেষণায় দেখা যায়, ব্যায়াম করার সময়ে শরীরে অতিরিক্ত তাপ উৎপাদন ঠেকাতে সাহায্য করে ঠান্ডা পানি। ফলে পরিশ্রমের কষ্ট কিছুটা কম হয়।

এসব কথার মাধ্যমে তাহলে কী সিদ্ধান্তে আসা যায়? ঠান্ডা পানি পান করাকে ঢালাওভাবে যে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে প্রচার করা হয়, সেটার স্বপক্ষে তেমন কোনো জোরালো গবেষণা নেই। তবে ঠান্ডার ধাত আছে অথবা শারীরিক জটিলতা আছে, এমন মানুষদের জন্য ঠান্ডা পানি থেকে দূরে থাকাই উচিত সতর্কতা হিসেবে। ঠান্ডা পানি পানের কারণে কোনো শারীরিক জটিলতা না হলে তা পান করা দোষের কিছু নয়। অর্থাৎ এককথায় বলা যায়, ঠান্ডা পানির সে অর্থে অপকারিতা যেমন নেই, উপকারিতাও নেই বিশেষ। তবে দেহে পানিশূন্যতা হলে তা মেটাতে পর্যাপ্ত পানি খাওয়া জরুরি। এই গরমে শরীরের পানিশূন্যতা রোধ করতে পানি পান করাই যেহেতু মূল কথা, তাই ঠান্ডা-স্বাভাবিক যাই হোক, পর্যাপ্ত পানি করুন।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: দ্যা কনভার্সেশন, হেলথলাইন ডটকম