বায়োলুমিনেসেন্সের জগতে

গরমের দিনে ঝোপঝাড়ে প্রায়ই আমরা জোনাকি দেখতে পাই। জোনাকির এক বিশেষ ক্ষমতা আছে। তার দেহ থেকে একরকম হলদে আলো জ্বলতে দেখা যায়। আমরা সেই আলো দেখে মুগ্ধ হই। ঔৎসুক্যে ভরে ওঠে আমাদের মন—কী করে ঘটছে এমনটা? সেই ঔৎসুক্য মেটাতেই এই লেখা।

শুধু জোনাকিই নয়, একটু পরেই আমরা দেখব, জীবজগতের বহু জীবই এরকম আলো তৈরি করতে পারে। জীবন্ত জীবদেহ থেকে বিভিন্ন বর্ণের আলো উৎপাদন এবং ছড়িয়ে দেওয়ার এই ঘটনাকে ইংরেজিতে বলে বায়োলুমিনেসেন্স। বাংলায় বলা হয়, জৈবদ্যুতি। যেসব জীবের এই অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, তাদেরকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্ট। আমাদের চারপাশে এরকম উদাহরণ কেবল জোনাকিই। তবে বাস্তবে এরকম আলো তৈরি করতে পারা জীবের সংখ্যা নেহাত কম নয়! বহু কীটপতঙ্গ, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শৈবাল, প্ল্যাঙ্কটন এবং অসংখ্য সামুদ্রিক মাছ বায়োলুমিনেসেন্সের মাধ্যমে আলো তৈরির ক্ষমতা রাখে। আরও আছে নানা জাতের স্কুইড, ড্রাগনফিশ, অ্যাংলার ফিশ, অক্টোপাস, জেলিফিশ, ক্লিক বিটল, ডিনোফ্লাজেলাটিস। আশ্চর্যের কথা, এদের বেশিরভাগের ঘরবসতিই সমুদ্রের বিভিন্ন স্তরে। সংখ্যা দিয়ে বললে, সামুদ্রিক প্রাণীদের শতকরা ৭৫ শতাংশ এই অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী!

একটা জিনিস স্পষ্ট করে রাখি, আলো তৈরির ঘটনা প্রকৃতিতে আরও অনেকরকম আছে। অনেক জীব বাইরের উৎস থেকে আলো শোষণ করে তাকে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেটাকে বায়োলুমিনেসেন্স বলা হয় না। বায়োলুমিনেসেন্স হতে হলে জীবদেহের আন্তঃরাসায়নিক ক্রিয়াতেই আলো তৈরি হতে হবে।

এখন আসা যাক, বায়োলুমিসেন্স কীভাবে কাজ করে—এই প্রশ্নে। সাধারণভাবে ঘটনাটা এরকম—বিশেষ একটি ফটোপ্রোটিন (বা কিছু প্রজাতিতে কোনো আয়ন) কোনো আলো উৎপাদনকারী উপাদানকে ভাঙে। ফলে উপজাত হিসেবে আলো নির্গত হয়। সাধারণত যে উপাদানটি আলো তৈরী করে, সেটির নাম লুসিফারিন (আলো উৎপাদনের বৈশিষ্ট্যধারী যৌগ)। আর যে উপাদান বা এনজাইম এখানে কাজ করে, তার নাম লুসিফারেজ। এদের যৌথ ক্রিয়ায় অক্সিলুসিফারিন নামে একটি অস্থিতিশীল যৌগ তৈরি হয়। রসায়ন আর পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে এটি স্থিতিশীল অবস্থায় আসার সময় আলোকশক্তি বিকিরণ করে। তখন আমরা বিকিরিত শক্তির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুসারে নানা রঙের আলো দেখতে পাই। আবার কোনো কোনো সামুদ্রিক প্রাণীর দেহে এর বদলে উপস্থিত থাকে ‘অ্যাকুয়ারিন’ নামে একধরনের ফটোপ্রোটিন। ক্যালসিয়াম আয়ন এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তখন এই প্রোটিনটি অক্সিজেন দিয়ে জারিত হয়। অর্থাৎ অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। ফলে তৈরি হয় অক্সিলুসিফারিনের মতো আরেকটি যৌগ—নীলচে আলো বিকিরণকারী ‘সিলেন্ট্রামাইড’। বায়োলুমিনেসেন্টদের দেহে এই প্রক্রিয়াগুলো মোটামুটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে।

আমাদের কাছে এই আলো সৌন্দর্যের বিষয় মনে হতে পারে, কিন্তু বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের জন্য তা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বায়োলুমিনেসেন্স সংশ্লিষ্ট জীবদেরকে বেঁচে থাকতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। দেখা গেছে, এই আলো জীবগুলো শিকার খোঁজা, শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ, একই প্রজাতির অন্য প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ, সঙ্গীকে আকৃষ্ট করা, বহিরাগতকে সর্তক করাসহ আরও কিছু কাজে ব্যবহার করে। চলুন, কিছু কেস স্টাডি করা যাক!

জোনাকি দিয়েই শুরু করি। স্থলভাগের বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের মধ্যে জোনাকিই আমাদের সবচেয়ে পরিচিত। জোনাকির সব প্রজাতি আবার আলো দিতে পারে না। বিশেষ কিছু প্রজাতির এ ক্ষমতা আছে। জোনাকি তার আলো ব্যবহার করে নিজের প্রজাতিগত পরিচয় জানান দেয়। পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করে মিলনের আমন্ত্রণ জানায়। এদের দেহের নিচের দিকের যে অংশে হলদে আলো উৎপন্ন হয়, সেই অংশটি বেশ পাতলা ও স্বচ্ছ। প্রজনন ঋতুতে বনজঙ্গল জোনাকিতে ছেয়ে যায়। তখন এরা নৃত্যের ভঙ্গিতে টিম টিম করে জ্বলতে থাকে। প্রজাতি ভেদে আবার নাচের ধরন আলাদা। ফোটিনাস পিরালিস (Photinus pyralis) প্রজাতিতে পুরুষ জোনাকি ওপর-নিচে উড়ে আলো জ্বালতে থাকে, আর স্ত্রী জোনাকি বসে থাকে পাতা বা অন্য কোথাও। উজ্জ্বল বা তীব্র আলো সমর্থ যৌনসঙ্গীর পরিচয় বহন করে। পুরুষটি আলো দেওয়ার মোটামুটি দুই সেকেন্ড পরে স্ত্রী জোনাকি ফিরতি আলো জ্বালিয়ে আগ্রহসূচক বার্তা দেয়। পুরুষটি তখন আরেকটু কাছে আসে। এভাবে একসময় তারা মিলিত হয়। জোনাকির আলো জ্বালানো এখানেই শেষ নয় কিন্তু। স্ত্রী জোনাকিরা কখনো কখনো বায়োলুমিনেসেন্সের ক্ষমতা ব্যবহার করে আলোক-সৌন্দর্যের ফাঁদ পাতে। আলোর আকর্ষণে বিভ্রান্ত হয়ে অন্য প্রজাতির জোনাকি যখন মিলনের জন্য কাছে আসে, তখন স্ত্রীটি তাকে খেয়ে ফেলে!

জোনাকির ক্ষেত্রে সাধারণত একরকম আলোই দেখা যায়। তবে অন্যান্য জীবে এ আলো নানারকম হতে পারে। যেমন ক্লিক বিটল গুবরে পোকার আলোর রং নির্ভর করে তার মেজাজ-মর্জির ওপর। প্রজনন মৌসুমে সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য এদের তলপেট থেকে কমলা রঙের আলো নিঃসরিত হয়। আর যখন এটি শিকারের আভাস পায়, তখন নিঃসরণ করতে থাকে সবুজ আলো। বিটলের মতো শিকারের স্বার্থে বায়োলুমিনেসেন্সের ব্যবহার দেখা যায় অ্যারাকনোক্যাম্পা লুমিনোসা (Arachnocampa luminosa) নামের পতঙ্গ প্রজাতিতে। নিউজিল্যান্ডের গহীন জঙ্গলের গুহায় দেখা মেলে এদের। লার্ভা মাকড়সার জালের মতো করে বিস্তৃত হয়। এই জাল থেকে নির্গত উজ্জ্বল আলো বাইরের পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে। চকচকে আলো দেখে বোকা বনে গিয়ে যারা জালে আটকা পড়ে, তাদের দিয়ে আহার সেরে নেয় ওই পতঙ্গ।

অনেক পতঙ্গের লার্ভা আবার বায়োলুমিনেসেন্স ব্যবহার করে পাখি, ব্যাঙ বা অন্য শিকারী প্রাণীদের দূরে রাখে। যেমন ডায়মন্ড ওয়ার্ম, রেলরোড ওয়ার্ম এবং গ্লো ওয়ার্ম। রেলরোড ওয়ার্ম আবার বে‌শ সৌখিন। এদের মাথার দিকটা জ্বলে লাল রঙে, আর দেহের নিচের দিকটা সবুজ রঙে।

গ্লো ওয়ার্মের আলো
ছবি: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীবরাজ্য ছত্রাক। এদের প্রায় আশিটিরও বেশি বায়োলুমিনেসেন্ট প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে এ পর্যন্ত। মূলত উষ্ণপ্রধান ক্রান্তীয় বনজঙ্গলে এদের দেখা যায়। পরিচিত ছত্রাক প্রজাতির মধ্যে বিটার অয়েস্টারের কথা উল্লেখযোগ্য। প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম প্যানেলাস স্টিপটিসাশ (Panellus stipticus)। তবে উজ্জ্বল ঝিনুক বা গুগলির মতো দেখতে বলে তাদের ওরকম নামকরণ। অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলে বার্চ, ওক কিংবা বিচ গাছে মূলত এদের দেখা মেলে। সূর্য ডুবলে চারপাশকে এক অপার্থিব আলোয় ঝলমলিয়ে দেয় এই বিশেষ প্রজাতির ছত্রাক।

ওমফেলোটাস ওলিয়েরিয়াসের মতো কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট ছত্রাক পাওয়া যায় ভেজা অথবা পচা কাঠের গুঁড়িতে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ওমফেলোটাস নিডিফরমিস (Omphalotus nidiformis)। এরা সবুজ বা নীলচে সবুজ আলো বিচ্ছুরণ করে। ছত্রাকদের বায়োলুমিনেসেন্সকে আবার একটি বিশেষ নামে ডাকা হয়—ফক্সফায়ার। ফক্সফায়ার মূলত স্পোর ছড়ানোর জন্য কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে। আবার এই উজ্জ্বল আলো ভক্ষকদেরও দূরে রাখে। মজার ব্যাপার হলো, ফক্সফায়ারের আলো ক্ষেত্রবিশেষে বইপড়ার জন্য যথেষ্ঠ এমন আলোও যোগান দিতে পারে! এমনকি পুরোনো ভ্রমণকাহিনিতে জানা যায়, ব্যারোমিটার এবং কম্পাসের কাঁটাকে আলোকিত করতেও একসময় ফক্সফায়ারের ব্যবহার ছিল!

ফক্সফায়ার!
ছবি: উইকিপিডিয়া

সোমালিয়ার দক্ষিণ উপকূলে ভারত মহাসাগরে প্রায় আড়াই শ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে মাঝে মাঝেই দেখা মেলে দুধ-সাদা ফেনিল জলের। এর নাম, মিল্কি সি। নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন, এটাও বায়োলুমিনেসেন্সেরই কেরামতি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, এই আলো সৃষ্টির জন্য দায়ী ডিনোফ্লাজেলাটিস ছত্রাক। পরে গবেষণায় দেখা গেল, কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়াও (Vibrio harveyi) এর জন্য দায়ী। পানিতে যখন বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তখনি এদের থেকে আলো নির্গত হতে থাকে। একটিমাত্র ব্যাকটেরিয়া থেকে নির্গত আলোর পরিমাণ অনেক কম। কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যক (প্রায় দশ লাখের মতো) ব্যাকটেরিয়া একসঙ্গে হলে রীতিমতো আলোকচ্ছটা তৈরি হয়ে যেতে পারে। আর তা এত উজ্জ্বল যে স্যাটেলাইট থেকেও চিহ্নিত করা যায়! আরও একটি খবর দিয়ে রাখি। কেবল সোমালিয়া উপকূলেই নয়, মুম্বাইয়ের জহুর সমুদ্র সৈকত, মালদ্বীপের ভাদু সৈকতসহ আরও কয়েকটি জায়গাতেও এদের দেখা মেলে। নিজের দেহের আলো দিয়ে পুরো এলাকাটাকে ঝলমলে করে তোলে এরা—আর পর্যটকেরা চেয়ে থাকেন অবাক দৃষ্টিতে।

এ তো গেল কেবল স্থল আর সমুদ্র-উপরিতলের আলোচনা। বায়োলুমিনেসেন্সের প্রকৃত জগতে নামতে হলে আপনাকে পরতে হবে মেরিন পোশাক। তারপর পিঠে সিলিন্ডার নিয়ে ডুব দিতে হবে অতল সমুদ্রে।

বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের অধিকাংশই সামুদ্রিক। সত্যি বলতে, সমুদ্রের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জীবই বায়োলুমিনেসেন্ট। এদের মধ্যে আছে বিভিন্ন মাছ, অমেরুদণ্ডী অক্টোপাস, স্কুইড, ছত্রাক,ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি। সমুদ্রের সব গভীরতাতেই এদের দেখা মেলে। অধিকাংশ সামুদ্রিক বায়োলুমিনেসেন্ট জীব নীল-সবুজ রং নিঃসরণ করে। এর কারণ হয়তো এ-ই—সমুদ্রের জীবদের অধিকাংশই এই দুটি রঙে সংবেদনশীল। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, স্থলজদের মতোই সামুদ্রিক জীবদেহেও অথৈ সমুদ্রের পরিবেশে অভিযোজন এবং টিকে থাকার স্বার্থেই বায়োলুমিনেসেন্স গড়ে উঠেছে। 

শুরু করা যাক একটু নিম্ন শ্রেণির প্রাণ দিয়ে। সমুদ্রের উপরিতলে এবং গভীরে বহু বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং শৈবালের বাস। যেমন ডিনোফ্লাজেলাটিস, ভাইব্রিও ফিশারি (Vibrio fischeri), ভাইব্রিও হার্ভেই (Vibrio harveyi)। মিল্কি সির আলোচনাতেও আমরা এদের নাম বলেছি। এরা একসঙ্গে মিলে সমুদ্রে ফাইটোপ্লাংকটন তৈরি করে একজোট হয়ে থাকে। যখন কোনো মাছ বা চিংড়ি বিরক্ত করে, নীলচে আলো জ্বালতে থাকে এগুলো। আপনি হয়তো ভাববেন, আচ্ছা—চিংড়িটাকে ভয় দেখাচ্ছে, এই তো ব্যাপার? না। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে। একটা প্রবাদ শুনে থাকবেন হয়তো, দ্য এনিমি অব এনিমি ইজ মাই ফ্রেন্ড। অর্থাৎ,শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু। আন্দাজ করতে পারছেন কি? জীব বলতে কষ্ট হয়—এমন কিছু জীব জোট বেঁধে আলো জ্বালবে শুধু কি ভয় দেখাতে? আসল বিষয়টা হলো, যখন কোনো মাছ প্ল্যাঙ্কটন খেতে আসে, তখন আলো জ্বালিয়ে প্ল্যাঙ্কটন আরও বড় মাছের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যাতে বড় মাছটা ছোট মাছটাকে খেয়ে প্ল্যাঙ্কটনকে বিপদমুক্ত করে। অনেকটা চোর ধরার অ্যালার্মের মতো! কোনো কোনো হাঙর বা তিমি (Sperm Whale) সত্যিই এই সংকেত বুঝতে পারে। প্ল্যাঙ্কটন তাদের খাদ্য নয়, কিন্তু তারা প্ল্যাঙ্কটন খুঁজে বেড়ায়। প্ল্যাঙ্কটন নিজের খাদককে দেখে আলো জ্বালে, আর সবুজ সংকেত পেয়ে তিমিও চালায় ভূরিভোজ! 

বায়োলুমিনেসেন্ট জেলি ফিশ!
ছবি: লিসা ওয়ার্নার

এ তো গেল একটা কাজ। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক ব্যাকটেরিয়া আলো বিকিরণ করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা, সহযোগী বা শত্রুদের চেনার জন্যে। একে বলে ‘কোরাম সেন্সিং’। সি-ফায়ারফ্লাইরা সচরাচর হালকা আলো নিঃসরণ করে। কিন্তু শত্রু বা অন্য প্রাণীর উপস্থিতিতে তীব্র নীল আলোর ছটায় আলোকিত করে তোলে চারদিক। জলের উপরিতলের কাছকাছিই এদের পাওয়া যায়। জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপানি সেনাবাহিনী গেরিলা আক্রমণে আলোর জন্যে সি-ফায়ারফ্লাই ব্যবহার করত। এ ছাড়া আছে ক্লাস্টারউইংক শামুক। কোনো জীব এদের স্পর্শ করলে বা কোনো বিপদে পড়লে এরা খোলসে ঢুকে পড়ে। আর এই খোলস থেকে আলো জ্বালতে থাকে টিম টিম করে। শামুকের এই আলোর উৎস হলো এর গায়ে বাস করা বায়োলুমিনিসেন্ট ব্যাকটেরিয়া।

সমুদ্রের প্রাণীদের আলোচনা করতে গেলে স্কুইডের কথা আসবেই। এদের বহু প্রজাতির আলো তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। আর এগুলো তারা ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাবে। স্কুইডের দেহে আলো তৈরির মূল উৎস হলো কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া ও স্কুইড আসলে মিথোজীবী বা সিম্বায়োট। অর্থাৎ এরা একে অপরকে সাহায্যের মাধ্যমে একত্রে বেঁচে থাকে। স্কুইড এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খাদ্যের জোগান দেয়। আর প্রতিদানে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের বায়োলুমিনেসেন্স ক্ষমতা দিয়ে স্কুইডদের শত্রু থেকে রক্ষা করে।

যেসব স্কুইড অগভীর সমুদ্রে থাকে, তারা শিকারী দেখলে একধরনের ঘন কালি ছুঁড়ে দিয়ে পালায়। কিন্তু গভীর জলের স্কুইডরা, যেমন ভ্যাম্পায়ার স্কুইড তা পারে না। এর বদলে তারা শত্রুর দিকে বায়োলুমিনেসেন্ট তরল ছুঁড়ে দেয়। ফলে শত্রু কিছুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ সুযোগে স্কুইড পালায়। একই কাজ করে কিছু চিংড়ি (Acanthephyra purpurea) এবং কিছু জেলিফিশ (Comb Jelly)। চিংড়িরা আবার মেঘের মতো জ্বলজ্বলে ধোঁয়া তৈরি করে শিকারকে ভড়কে দেয়। কখনো কখনো এই উজ্জ্বল ধোঁয়া আবার শিকারীকেই বড় জন্তুর শিকার বানিয়ে দেয়!

ফায়ারফ্লাই স্কুইড
ছবি : সিস্কাই ডট ওআরজি

কিছু স্কুইড, যেমন অক্টোপোটেউথিস ডেলেটরন তার শুঁড়ের অংশবিশেষ থেকে বিজলির মতো আলো জ্বালিয়ে, আবার তৎক্ষণাৎ নিভিয়ে দিয়ে সম্ভাব্য শত্রুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। কখনো এরা একেকটা বায়োলুমিনেসেন্ট শুঁড় খসিয়েও ফেলে। যাতে শিকার ওই বিচ্ছিন্ন অংশটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর স্কুইডটা পালাতে পারে। টিকটিকির লেজের মতো এদের শুঁড়ও আবার নতুন করে তৈরি হয়। শুধু স্কুইডই নয়,অনেক অক্টোপাস, সি কিউকাম্বার, তারা মাছ, যেমন ব্রিটল স্টারসও এ পদ্ধতি অবলম্বন করে। রিফ স্কুইড প্রজাতির পুরুষ সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন রঙের আলো নিঃসরণ করতে পারে। স্ত্রী স্কুইডরা যখন ডিম দেয়, তখন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ঘরের বাইরে আলো জ্বালিয়ে পাহারা দিতে থাকে!

সমুদ্রের বায়োলুমিনেসেন্ট জীবদের একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্যামোফ্লাজ তৈরি করা। ক্যামোফ্লাজ কী জিনিস? বলা যেতে পারে, শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ‌ নেওয়া। হাঙরের মতো কিছু শিকারী প্রাণী নিচ থেকে শিকার করে। তারা লক্ষ রাখে ওপরের দিকে, সূর্যের যে আলো আসছে—জলে তার কোনো ছায়া পড়ছে কি না। যদি পড়ে, তাহলে নির্ঘাত সেখানে একটা শিকার রয়েছে। এই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতেই গভীর সমুদ্রের অনেক প্রাণী ছদ্মবেশ ধারণের জন্য বায়োলুমিনেসেন্সের সাহায্য নেয়। এর মধ্যে রয়েছে ববটেইল স্কুইড, হ্যাচেটফিশ, জেলি ফিশ, চিংড়িসহ মাছের আরও কিছু প্রজাতি। এসব প্রাণীর দেহ থেকে নির্গত আলোর ঔজ্জল্য এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যে চট করে পরিপার্শ্বের সঙ্গে তাদের রং মিলে যায়। এ কারণে শিকারি প্রাণীগুলো সহজে এদের ধরতে পারে না।

বায়োলুমিনেসেন্ট চিংড়ি

শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য সামুদ্রিক জীবদের আরও একরকম পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা যায়। ভাবুন তো, অন্ধকার ঘরে হঠাৎ যদি আপনার চোখে টর্চের আলো ফেলা হয়, তাহলে কি আপনার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে না? চমকে উঠবেন না আপনি? তেমনি শিকার করতে আসা প্রাণীরাও বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণীর আলোর ঝলকে হকচকিয়ে যায়। শিকার ধরতেও অনেক বায়োলুমিনেসেন্ট প্রাণী এ পদ্ধতির প্রয়োগ ব্যবহার করে। ফ্ল্যাশলাইট ফিশের চোখের কাছে বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ার থলি থাকে। এই আলো দিয়ে তারা ছোট মাছকে অকস্মাৎ চমকে দেয়। ছোট মাছটা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাবাড় হয়ে যায়, জায়গা পায় ফ্ল্যাশলাইটের পেটে!

গভীর সমুদ্রের কিছু ড্রাগনফিশ, যেমন লুসজ ড্রাগনফিশ বায়োলুমিনেসেন্স ব্যবহার করে চলার পথে সার্চলাইট হিসেবে। আগে বলেছি, অধিকাংশ সামুদ্রিক জীব নীল এবং সবুজের মধ্যে আলো তৈরির ক্ষমতা রাখে। ওই রংগুলোতে তারা সংবেদনশীল। কিন্তু এই ড্রাগনফিশ লাল আলো নিঃসরণ করে। সামুদ্রিক পরিবেশে বিশেষ সুবিধা দিতে তার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। কারণটাও বেশ মজার। তার শিকার বেশিরভাগ মাছ এই আলো দেখতে পায় না। ফলে শিকারী খুব সহজেই শিকারকে গ্রাস করে ফেলে।

এবার যার কথা বলব, তার নাম অ্যাংলার ফিশ। সমুদ্রের প্রায় ২ হাজার মিটার গভীরে এই মাছগুলো বিচরণ করে। দেহের তুলনায় এদের চোয়াল বেশ বড়। তবে এই মাছের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে এর মাথার সামনের দিকের অ্যান্টেনার মতো প্রবৃদ্ধি। একে বলে ফিলামেন্ট। ফিলামেন্টের মাথায় থলির মতো অংশ থাকে, যার নাম এস্কা। এর মধ্যে থাকে বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়ার আলো মাছের টোপ হিসেবে কাজ করে। সমুদ্রে চলতে সাহায্য করা ছাড়াও ওই আলো ছোট ছোট মাছদের আকর্ষণ করে। আর যখন মাছগুলো তাদের ভুল বুঝতে পারে, ততক্ষণে তারা অ্যাংলার ফিশের শক্ত চোয়ালের মধ্যে চলে এসেছে। 

অ্যাংলার ফিশ
উইকিপিডিয়া

সামুদ্রিক বায়োলুমিনেসেন্ট প্রাণীদের এই যে আলোচনা, তা মোটেই শেষ হবার নয়। এরকম আরও বহু জীব রয়েছে, যার বর্ণনা এখানে দেওয়া হয়নি। আবার বহু জীবের বায়োলুমিনেসেন্সের কারণ ও তার ব্যবহার এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে খেছে। তবে বিজ্ঞানীরা বসে নেই মোটেও। বায়োলুমিনেসেন্সের রহস্যভেদ করে কীভাবে মানবকল্যাণে একে ব্যবহার করা যায়, সে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। ইতিমধ্যে কয়েকটি পদ্ধতি আবিষ্কারও করেছেন। ব্যাকটেরিয়ার কোরাম সেন্সিং-এর কথা বলেছি। পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করার জন্য ভাইব্রিও ফিশারি (Vibrio fischeri) ব্যাকটেরিয়ার কোরাম সেন্সিংকে কাজে লাগানো হয়। পানিতে যখন বিষাক্ত কিছু থাকে, তখন এদের আলোর তীব্রতা অনেক কমে যায়।

চিকিৎসায় ও জিন প্রকৌশলে বায়োলুমিনেসেন্সের প্রয়োগক্ষেত্র বাড়ছে। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বায়োলুমিনিসেন্ট ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ার জিনোমে পরিবর্তন করে বাল্ব হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়োগ্লো-র গবেষকরা বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ার জিন ব্যবহার করে জিনগতভাবে বিশেষায়িত তামাক গাছ তৈরি করেছেন, যার নাম স্টারলাইট অ্যাভাটার। এরা তাদের জীবনকালের সম্পূর্ণ সময় আলো দেয়।

সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন আমাদের চেনাজানা উদ্ভিদ আলো জ্বালিয়ে তাদের জল-পুষ্টির প্রাপ্যতা, অভাব কিংবা ফল দেওয়ার সময় নির্দেশ করবে। রাস্তার পাশে আলাদা বাতির দরকার হবে না। বায়োলুমিনেসেন্ট উদ্ভিদ পরিবেশ রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে কমিয়ে আনবে বিদ্যুত খরচও। এ জন্য আমরা বরাবরের মতোই সেসব আলোকিত মানুষদের দিকে চেয়ে আছি, যাঁরা শারীরিকভাবে বায়োলুমিনেসেন্ট নন, কিন্তু যুগ যুগ ধরে তাঁদের আলো আমাদের কল্যাণের পথ দেখিয়ে এসেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, এমবিবিএস, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ১. সাগরের রহস্যপুরী,আব্দুল্লাহ আল মুতী

২. দ্য উইয়ার্ড, ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব বায়োলুমিনেসেন্স, টেড এড: youtu.be/lKeDBpkrDUA

৩. ১৩ গ্লোয়িং অ্যানিমেলস ইন দ্য ডিপ সি, হোয়াট লার্কস বিলো: youtu.be/aIQfTRrD0TE

৪. বায়োলুমিনেসেন্স, স্মিথসোনিয়ান: ocean.si.edu/ocean-life/fish/bioluminescence

৫. বায়োলুমিনেসেন্স, ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়া: britannica.com/science/bioluminescence

৬. বায়োলুমিনেসেন্স এক্সপ্লেইনড, ন্যাট জিও : nationalgeographic.org/encyclopedia/bioluminescence/

৭. বায়োলুমিনেসেন্ট ট্রিজ কুড লাইট আপ স্ট্রিটস, আইএফএলসায়েন্স ডট অর্গ: iflscience.com/plants-and-animals/bioluminscent-trees-could-light-our-streets/#xHSR4UHV249qfGtS.01