যমজ-কাহিনি

এক-দুজন নয়, একসঙ্গে নয়টি শিশু জন্মের রেকর্ডও আছে! একাধিক শিশু একই মায়ের গর্ভে জন্ম নিলে আমরা বলি যমজ। এর পেছনের বিজ্ঞান...

যমজ শিশুর জন্ম এখনো পরিবারে হঠাৎ আনন্দ আর বিস্ময় বয়ে আনে। সাধারণত কোনো দম্পতিই এর জন্য প্রস্তুত থাকেন না। পৃথিবীতে যমজ গর্ভধারণের হার ৩ থেকে ৪ শতাংশ। গর্ভে একসঙ্গে দুটি ভ্রূণ থাকলে তাকে ‘টুইন’ বা যমজ বলি আমরা। একসঙ্গে তিনটি ভ্রূণ থাকলে তাকে বলা হয় ‘ট্রিপলেট’। পৃথিবীতে ৭–১০ হাজার শিশু জন্মালে এ রকম একটি ট্রিপলেট জন্মায়। চারটি শিশুর জন্মও বিচিত্র নয়; কিন্তু এর সংখ্যা অনেক কম। ৬ লাখ সন্তান জন্মে একটা কোয়াড্রিপ্লেট হতে পারে। তবে নানা কারণে বর্তমানে যমজ শিশু জন্মের হার বাড়ছে।

কেন হয় একাধিক শিশু

কীভাবে মাতৃগর্ভে একাধিক ভ্রূণের উৎপত্তি হয়? স্বাভাবিকভাবে বাবার একটিমাত্র শুক্রাণু বা স্পার্ম মায়ের একটিমাত্র ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে। ফলে একটি ভ্রূণ তৈরি হয়, যা মায়ের জরায়ুর দেয়ালে আটকে যায় (ইমপ্ল্যান্ট)। এ সময় দুভাবে একাধিক ভ্রূণ তৈরি হতে পারে। এক, নিষিক্ত ডিম্বাণুটি ইমপ্ল্যান্ট হওয়ার আগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় বা দুই, শুরুতেই দুই বা ততোধিক ডিম্বাণু দুই বা ততোধিক শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হয়ে তারপর জরায়ুতে আসে। যদি একই ডিম্বাণু বিভক্ত হয়ে দুজন শিশুর জন্ম হয়, তবে তারা ‘আইডেন্টিক্যাল টুইন’ হয়। মানে তাদের চেহারা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য প্রায় এক থাকে। ‘মনোজাইগোটিক টুইন’ও বলা হয় তাদের। যদি আলাদা ডিম্বাণু ও শুক্রাণু থেকে তাদের জন্ম হয়, তবে তারা আইডেন্টিক্যাল হয় না। মানে দেখতে এক হয় না। তাদের ‘ফ্র্যাটারনাল টুইন’ বা ‘ডাইজাইগোটিক টুইন’ বলা হয়। আইডেন্টিক্যাল টুইনরা সাধারণত একই লিঙ্গের হয়। মানে হয় দুজনই মেয়ে বা দুজনই ছেলে। কারণ, তারা একই জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল ও বৈশিষ্ট্য শেয়ার করে।

রুশ দম্পতি ভ্যালেন্সিনা ভেসিলিভা ও ফিওদর ভেসিলিয়েভ ১৭২৫ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে ১৬ জোড়া টুইন, ৭ সেট ট্রিপলেট এবং ৪ সেট কোয়াড্রিপ্লেট শিশুর জন্ম দেন—মানে মোট ৬৯টি শিশু!

কী কারণে টুইন প্রেগন্যান্সি বাড়ছে

গবেষণা বলছে, আশির দশকের পর থেকে এ পর্যন্ত টুইন বা মাল্টিপল প্রেগন্যান্সি বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। এর কিছু কারণও শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

এক. বেশি বয়সে সন্তান নেওয়া। বর্তমানে লেখাপড়া ক্যারিয়ার ইত্যাদি কারণে মেয়েদের মধ্যে একটু দেরিতে সন্তান নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ৩৫ বছরের বেশি বয়সে সন্তান নিলে টুইন প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি বাড়ে। কারণ, যত বয়স বাড়ে, তত ডিম্বাশয় বা ওভারির একসঙ্গে একাধিক ডিম্বাণু ছেড়ে দেওয়ার বা ডিম্বস্ফুরণের প্রবণতাও বাড়ে।

দুই. যাঁদের পরিবারে টুইন প্রেগন্যান্সির ইতিহাস আছে, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। মজার বিষয় হলো, আইডেন্টিক্যাল টুইন সাধারণত পরিবারে বংশগতভাবে দেখা যায় না। তবে ফ্র্যাটারনাল টুইন বংশগত কারণে হতে পারে।

তিন. যদি ফার্টিলিটির জন্য বা সন্তান জন্মদানের জন্য চিকিৎসা নেওয়া হয়, তাহলে মাল্টিপল প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি খুব বেশি। কারণ, এসব ওষুধ একই সঙ্গে কয়েকটি ডিম্বাণুকে পরিপক্ব করে এবং প্রতিটিরই নিষিক্ত হওয়ার বা ভ্রূণে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে মাল্টিপল প্রেগন্যান্সি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

যমজ সন্তান ধারণ কি ঝুঁকিপূর্ণ

সাধারণত বেশির ভাগ যমজ সন্তান কোনো ঝামেলা ছাড়াই জন্ম নেয়। তবে তাদের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে কিছু ঝুঁকি বেশি। যেমন প্রিম্যাচিউর বা সময়ের আগে প্রসব হওয়ার ঝুঁকি বেশি তাদের। এ ছাড়া তাদের এক বা দুজনই ‘লো বার্থ ওয়েট’ বা কম ওজন নিয়ে জন্মাতে পারে। মায়ের অতিরিক্ত ওজন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও বেশি থাকে। অনেক সময় মায়ের পুষ্টির অভাব দেখা দিতে পারে একাধিক সন্তান গর্ভে বড় করার জন্য। আবার মায়ের প্রাথমিক উপসর্গ, যেমন মর্নিং সিকনেস, বমি, অরুচি ইত্যাদিও অন্যদের তুলনায় বেশি হতে পারে। যমজ সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার বা সিজারের মাধ্যমে জন্মদানের হার বেশি।

গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো ও আর্তেমিস যমজ ছিলেন। যমজ ছিলেন ট্রয়ের হেলেন ও ক্লাইটেমনেস্ট্রাও। আবার তাঁদের দুই ভাই হেরাক্লিস ও পলিডিসিয়াসও যমজ ছিলেন।

কিছু মজার তথ্য

এক. ২০২১ সালে মরক্কোর ২৫ বছর বয়সী হালিমা সিসে একসঙ্গে ৯টি সন্তান জন্ম দেন। এটিই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিশু একসঙ্গে জন্ম নেওয়ার রেকর্ড। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ননুপ্লেটস’। নয়টি শিশুই এখন পর্যন্ত সুস্থ-সবল আছে।

দুই. রুশ দম্পতি ভ্যালেন্সিনা ভেসিলিভা ও ফিওদর ভেসিলিয়েভ ১৭২৫ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে ১৬ জোড়া টুইন, ৭ সেট ট্রিপলেট এবং ৪ সেট কোয়াড্রিপ্লেট শিশুর জন্ম দেন—মানে মোট ৬৯টি শিশু!

তিন. পশ্চিম আফ্রিকার একটি ছোট দেশ বেনিনে অজানা কারণে যমজ শিশু জন্ম দেওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি হাজারে ২৮টি যমজ গর্ভধারণের ঘটনা ঘটে এখানে। বিশ্বের অন্যত্র এ হার হাজারে ১৩। একইভাবে নাইজেরিয়ার ইগবো-ওরা নামের একটি গোত্রের আবাসের নামই দেওয়া হয়েছে ‘ল্যান্ড অব টুইনস’ বা যমজদের দেশ।

চার. ইরানে কুইনটুপলেটস বা চারটি শিশুর একসঙ্গে জন্ম হলে সরকার সেই পরিবারকে বিনা মূল্যে বাসস্থান ও শিক্ষার সুযোগ দেয়।

পাঁচ. প্রায় ৪০ শতাংশ টুইন বা যমজ নিজেদের মধ্যে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে। একে বলে ইডিওগ্লসিয়া। এই ভাষা তারা দুজন ছাড়া আর কেউ বোঝে না।

ছয়. আইডেন্টিক্যাল টুইনদেরও আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভিন্ন থাকে!

মিথ ও ইতিহাসের বিখ্যাত যমজেরা

গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো ও আর্তেমিস যমজ ছিলেন। যমজ ছিলেন ট্রয়ের হেলেন ও ক্লাইটেমনেস্ট্রাও। আবার তাঁদের দুই ভাই হেরাক্লিস ও পলিডিসিয়াসও যমজ ছিলেন। রোমের পত্তন করেছিলেন রেমোস ও রোমিয়াস নামের যমজ ভাই। সেই কারণে রোমানরা যমজ সন্তান হওয়াকে আশীর্বাদ মনে করতেন। দশরথ–সুমিত্রা দম্পতি যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন—লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। হিন্দু মিথোলজিতে ইন্দ্র ও অগ্নি পরস্পরের মিরর ইমেজ বা আইডেন্টিক্যাল টুইন।

১৮১১ সালের ১১ মে থাইল্যান্ডে জন্ম হয় চেং এবং এং বাংকার নামে যমজ শিশুর। তারা দুজন বুকের মাঝামাঝি স্টারনাম হাড়ে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। থাইল্যান্ডকে তখন বলা হতো ‘সিয়াম’ (সেখান থেকেই শ্যাম দেশ নামকরণ), তাই এই ভ্রাতৃদ্বয় ‘সিয়ামিজ টুইন’ নামে পরিচিত পায়। এখনো যেসব যমজ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় জন্ম নেয়, তাদের সিয়ামিজ টুইন বলে। এখন যুক্ত শিশুদের আলাদা করার মতো অস্ত্রোপচার করা গেলেও তখন তা ছিল না। ফলে চেং ও এং বার্নাম সার্কাসে যোগ দেয় এবং এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ও আদৃত হয়। পরবর্তী সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকত্ব দেয়। ১৯৮১ সালে হোয়াইট হাউসের প্রথম যমজ সন্তান জেনা ও বারবারা বুশের জন্ম হয় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ঔরসে। ব্রিটিশ টুইন বোন এনা পো ও লিলি মিলওয়ার্ড ১০২তম জন্মদিন পালন করে সবচেয়ে বয়স্ক টুইনের রেকর্ড গড়েছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা