আমাদের দেহের আদর্শ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রায় দেহ একদম সুস্থ। ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারে। তাপমাত্রা এর চেয়ে কিছু কম-বেশি হলেও কাজ চালিয়ে নিতে পারে দেহ। কিন্তু পার্থক্যটা কয়েক ডিগ্রি হলে দেহের ভেতরে শুরু হয় গোলমাল। কারণ তাপমাত্রা প্রাণিদেহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর কমা-বাড়ার কারণে দেহের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যহত হলে, দেহ নিজেই নানাভাবে চেষ্টা করে তাপমাত্রাকে সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য।
অতি ঠান্ডার কারণে যে ধরনের শারীরিক জটিলতা হয়, তার নাম হাইপোথার্মিয়া। সাধারণত দেহের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে হলে মৃদু হাইপোথার্মিয়া শুরু হয়। তাপমাত্রা কমে গেলে, তা বাড়ানোর জন্য দেহ নিজস্ব উপায়ে তাপ তৈরি বা সঞ্চয় করে। যেমন এ জন্য দেহ রক্ত সরিয়ে নেয় ত্বক বা চামড়া থেকে। ত্বকে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয়। কারণ বাইরের পরিবেশের প্রভাবে ত্বকই সবার আগে তাপ হারায়। ত্বকের নিচ থেকে রক্ত সরিয়ে নিয়ে এই প্রভাব এড়াতে যথাসম্ভব চেষ্টা করে দেহ।
দেহ এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম ঠিক রাখাকে গুরুত্ব দেয়। আর সে জন্য কাজে লাগায় রক্তের উষ্ণতাকে। এ ছাড়া এ সময় পেশি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকুচিত বা প্রসারিত হয়। দেহে জমা জ্বালানী কাজে লাগিয়ে শরীর কিছুটা গরম রাখতেই পেশির এমন সংকোচন-প্রসারণ। এ ব্যাপারটিকে আমরা বলি কাঁপুনি। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় দেহের কাঁপুনি বাড়ে। তবে দেহ এর চেয়ে আরও শীতল হলে কাঁপুনি কমতে থাকে। স্নায়ু সংযোগ স্থবির হয়ে আসে। কথা জড়িয়ে যায়। চেতনায় শুরু হয় দ্বন্দ্ব।
দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে অবস্থা মারাত্মক হতে পারে। এ সময় দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। তবে দেহের তাপমাত্রা আরও কমলে কাঁপুনি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি মারাও যেতে পারেন।
তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে দেহ নিজেকে উষ্ণ করে তোলার ক্ষমতা হারায়। এ অবস্থায় অনেকেই মৃত্যু বরণ করেন।
হাইপোথার্মিয়ার ঠিক উল্টো হাইপারথার্মিয়া। আমাদের দেহে আছে স্বয়ংক্রিয় তাপ নিষ্কাশন পদ্ধতি। দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে সাধারণত ঘাম হয়। ঘামের মাধ্যমে অতিরিক্ত তাপ বেরিয়ে যায়। ঘাম হিসেবে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া তরল বাষ্পীভূত হয়ে কিছুটা তাপ কমিয়ে দেয় শরীরের।
তবে শরীর কোনো কারণে অতিরিক্ত তাপ বের করে দিতে না পারলে অভ্যন্তরীন তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এ সময় মাথা ঘোরা ও বমি বমি ভাব হতে পারে। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেতে পারে শরীরে পানি শূন্যতা তৈরি হওয়ায়। হতে পারে মাথাব্যথা। একই কারণে এ সময় শরীরের রক্তনালী প্রসারিত হয়। ত্বকের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় উষ্ণ রক্ত। রক্তের ঘনত্ব এ সময় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। ফলে হ্রাস পায় রক্তচাপ। এ জন্য মাথা ঘোরা বেড়ে যাওয়াসহ অজ্ঞান হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
দেহের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে দেহকোষ বিকৃত হওয়া শুরু করে। কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। এমনকি কোষ মারাও যেতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা না করলে হতে পারে হাইপারথার্মিয়া। এতে অঙ্গ-বিকল হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ সময় হিট স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুও হতে পারে।
বুঝতেই পারছেন, অতি ঠান্ডা বা অতি গরম দুটোই আমাদের জন্য প্রাণঘাতী। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে বুঝবেন কেউ হাইপোথার্মিয়া বা হাইপারথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কি না? চলুন, একজনরে লক্ষণগুলো দেখে নেওয়া যাক।
হাইপোথার্মিয়া
নিম্ন তাপমাত্রা: এটি দৈহিক লক্ষণ নয়। চারপাশের তাপমাত্রা কম কি না, শীত শীত লাগছে কি না, সেটা প্রথমে দেখতে হবে। তাপমাত্রা কম না হলে বাকি লক্ষণগুলো হাইপোথার্মিয়ার নয়।
ভ্রান্তি: অতিরিক্ত ঠান্ডা মানুষের ইন্দ্রীয়কে প্রভাবিত করে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি নিদ্রাহীনতা ও ভ্রান্তি বোধ করতে পারেন।
শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তন: হাইপোথার্মিয়া বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাসের গতি কমে যেতে পারে।
কাঁপুনি: দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বাড়লে পেশিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। শরীরকে উষ্ণ করে তোলার জন্য শুরু হয় কাঁপুনি। তবে হাইপোথার্মিয়ার আগে শরীরের কাঁপুনি হঠাৎ কমে যেতে পারে।
ফ্যাকাশে ত্বক: ত্বকের রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়। দেহকে উষ্ণ করতে কাজে লেগে পড়ে রক্ত। এভাবে কিছুটা তাপ সংরক্ষণ হয় বটে, কিন্তু ত্বক ক্রমেই ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে।
হাইপারথার্মিয়া
উচ্চ তাপমাত্রা: এটি দৈহিক লক্ষণ নয়। চারপাশের তাপমাত্রা বেশি কি না, প্রচণ্ড গরম লাগছে কি না, সেটা প্রথমে দেখতে হবে। তাপমাত্রা বেশি না হলে বাকি লক্ষণগুলো হাইপারথার্মিয়ার নয়।
মাথা ঘোরা: রক্তনালী স্ফীত ও রক্তে তরলের পরিমাণ কমার কারণে কমে যায় রক্তচাপ। এজন্য মাথা ঘোরা মতো অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
তৃষ্ণা: ঘামের কারণে যেহেতু শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়, তাই এ সময় প্রবল তৃষ্ণা বোধ হয়।
ঘাম: ঘাম ত্বককে শীতল করে। কারণ ঘাম হিসেবে শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া তরল বাষ্পীভূত হয়ে কিছুটা তাপ কমিয়ে দেয় শরীরের।
প্রসারিত রক্তনালী: রক্তনালী প্রসারিত হয় হাইপারথার্মিয়ার সময়। ফলে ত্বকের কাছে চলে আসে উষ্ণ ও ঘন রক্ত। হাইপারথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আগে রক্তনালী ফুলে উঠতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস ম্যাগাজিন