লাল রঙের একটি ফুলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটি মৌমাছি। উড়ে গিয়ে বসল ফুলটার ওপর। মৌমাছিটা একটা মিশনে আছে। ফুলটা থেকে মধু আর পরাগ সংগ্রহ করবে। মধু ওদের শক্তির মূল উৎস, আর পরাগ হলো মৌমাছির লার্ভাদের পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু মৌমাছিটা কীভাবে বুঝল, লাল ফুলটায় মধু আছে?
সাধারণভাবে চিন্তা করলে মনে হতে পারে, ফুল তো খোলা বইয়ের মতো! সুগন্ধ আর উজ্জ্বল রঙের সাহায্যে পোকামাকড়কে আহ্বান জানায় ফুল। আর পোকামাকড় গিয়ে সহজেই মধু ও পরাগ খুঁজে নেয়। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা এত সরল নয়।
নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ক্যাসপার ভ্যান ডের কুই। তাঁর মতে, ‘উদ্ভিদ সবসময় পোকামাড়ককে সত্যি কথা বলে না।’ জীববিজ্ঞানী ক্যাসপারের কথাটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। আসলে উদ্ভিদের পরাগ তৈরি করতে অনেক শক্তি আর পুষ্টি খরচ হয়। গাছের সবসময় লক্ষ্য থাকে পলিনেশন বা পরাগায়ন করার। মানে এক ফুলের পরাগ অন্য ফুলে পৌঁছানো। কারণ পরাগায়ন ছাড়া বীজ উৎপাদন সম্ভব নয়। কিন্তু যদি ভুল পোকা এসে পরাগ নষ্ট করে ফেলে, তাহলে উদ্ভিদের সব পরিশ্রমই মাঠে মারা যাবে। তাই অনেক গাছ তাদের পরাগ আড়াল করে রাখে, যাতে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পোকাই এটি খুঁজে পায়। তবে পুরোপুরিও লুকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ তাতে নির্দিষ্ট পোকামাকড় বুঝতেই পারবে না যে এই ফুলের পরাগায়ন হয়নি।
এককথায়, উদ্ভিদ পরাগ সম্পূর্ণ ঢেকেও রাখতে পারে না, আবার পুরোপুরি খুলেও রাখে না। এ কারণে উদ্ভিদ ও পোকাদের মধ্যে একধরনের কৌশলী খেলা চলে—ফুল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গোপন সংকেত ব্যবহার করে, আর পোকামাকড় ধাপে ধাপে শিখে নেয় সেই সংকেতের মানে কী। এতে উদ্ভিদের পছন্দের পোকামাকড়ই শুধু ওই ফুলে বসতে পারে।
তবে সব সময় উদ্ভিদ এতে সফল হয় না। মাঝেমধ্যে অন্যান্য পোকামাকড় এসে মধু খেয়ে যায়, নষ্ট করে দেয় পরাগ। কিন্তু উদ্ভিদ এক্ষেত্রে কোন ধরনের সংকেত ব্যবহার করে?
ফুল আর পোকামাকড়ের এই সাংকেতিক ভাষায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে দৃশ্যমান সংকেত। পোকাদের চোখ মানুষের চেয়ে ভিন্নভাবে কাজ করে। মানুষ যেভাবে পৃথিবীকে দেখে, পোকামাকড় ঠিক সেভাবে দেখে না। মৌমাছি আর প্রজাপতিরা সাধারণত নীল আর বেগুনি রঙের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়, অন্যদিকে মাছি বেশি পছন্দ করে হলুদ ফুল। এমনকি কিছু ফুল আছে যেগুলো অতিবেগুনি রশ্মি নির্গত করে এবং পোকামাকড় তা দেখে বুঝতে পারে।
কিছু ফুলে ‘নেকটার গাইড’ নামে একধরনের বিশেষ নকশা থাকে যা মানুষ দেখতে পারে না। কিন্তু অতিবেগুনি আলোতে তা দেখতে পারে পোকামাকড়। এই বিশেষ আলোর দিশা অনুসরণ করেই মৌমাছিরা মধু আর পরাগের সন্ধান পায়।
গন্ধও একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। প্রতিটি ফুলের নির্দিষ্ট সুগন্ধ থাকে, যা পরাগায়নের জন্য নির্দিষ্ট পোকাদের আকৃষ্ট করে। কিছু ফুল পরাগানের পর গন্ধ কমিয়ে দেয়, যাতে পোকারা বুঝতে পারে যে এতে নতুন পরাগ নেই। উদাহরণ হিসেবে ব্লুবেরি ফুলের কথা বলা যায়। এই ফুল পরাগায়িত হওয়ার পর গন্ধ কমে যায়। আর গন্ধ কম থাকলেই মৌমাছিরা বুঝে নেয়, ওই ফুলে গিয়ে লাভ নেই।
আরও মজার বিষয় হলো, ফুলের চারপাশের বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রও বুঝতে পারে পোকামাকড়। প্রতিটি ফুলের নিজস্ব দুর্বল বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র থাকে। ফুলের আকৃতির ওপর নির্ভর করে এই ক্ষেত্র তৈরি হয়। ফুলে একবার পোকা বসলে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বদলে যায়। পরে কোনো পোকা এসে এই পরিবর্তন সহজে শনাক্ত করে বুঝতে পারে, আগেই কোনো পোকা এখানে এসেছিল। বাম্বেলবি বা বড় মৌমাছির গায়ে সংবেদনশীল লোম থাকে। এরা এই লোমের সাহায্যে বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের পরিবর্তন টের পায়!
তবে একই প্রজাতির প্রতিটি পোকা সবসময় একরকম সিদ্ধান্ত নেয় না। কিছু পোকা সবসময় নির্দিষ্ট ফুলের পরাগ সংগ্রহ করে। তবে কিছু অভিজ্ঞ পোকা নতুন ফুল খুঁজেও পরাগ সংগ্রহ করে। এরা চারপাশের পরিবেশ থেকে শেখে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা প্রকৃতির এক অসাধারণ নকশা, যেখানে ফুল এবং পোকামাকড় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ফুল পরাগরেণু সুরক্ষিত রাখতে চায়, আবার পোকামাকড় থাকে খাদ্যের সন্ধানে। এই সম্পর্কটা এতই নিখুঁত যে, একে প্রকৃতির এক অপূর্ব সমন্বয় বলা যায়। এই চলমান সম্পর্কের কারণেই আমাদের চারপাশের প্রকৃতি ফুলে-ফলে এত সুন্দরভাবে টিকে আছে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স