চঞ্চল পাখি সাদা খঞ্জন

ছন্দময় ভঙ্গিতে দুলতে দুলতে উড়ে এসে পাখিগুলো নেমে পড়ে ছোট নদীটার এপারের বালুভূমিতে। নেমেই ওগুলো পিলপিল পায়ে দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। যে রকম দুলতে দুলতে উড়ে নদী পাড়ি দিয়েছে ওরা, অনেকটাই সে রকমভাবে লম্বাটে লেজটা দোলাচ্ছে ওরা ওপর-নিচ করে। সে দুলুনি মনোমুগ্ধকর, ছন্দময় ও শৈল্পিক। ওরা হাঁটছে—আসলে দৌড়াচ্ছে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ওরা তখন দৌড়াচ্ছে, যখন ওদের খাদ্য নানা জাতের পোকামাকড় উড়ে বা দৌড়ে পালাতে চাইছে। কেউ কেউ তো লম্ফঝম্ফ করে ছিটকে উঠে উড়ন্ত পোকাকে পেড়ে ফেলছে দুটি পাখার বাতাস ঢেলে দিয়ে। ওরা এগোচ্ছে আগপিছ করে, কার আগে কে যাবে, প্রতিযোগিতাও যেন চলছে। এদিক–ওদিক থেকে আসছে একই ধরনের আরও কিছু পাখি, নামছে বালুভূমিতে। লেজ নাচাচ্ছে দ্রুত তালে, চলছে পিলপিল পায়ের দ্রুত হাঁটা বা দৌড়। শীতের পড়ন্ত বেলার সোনারোদ পড়ে মনে হচ্ছে—সাদাকালো রঙের চঞ্চল ছিপছিপে পাখিগুলো নদীতীরে নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর ‘ডিসপ্লে’ দেখাচ্ছে।

ওদের মূল খাবার পোকামাকড়। খুদে শামুকও সুযোগ পেলে খায়। মূল চারণভূমি মাটি, অর্থাৎ হাওর-বাঁওড়ের তীর তথা শুকনো বা আধভেজা ভূমি, নদীচর, মোহনা, চষা খেতসহ যেকোনো মাঠঘাট। গাছে বসে খুব কম ক্ষেত্রেই। এরা চলার ওপরেই থাকে। বলা যায় ‘যেখানে রাত, সেখানেই কাত’। সন্ধ্যা হলে ছোট বা বড় ঝাঁক বেঁধে আখখেত-বাঁশবন-নলখাগড়া বন-ঝাউবন-শ্যাওড়াগাছ-কেয়াঝোপসহ ঘন পাতাওয়ালা গাছে রাতের আশ্রয় নেয়। যে লেজ সর্বক্ষণ ওপর-নিচে দোলায়, ঘুমিয়ে গেলেই কেবল বন্ধ হয় তা। পরদিন ভোরে আবারও শুরু হয় চলা। এভাবে সারা দেশ ঘুরে বেড়ায় এরা।

সূর্য ডুবুডুবু। পাখিগুলো উড়াল দেয়। আবার দুলতে দুলতে ওড়ে পশ্চিমে। অস্তমিত সূর্যের সোনালি আভায় পাখিগুলোকে দেখাচ্ছে দারুণ। রঙিন ডিসপ্লেও দেখা যায় মাঝেমধ্যে। ওরা যেন চলেছে সূর্য অভিযানে।

ছিপছিপে লম্বাটে গড়নের শীতের পরিযায়ী অতিচঞ্চল-সুন্দর এই পাখিদের নাম ‘সাদা খঞ্জন’ বা ‘ছোট খঞ্জন’। কপাল-চিবুক-গলা-বুক-পেট শরতের সাদা মেঘের চেয়েও সাদা। শুধু বুকের উপরিভাগে একছোপ কালো রং আছে। মাথার পেছন দিকটা এবং পিঠ ও ডানার উপরিভাগটা কালো, কালচে অথবা ধূসর-কালো। ছোট ঠোঁটটি ও পা দুখানা কালো। যখন বিশ্রাম করে, তখন কখনো কখনো এক পায়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়-ঝিমায়। এরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে সেপ্টেম্বরে, ভরা শীতে প্রচুর পাখি দেখা যায় বাংলাদেশের সব প্রান্তে। রাজধানী ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে এদের উড়ে যেমন অন্যদিকে যেতে দেখা যায়, তেমনি এই শহরের দালানকোঠার ছাদেও চরতে দেখা যায়। খুব ভোরে রাজপথ-ফুটপাত ও বড় বড় ক্যাম্পাসেও দেখা যায়—পিলপিল পায়ে হাঁটছে, দোলাচ্ছে লেজ। পার্ক-উদ্যানেও চোখে পড়ে। এমনকি এই শহরের দেবদারুগাছে রাতও কাটায়।

উড়লেই এরা মিষ্টি ধাতব কণ্ঠে ডাকে ‘সিসিক্ সিসিক্’ বা ‘ছিক ছিক’ শব্দে। সুরেলা ডাকটা শুনতে ভালোই লাগে। এরা ঝাঁকে চলে, একাকী চরে বা দু-পাঁচটি পাখি একত্রে চরে। মাটিতে নেমেই এরা পিলপিল পায়ে যেমন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, তেমনি বিপদ বুঝলে স্থির হতেও জানে। ছিটকে উঠে উড়াল দিতেও পারে। রাতটা কাটায় এরা দলবদ্ধভাবে।

ক্বচিৎ খেজুরের রস পান করে এরা। তবে এদের খেজুরের নলিতে বসতে দেখলে অন্য রসখেকো পাখিরা তেড়ে আসে। কাঠবিড়ালিরাও তাড়া করতে চায় অনেক সময়। এমন দৃশ্য দেখার পাশাপাশি ঢাকার মান্ডা খালপাড়ের কলাঝাড়ের পাতায় ক্ষণিক বসার পরে দারুণ একটা দৃশ্য আমি দেখেছিলাম। কলাপাতার তলায় ঝুলে ছিল দুটি ছানা বুকে নিয়ে একটি চামচিকা, ওটি ছানা দুটিকে বুক থেকে সরিয়ে কলাপাতায় ঝুলিয়ে দিয়ে বেরিয়েই উড়ে এসে আক্রমণ করতে চাইল সাদা খঞ্জনটিকে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভীত খঞ্জন ঊর্ধ্বলম্ফ দিয়ে ডাকতে ডাকতে পগার পার হয়ে গেল। চামচিকাটি আবারও ঝুলল কলাপাতার তলায়। ছানা দুটি তখন আবার ঝুলল মায়ের বুকে।

সাদা খঞ্জনের ইংরেজি নাম White Wagtail. বৈজ্ঞানিক নাম Motacilla alba. দৈর্ঘ্য ১৮ সেমি। তার ভেতরে শুধু লেজটাই ৯ সেমির বেশি।

লেখক: পাখিবিশারদ

ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান