আঠা ছাড়া কাঁঠাল

ভরদুপুরে প্লেটে এল কাঁঠাল। স্থান রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকায় অবস্থিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মধ্য ভবনের ৭৩১ নম্বর কক্ষ। এই কক্ষে বসেন মো. মেহেদী মাসুদ। তিনি অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক। তাঁর আমন্ত্রণেই সেখানে কাঁঠাল খেতে যাওয়া।

এই কাঁঠাল যেনতেন কাঁঠাল নয়। এক বিশেষ ধরনের কাঁঠাল। দেখতে আমাদের কাঁঠালের মতোই সবুজ রঙের। এটাকে বলা হয় গামলেস বা আঠালো কষবিহীন কাঁঠাল। কয়েকটি কোয়া মুখে নিলাম। মিষ্টি একটু কম, তবে ঘ্রাণ একই। জ্যেষ্ঠ কৃষিবিদ মেহেদী মাসুদ বললেন, কাঁঠালটি পুরোপুরি পাকেনি। পাকলে দেশি কাঁঠালের চেয়েও ঘ্রাণ ও মিষ্টতা বেশি হয়। প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেনসহ যাঁরা পাকা এই কাঁঠালের স্বাদ গ্রহণ করেছেন, তাঁরা সবাই এ ব্যাপারে একমত হলেন।

কষবিহীন আরও অন্তত দুই ধরনের কাঁঠাল এখন বাংলাদেশে চলে এসেছে। গোলাপি ও লাল। দেখতে যেমন, আবার এর কোয়াও তেমন।

গল্পের আসর শেষে মেহেদী মাসুদ বলছিলেন কষবিহীন এই কাঁঠালের ঠিকুজি আর এ দেশে এর সম্ভাবনার কথা। এই কাঁঠাল তিনি আনিয়েছেন গাজীপুরের মৌচাকে অবস্থিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘মাতৃবাগান’ থেকে। জানা গেল, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’–এর আওতায় ২০১৬ সালে ১০ একর আয়তনের এই মাতৃবাগানে ৪০ রকম ফলের ১১২ জাতের মোট ১ হাজার ২৬৮টি চারা কলম রোপণ করা হয়েছে। উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ, লুপ্তপ্রায়, ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন এবং দেশে চাষের উপযোগী বিদেশি ফলের চারা কলম সংগ্রহ, রোপণ, উৎপাদন, বিক্রয় ও বিতরণের মাধ্যমে পুরো দেশে এর কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মাতৃবাগানটি তৈরি করা হয়। কৃষিবিদ মেহেদী মাসুদ ২০১৬ সালে ভিয়েতনাম থেকে এই কাঁঠালের একটি কাটিং নিয়ে আসেন দেশে। তারপর বেশ যত্ন করে লাগিয়ে দেন মাতৃবাগানে। পর্যায়ক্রমে সেখানে আরও ৫০টি গামলেস কাঁঠাল লাগানো হয়। তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে ফল দিতে শুরু করেছে গাছগুলো।

গাছে উৎপাদিত সবচেয়ে বড় ফল হচ্ছে কাঁঠাল। একটা কাঁঠাল ১০০ পাউন্ড বা ৪৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। আমরা জানি, একটা কাঁঠালের কোনো অংশই ফেলনা নয়। পাকা কাঁঠালের কোষ সুস্বাদু খাবার, খোসা গরু-ছাগলের খাদ্য, কাঁচা কাঁঠালের তরকারি অনন্য স্বাদের, কাঁঠালের বিচি খাওয়া যায় পুড়িয়ে, রান্না করে বা ভর্তা করেও। কাঁঠালগাছের কাঠ দিয়ে বানানো যায় উন্নতমানের আসবাব।

কাঁঠালকে বলা হয় মাংসের বিকল্প। এটা হলো ‘ভেজিটেবল মিট’। পাশ্চাত্যে স্যান্ডউইচ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ভেজিটেবল মিট। চিকেনের তৈরি স্যান্ডউইচ থেকে কাঁঠালের তৈরি স্যান্ডউইচের দামও বেশি। এ ছাড়া কাঁঠাল দিয়ে হচ্ছে চিপস, আচার, কেক সবই।

এফএওর ২০১৬ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল হয় ভারতে, ১৮ লাখ টন। দ্বিতীয় অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ, ১০ লাখ টন। ১৫০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীন কাঁঠাল আমদানি বাড়াচ্ছে। জাপান ও মালয়েশিয়াও কাঁঠাল আমদানি করছে। কিন্তু তারা বাংলাদেশ বা ভারত থেকে কাঁঠাল আমদানি করে না। করে উৎপাদনে তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে। কারণ, আমাদের কাঁঠালে আঠা থাকে, আর থাকে একধরনের বুনো ঘ্রাণ, যা পূর্ব এশিয়ার মানুষ সহ্য করতে পারে না।

কাঁঠাল গাছ

তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই অঞ্চলের কাঁঠাল আমদানি করে। কিন্তু সেই বাজার বাংলাদেশ দখল করতে পারছে না, করেছে ভারত।

বাংলাদেশ ও ভারতে সাধারণত দুই জাতের কাঁঠালের আবাদ হয়। গালা ও খাজা। গালা কাঁঠাল নরম, খাজা শক্ত। এর মাঝামাঝি আরেকটি জাত আছে, নাম রসখাজা। এর বাইরে হাজারি কাঁঠাল নামে আরেকটি জাত রয়েছে। এ ছাড়া ভারতে রুদ্রাক্ষী, সিলোন, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ নামে নানা জাতের কাঁঠাল আছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট সূত্র জানাচ্ছে, এ পর্যন্ত কাঁঠালের তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছে তারা। এর মধ্যে বারি-১ জাতের উচ্চফলনশীল কাঁঠাল পাওয়া যাবে মে-জুন মাসে, উচ্চফলনশীল অমৌসুমি জাত বারি-২ পাওয়া যাবে জানুয়ারি-এপ্রিল মাসে। প্রত্যন্ত এলাকায় সারা বছর ফল দেওয়া একটি কাঁঠালের সন্ধান পাওয়ার পর খাগড়াছড়ির রামগড়ের পাহাড় অঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ২০১১ সালে গাছটি নিয়ে গবেষণা করেন। তিন বছর গাছটির সার্বিক তত্ত্বাবধান, পরিচর্যা ও জার্মপ্লাজম নির্বাচন করে একটি নতুন জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হন। নাম দেওয়া হয় বারোমাসি বারি-৩। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভাষ্য, সারা দেশেই আবাদযোগ্য এই তিন জাত। কিন্তু এই জাতগুলো সম্পর্কে কৃষকেরা কতটা অবগত, কতটা তাঁদের কাজে লাগছে আর কতটা আবাদ হচ্ছে, সেটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ।

আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম, কিন্তু জনসংখ্যায় অষ্টম। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এক যুগ আগেও দেশে ৫৬ প্রজাতির ফলের চাষ হতো। বর্তমানে চাষ হচ্ছে ৭২ প্রজাতির ফলের। দিন দিন নতুন জাতের ফলের আবাদের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। মানুষের ফল খাওয়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।

একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। তা হলো কষবিহীন গোলাপি ও লাল রঙের কাঁঠাল কিন্তু ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার স্থানীয় কোনো জাত নয়। কেবল রপ্তানির কথা মাথায় রেখে সেখানকার বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেই এমন উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এখন পর্যন্ত এমন কিছু উদ্ভাবন করতে পারেননি। তাঁরা যে তিন জাত উদ্ভাবন করেছেন, তা কেবল উচ্চফলনশীল ও দীর্ঘ মৌসুমের।

কষ বা আঠাবিহীন কাঁঠালের চাহিদা বিশ্বব্যাপী দিন দিন বাড়ছে। এই জাত আমাদের মাটির পক্ষে উপযোগী, বিশেষ করে পাহাড়ি ও একটু উঁচু জমিতে এই কাঁঠাল ফলবে। নিচু জমিতে হবে না। এই কাঁঠালের দামও প্রায় তিন গুণ বেশি। গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. ইমরুল কায়েস জানালেন, অন্তত আরও পাঁচ–সাত বছর লাগবে কৃষক পর্যায়ে এটি নিয়ে যেতে। তিনি নিজেও থাইল্যান্ড থেকে ১০০টি গোলাপি ও লাল কাঁঠালের চারা এনে গাজীপুরের শ্রীপুরে তাঁর বাড়িতে রোপণ করেছেন। তাঁর ভাষ্য, কৃষক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে ব্যাপকসংখ্যক কলম ও চারা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে জাত উন্নয়নের জন্য অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কাজ করতে হবে কাঁঠালের বহুবিধ ব্যবহার নিয়েও।

জ্যেষ্ঠ কৃষিবিদ ও ফল বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, জাতীয় ফল হিসেবে কেবল কাঁঠালের জন্যই সরকার যদি পৃথক কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে, তবে এ কাজে গতি সঞ্চার হতে পারে।

তবে সব সময় প্রকল্প গ্রহণ ও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করলেই সব কাজ হয় না। এমন বহু উদাহরণ আমাদের দেশে রয়েছে। আমাদের দরকার আন্তরিক মানুষ, যিনি দেশের কৃষি খাত ও এ দেশের কৃষকদের ভালোবেসে কাজ করবেন।

লেখক: সাংবাদিক