দেশের প্রথম জলহস্তীর কঙ্কাল পবিপ্রবিতে

দেশের প্রথম জলহস্তীর কঙ্কাল যুক্ত হলো পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) জাদুঘরে। লিওন নামের এই জলহস্তীর কঙ্কাল কীভাবে তৈরি করা হলো? এর পেছনের কথা, কঙ্কাল প্রস্তুত করার নানা ধাপ ও প্রক্রিয়া সবিস্তারে পড়ুন...

পবিপ্রবিতে দেশের প্রথম জলহস্তীর কঙ্কাল

দেশের প্রথম জলহস্তীর কঙ্কাল যুক্ত হলো পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) জাদুঘরে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যানিম্যাল সায়েন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের অ্যানাটমি অ্যান্ড হিস্টোলজি বিভাগের ল্যাবরেটরি সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে অ্যানাটমি মিউজিয়ামে যুক্ত করা হয়েছে এ কঙ্কাল।

জলহস্তী প্রাণিজগতের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ প্রাণী। এটিকে তৃণভোজী স্তন্যপায়ী হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়। সাধারণত দৈর্ঘ্যে ৩ দশমিক ৫ মিটার এবং উচ্চতায় ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত হয়। আর ওজন হতে পারে ৩ হাজার ২০০ কেজি বা এর বেশি। একসঙ্গে প্রায় ৩৫ কেজি খাবার খেতে পারে জলহস্তী। আকারে বড় হলেও প্রাণীটি দক্ষ সাঁতারু। এদের গড় আয়ু প্রায় ৪০ বছর। বাংলাদেশে বড় বড় চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কগুলোয় এদের দেখতে পাওয়া যায়। তবে কখনো এই প্রাণীর কঙ্কাল তৈরি করা হয়নি। এবারই প্রথম জলহস্তীর কঙ্কাল তৈরি করা হল পবিপ্রবিতে।

কঙ্কাল তৈরিতে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরা
কঙ্কাল তৈরিতে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরা

ঘটনার শুরু ২০২১ সালে।   রংপুর চিড়িয়াখানায় সে বছর ফেব্রুয়ারির শুরুতে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায় একটি জলহস্তী। নাম, লিওন। চিড়িয়াখানার ভেতরেই এটিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়। চিড়িয়াখানার জ্যু অফিসার এইচ এম শাহাদাৎ হোসেনের কাছে এ কথা জানতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী মো. তারিকুর রহমান। তিনি বিষয়টি পবিপ্রবির অ্যানাটমি অ্যান্ড হিস্টোলজি বিভাগে জানান। এরপর শুরু হয় দাপ্তরিক প্রক্রিয়া। তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসেনের প্রচেষ্টায় ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এর কঙ্কাল বানানোর অনুমতি দেয়। তবে সে জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও ছয় মাস। পরিবেশ দূষণ রোধে ৬ মাস অপেক্ষার পর জলহস্তীটির দেহাবশেষ বের করা হয়। সে দিন ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১। যথাযথভাবে প্যাক করে এই দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় পবিপ্রবির বরিশাল ক্যাম্পাসে। তবে তখনো হাড়ের চারপাশে রয়ে গেছে পঁচা মাংসপিণ্ড ও দূষিত মাটি।

এগুলো পরিষ্কারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের সাহায্য নেয়। স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরা গরম পানি ও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দিয়ে সব হাড় সেদ্ধ করে পরিষ্কার করে। পাশাপাশি হাড়ের আবরণ যেন নষ্ট না হয়, সে জন্যও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক মেশানো হয়। তারপর চার মাস রোদে শুকানো হয় কঙ্কালটিকে। তবে কিছুদিন পরপর এটিকে সম্পূর্ণ অন্ধকার ও বদ্ধ পরিবেশে রাখতে হতো। আবার কিছু হাড়খেকো পোকা আছে। এদের দমনের জন্য কীটনাশকও দেওয়া হয়।

প্যাকেজিং খুলে পঁচা মাংস, হাড় পরিস্কারের কাজ শুরু করেছেন স্বেচ্ছাসেবী দুই শিক্ষার্থী
তবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন, সব হাড় আছে কি না। বিভিন্ন বই ও গবেষণাপত্র দেখে সেটা নিশ্চিত করা হয়। এ সময় কিছুদিন পরপর বিশেষ রাসায়নিক দিতে হতো হাড় সংরক্ষণের জন্য। রড ও কাঠের কাঠামোতে সবগুলো হাড় যুক্ত করা হয় এভাবে। এই পুরো কাজটি শেষ করতে লেগে যায় প্রায় ১১ মাস

পরের ছয়মাস ধরে চলে কঙ্কাল প্রস্তুতকরণ। প্রথম ধাপে শিরিষ কাগজে ঘষে হাড়ের চারদিকের শুকনো মাংস কণা তুলে ফেলা হয়। পরে হাড় সংরক্ষণের জন্য রাসায়নিক দেওয়া হয়। সেভাবেই প্রায় অর্ধমাস রেখে দিতে হয় কঙ্কালটিকে। তারপর আবার রাসায়নিকের আবরণ উঠিয়ে ফেলা হয়। পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয় এ সময়। জলহস্তী যেহেতু অনেক বড় প্রাণী, তাই হাড়ের সংখ্যাও অনেক বেশি। সে জন্য প্রথমে শরীরের বিভিন্ন স্থানের হাড়কে মাথা, মেরুদণ্ড (২ ভাগ) , হাত (২ ভাগ), পা (২ ভাগ), লেজ, কোমর, বক্ষপিঞ্জর—এভাবে ১০ ভাগ করে নেওয়া হয়। ভাগে ভাগে সব কাজ করেন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরা। ৫ মাস ধরে চলে এসব কাজ।

এরপর শুরু হয় জোড়া দেওয়া। সে জন্য জলহস্তীর আকার মেপে নিয়ে রডের একটি কাঠামোর নকশা করা হয়। তিন ধাপে এই কাঠামোটি বানিয়ে নিয়ে তারপর শুরু হয় হাড় মেলানো। তবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন, সব হাড় আছে কি না। বিভিন্ন বই ও গবেষণাপত্র দেখে সেটা নিশ্চিত করা হয়। এ সময় কিছুদিন পরপর বিশেষ রাসায়নিক দিতে হতো হাড় সংরক্ষণের জন্য। রড ও কাঠের কাঠামোতে সবগুলো হাড় যুক্ত করা হয় এভাবে। এই পুরো কাজটি শেষ করতে লেগে যায় প্রায় ১১ মাস।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক স্বদেশ চন্দ্র সামন্তের পৃষ্ঠপোষকতায়, অ্যানাটমি অ্যান্ড হিস্টোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মো. জাফরুল হাসান, মো. তারিকুর রহমান, রেজাউল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল ইমরান ও ইসতিয়াক হোসেন মূলত পুরো কাজটি করেন। তবে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও সহায়তা করেছেন এ কাজে নানাভাবে। এভাবেই তৈরি হয় দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জলহস্তী কঙ্কাল।

৪ / ২

বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সে কঙ্কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে প্রাণীর দৈহিক গঠন, উৎপত্তি, বয়স, লিঙ্গ নির্ধারণ, বিভিন্ন রোগ ও রোগে মৃত্যুর কারণ, প্রজাতির ভিন্নতাসহ নানারকম অ্যানাটমিক্যাল ও এনথ্রোপোলজিক্যাল বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আর গবেষণা খাতে কঙ্কাল একটি মূল্যবান প্রভাবক। পাঠদানের পাশাপাশি জাদুঘরে প্রদর্শনীর মাধ্যমেও অনেকে এসব কঙ্কাল দেখে শেখেন।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, ‘শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্রের সুরক্ষা দেয় কঙ্কাল। দেহের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও কঙ্কালের গুরুত্ব অনেক। তাই চিকিৎসা কার্যক্রম নির্ভুল করতে অ্যানাটমি, অর্থাৎ কঙ্কাল সম্পর্কে জানার বিকল্প নেই। আমরা জলহস্তীর কঙ্কাল তৈরি করার মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষের কল্যাণে এই প্রাণী সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে আরও গবেষণা করা। এ ছাড়াও আমাদের অ্যানাটমি মিউজিয়াম সমৃদ্ধির কাজ চলছে, যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও অন্য সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তখন এটি একইসঙ্গে শিক্ষা ও বিনোদনের উৎস হবে বলে আমি মনে করি।’

জলহস্তীর কঙ্কালের সামনে পবিপ্রবির ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) ডিসিপ্লিনের পাঁচ শিক্ষার্থী (বাঁ থেকে): ইসতিয়াক হোসেন, রেজাউল ইসলাম, মো. জাফরুল হাসান, অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল ইমরান ও মো. তারিকুর রহমান

এই কঙ্কাল তৈরির পাশাপাশি এই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি সমৃদ্ধ করতে টার্কি কঙ্কাল তৈরি করেছেন। এ ছাড়াও মেছো বাঘের কঙ্কাল, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কঙ্কাল ও কচ্ছপের কঙ্কাল তৈরির কাজ চলছে।