বাংলাদেশে উৎপাদিত প্যাকেটজাত খাবার অস্বাস্থ্যকর এবং খাদ্যের প্যাকেটে লেখা পুষ্টি উপাদানের তথ্য মিলছে না খাবারের সঙ্গে। ৩০ অক্টোবর, সোমবার প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে এ তথ্য। মার্কিন প্রকাশনা সংস্থা জন উইলি অ্যান্ড সন’স ইনকর্পোরেটেড বা উইলির ফুড সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন জার্নালের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এ গবেষণাটি করেছেন বাংলাদেশি একদল গবেষক।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্যাকেটজাত (প্রক্রিয়াজাত করে প্যাকেট করা) খাবার গ্রহণের হার। এসব খাবার আলাদা করে রান্না করতে হয় না। অল্প সময়েই খাওয়া যায়। ফলে দিনদিন এর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এসব খাবারের গায়ে পুষ্টির তথ্য লেখা থাকে। কিন্তু সে তথ্য কতটা সঠিক ও জনস্বাস্থ্যে এসব খাবার কেমন প্রভাব ফেলছে, তা জানতে গবেষণাটি করা হয়।
এ গবেষণার নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্র্যাকইউ) সহযোগী গবেষক এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এনএইচএফ) আবু আহমেদ শামীম এবং একই প্রতিষ্ঠানের এপিডেমিওলজি (মহামারিবিজ্ঞান) অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী। এ গবেষক দলের সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রভাষক স্নেহা সারওয়ার, এনএইচএফের গবেষক মো. মোশাররফ আশরাফ, একই প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ নিসর্গ বাহার, এনএইচএফের গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন, একই প্রতিষ্ঠানের গবেষক শেখ মোহাম্মদ মাহবুবুস সোবহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মো. জয়নুল আবেদীন, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) প্রোগ্রাম ও সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) গবেষক মো. রিজওয়ানুল করিম, একই প্রতিষ্ঠানের গবেষক মোহাম্মদ রবেদ আমিন এবং আব্দুল আলীম।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) কর্মসূচির অর্থায়নে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
গবেষকেরা দেশের প্রতিটি বিভাগের একটি শহর ও দুটি গ্রামের সাধারণ মুদি দোকান থেকে প্যাকেটজাত খাবারের নমুনা সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি এসব এলাকার ৪৮০টি পরিবারের ৯৪৮ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেন। এসব সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে খাবারের নমুনা নির্বাচন করেন তাঁরা। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চিপস, চানাচুর, মটরশুটি ভাজা, ডাল, নুডলস, বিস্কুট, লজেন্স, ললিপপ, চকলেট, চাটনি ও আইসক্রিম। এসব নমুনা সংগ্রহের পর প্রাথমিকভাবে পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের (আইএনএফএস) পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। পরে সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয় দেশ ও বিদেশের একাধিক গবেষণাগারে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডাল ভাজা, চানাচুর, লজেন্স এবং মটরশুটি ভাজায় যথাক্রমে আমিষ, ফ্যাট, শর্করা ও আঁশ বা ডায়েটরি ফাইবারের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। উচ্চ মাত্রায় ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (এসএফএ) পাওয়া যায় বিস্কুট ও মিল্ক চকলেটে।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসোসিয়েশন অব অফিসিয়াল অ্যাগ্রিকালচারাল কেমিস্টস (এওএসি) এবং অন্যান্য স্ট্যান্ডার্ড মডেল মেনে নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। প্যাকেটের গায়ে লেখা তথ্যের সঙ্গে খাবারের পুষ্টি উপাদান তুলনা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহনশীলতা নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়। জনস্বাস্থ্যের ওপর এসব খাবারের প্রভাব মাপা হয় হেলথ স্টার রেটিং এবং ইউকে ট্রাফিক লাইট সিস্টেম মেনে।
নমুনার প্রায় অর্ধেক পণ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিডের পরিমাণে ৪৬ শতাংশ গড়মিল পাওয়া গেছে। আমিষ, শর্করা, চর্বি, চিনি ও লবণের পরিমাণে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে পাঁচভাগের একভাগ পণ্যে। গবেষণায় কোনো পণ্যই পুষ্টিমান বিবেচনায় যুক্তরাজ্যের ট্রাফিক লাইট সিস্টেমের সবুজ সংকেত পায়নি।
পণ্যগুলোতে পাওয়া চিনি, লবণ ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত। দেখা যায়, ১০০ গ্রাম মটরশুটি ভাজায় যে পরিমাণ লবণ থাকে, তা একজন মানুষের দৈনিক লবণের চাহিদার চেয়ে বেশি। প্রায় একই ঘটনা দেখা যায় অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে। ফলে এসব খাবার গ্রহণে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা অনেক বেশি।
গবেষকেরা বলছেন, দেশে প্যাকেটজাত পণ্যের গায়ে পুষ্টির উপাদান সঠিকভাবে লেখার নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। তথ্য থাকলেও তা ক্রেতার জন্য বেশ দুর্বোধ্যভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে ক্রেতারা যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এতে বাড়ছে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় ক্রেতাবান্ধব উপায়ে সঠিক তথ্য খাবারের গায়ে তুলে ধরা জরুরি। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াজাত খাবার বাজারজাত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের গুণমান নিরীক্ষণের জন্য যথাযথ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা চালু করা উচিত বলে মনে করছেন তাঁরা।
সম্পূর্ণ গবেষণাপত্রটি পড়তে নিচের লিঙ্ক ক্লিক করুন।
লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: উইলি অনলাইন লাইব্রেরি