আঘাতে প্রাথমিক চিকিৎসা

মাঝেমধ্যে আমরা সবাই দুর্ঘটনার মুখে পড়ি। পড়ে গিয়ে ব্যথা পাই, রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করা গেলে বড় ধরনের সমস্যার হাত থেকে বাঁচা যায়। দুর্ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা বইয়ে সেরকমই কিছু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ক্ষত সৃষ্টি, রক্তপাত, হাড় ভাঙ্গা, পুড়ে যাওয়া কিংবা সামান্য আহত হওয়ার ফলে যা যা হতে পারে, সেগুলোর প্রাথমিক চিকিৎসার উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে এই বইয়ে। বইটি ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরপর ১৯৮২ সালে মির পাবলিশার্স মূল বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। ১৯৮৬ সালে দ্বিজেন শর্মার বাংলা অনুবাদে বইটি প্রকাশ করে মির প্রকাশন। বইয়ের লেখক ভ. ভ. ইউদেনিচ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

দুর্ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা – পর্ব ১

নানা ধরনের যান্ত্রিক, তাপমাত্রাগত, রাসায়নিক ও বিদ্যুতের কারণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সৃষ্ট ক্ষতকেই আঘাত বলা হয়। বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বের নিরিখে পৃথক পৃথক যৌগিক আঘাতগুলো পরস্পরকে প্রকোপিত করে ও রোগীর অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটায়।

অধিকাংশ দেশেই রেডক্রস সংস্থা ও জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস আছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় (বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধ্বস ইত্যাদি) কিংবা বিরাট দুর্ঘটনা বা ঘটনায় (আগুন, বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা, ভিড়সংশ্লিষ্ট ঘটনা ইত্যাদি) আহতদের সাহায্যের জন্য ওগুলো জোগাড় করা যায়।

কারখানা ও খামারের কাজে নানা ধরনের যান মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও চালানোর সময়, খেলাধুলা ও দৌড়ঝাঁপে ও নিত্যদিনের কাজকর্মে প্রায়ই আঘাত লাগতে পারে। এগুলো সচরাচর আকস্মিভাবে ঘটে। তাই কার্যত দুর্ঘটনার স্থান ও কাল সম্পর্কে পূর্বানুমান সম্ভব নয়। সে জন্য দুর্ঘটনার অকুস্থলে আহতদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা খুব কঠিন। প্রায়ই তাই প্রাথমিক চিকিৎসা নিজের বা পারস্পরিক সাহায্যে গিয়ে ঠেকে, যতক্ষণ-না প্রাথমিক সাহায্য ঘাঁটি, অ্যাম্বুলেন্স বাহিনি, রেডক্রস দল ইত্যাদি থেকে উন্নততর সহায়তা এসে পৌঁছায়।

অবশ্য সাধারণ ক্ষেত্রগুলোতে সঙ্গী, নিকটবর্তী পথিক বা উপস্থিত কারও কাছ থেকে প্রায়ই প্রাথমিক চিকিৎসার সাহায্য পাওয়া যায়।

দুর্ঘটনার সময় অনুপস্থিত কারো পক্ষে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে আঘাতের সঠিক সময়, স্থান, পরিস্থিতি ও কিসে তা ঘটেছে—সব ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। ওগুলো সচরাচর আঘাতের বৈশিষ্ট্য শনাক্ত ও দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসার সঠিক প্রণালী নির্বাচন সহজ করে তোলে। রোগী অজ্ঞান থাকলে ও কী ঘটেছে বলতে না পারলে দুর্ঘটনার পরিবেশ ও কীভাবে আঘাতটি লেগেছে, তা জানা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

রক্তপাত, অভিঘাত (শক) ও চেতনাহীনতার কারণে জটিল হয়ে ওঠা মারাত্মক দুর্ঘটনাগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসা খুব দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।

রোগীর প্রাণরক্ষা ও সম্ভাব্য জটিলতা এড়ানোর উপযোগী সরল অথচ যথেষ্ট সুবিধাজনক ও কার্যকর ব্যবস্থাবলীর সমাহারই হলো প্রাথমিক চিকিৎসা।

প্রাথমিক চিকিৎসায় সাহায্যদাতার পক্ষে আঘাতের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব নির্ধারণ করতে জানা ও প্রয়োজনবোধে শ্বসন ও হৃৎপিণ্ডের কার্যকলাপের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, বাহ্যিক রক্তপাত থামানো, ক্ষতে পট্টি (ব্যান্ডেজ) বাঁধা, অস্থিভঙ্গগ্রস্ত প্রত্যঙ্গকে অনড় করা, রোগীকে যথাযথভাবে তোলা, তাকে সরানো, পোশাক খোলা, পরিবহনযানে রাখা ইত্যাদি ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জানা অত্যাবশ্যকীয়। প্রাথমিক চিকিৎসা সাহায্যদাতাদের উদ্যোগ ও জ্ঞান এবং হাতের কাছের সামগ্রীগুলোর সদ্ব্যবহারের দক্ষতার ওপর রোগীর জীবন প্রায়ই নির্ভরশীল থাকে। তাই তাদের সবার বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবনের মতো উপস্থিত বুদ্ধি থাকা খুব প্রয়োজন।

একটি ক্ষতের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য আঘাতের জায়গায় পৌঁছনোর প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রথমে অক্ষত হাত ও পা থেকে পোশাক সরিয়ে শেষে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আহত স্থান উন্মুক্ত করা হয়।

যখন আঘাত মারাত্মক থাকে, বিশেষত অস্থিভঙ্গ সংশ্লিষ্ট এবং রক্তপাত বন্ধ ও প্রত্যঙ্গ অনড় করা প্রয়োজন হলে পোশাক সেলাই বরাবর কেটে বা ছিঁড়ে ফেলা উচিত। বুটগুলো তলির পেছনের সেলাই বরাবর কেটে ফেলা দরকার। কখনো কখনো পট্টি বাঁধার জন্য পোশাকে যুতসই আকারের একটি ছিদ্র (বা টুকরো) করাই যথেষ্ট।

রোগীকে বহন বা স্থানান্তরে সর্বক্ষেত্রে আনাড়ি নাড়াচড়া, অস্বস্তিকর অবস্থান, ঝাঁকি ও হঠাৎ উঠানামায় যথাসম্ভব কম ব্যথা দেওয়া ও কম বাড়তি ক্ষতি ঘটানোর চেষ্টা করা উচিত।

মারাত্মক আহত ব্যক্তিদের, বিশেষত অস্থিভঙ্গ ও বড় আকারের ক্ষত থাকলে পায়ের গুল, নিতম্ব ও পিঠে ধরে তিনজন লোকের সাহায্যে তাদের তোলা বা সরানোই সর্বোত্তম ব্যবস্থা (১নং ছবি)।

চিত্র ১: তিনজন লোকের সাহায্যে আহতকে স্ট্রেচারে তোলা ও শোয়ানো

শরীরের আলাদা অংশগুলো যেন বেঁকে বা ঝুলে না যায়, সেদিকে নজর রেখে তাঁরা একসঙ্গে ও সতর্কভাবে কাজ করবেন। আঘাত ততটা মারাত্মক না হলে কিংবা প্রতিকূল পরিবেশে এক-দুই জন লোকও আহতকে বয়ে নিতে পারে। স্ট্রেচারে, কাঁধে, হাতের ওপর, একটি খুঁটি বা লাঠির সাহায্যে, কম্বলের ওপর, জোড়া দেওয়া স্ক্রি, ইত্যাদির সাহায্যে আহতদের বয়ে নেওয়া চলে। নিচের ছবিগুলো খেয়াল করুন।

চিত্র ২ (ক): দুজন লোকের সাহায্যে আহতকে বহন করার পদ্ধতি
চিত্র ২ (খ): দুজন লোকের সাহায্যে আহতকে বহন করার পদ্ধতি

স্ট্রেচার না পাওয়া গেলে একটি কোট খুলে ফেলে সেটার হাতা দুটিতে লাঠি ঢুকিয়ে বিকল্প স্ট্রেচার বানানো যায়। এভাবে ভাঁজ-করা কম্বল, ব্যাগ বা ফিতাও ব্যবহৃত হতে পারে।

চিত্র ৩: একটি লাঠির সাহায্যে আহতকে বহন

আহতের অবস্থার প্রতি নজর রাখার সুবিধার জন্য মাথাটা সামনে রেখে বয়ে নেওয়া উচিত। তাকে পাহাড়ের ওপরের দিকে তোলার জন্য তা সুবিধাজনক। পাহাড় থেকে নিচে অথবা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় স্ট্রেচার সমতলে রাখা এবং তা দুই জন লোকের সাহায্যে একসঙ্গে তোলা ও নামানো প্রয়োজন।

চিত্র ৪: কম্বলের সাহায্যে আহতকে স্থানান্তর

মারাত্মক আহত ব্যক্তিদের বহন ও স্থানান্তরের জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত স্ট্রেচারই সর্বোত্তম। এদের, বিশেষত লম্বা হাড় ভাঙ্গলে কিংবা গভীর ক্ষত থাকলে আরেকটি স্ট্রেচারে সরানো একাধারে উদ্বেগজনক ও বিপদজনক। সে জন্য একটি স্ট্রেচারে করেই তাদের হাসপাতাল বা অন্যত্র নেওয়া বাঞ্ছনীয়। আহতকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোরও নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। স্ট্রেচার ও রোগীকে মাথার দিকে রোলার বা ট্রলিতে ওঠাতে হয়।

চিত্র ৫: আহতকে পরিবহনের জন্য জরুরি উদ্ভাবন; ওভার কোটের সাহায্যে স্ট্রেচার ও স্কি দিয়ে তৈরি স্ট্রেচার
চিত্র ৬: ধমনী থেকে রক্তপাত
চিত্র ৭: শিরা থেকে রক্তপাত

একাধিক ব্যক্তি আহত থাকলে বিশেষভাবে সাজানো অ্যাম্বুলেন্স ভ্যানে দুই বা তিন স্তরে স্ট্রেচার রাখা চলে। এক্ষেত্রে ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে নিচে এবং মারাত্মক আহতদের নিচে রাখাই নিয়ম। ঠান্ডা আবহাওয়ায় আহতদেরকে, বিশেষত যারা অভিঘাতপ্রাপ্ত এবং অধিক রক্তক্ষরণে দুর্বল, তাঁদের গরম রাখা প্রয়োজন।

(চলবে…)