জীবের শীতশয়ন

হাইবারনেট বা হাইবারনেশন (Hibernation)-এর আভিধানিক অর্থ সহজভাবে নিলে তা ‘নিষ্ক্রিয়’ বা ‘বিচেতন’ অবস্থাকে ধরে নেওয়া যায়। তবে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ততটা সহজভাবে গ্রহণ করা যায় না। কেননা, হাইবারনেশন শব্দটি বিশেষ কতগুলো মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীগোষ্ঠীর সাময়িক সুপ্ত ও অসাড় অবস্থাকে বোঝায়, যাকে আমরা ‘শীতনিদ্রা’ বা শীতশয়ন বলে থাকি। এ শব্দকে আরও সহজ করতে গেলে বলতে হয়, প্রাণিজগতের কিছু কিছু সদস্য এদের জীবনের নির্দিষ্ট সময় নিষ্ক্রিয় থাকে বা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। এই পরিস্থিতি প্রাণীদেহের পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, যখন চারপাশের তাপমাত্রায় যথেষ্ট ভিন্নতা দেখা দেয়, তখন কিছু কিছু প্রাণী নিজেদের দেহ-তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে ধরে রাখতে পারে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে ‘তাপীয় নিয়ন্ত্রণ’ (Thermorigulation) বলা হয়। এই প্রক্রিয়া প্রাণিদেহের অভ্যন্তরীণ সাধারণ পদ্ধতির সহায়তায় দেহের প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে। এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ মানুষ। অর্থাৎ, আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় দেহ-তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারি। তবে এরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

তাপীয় বৈশিষ্ট্যনির্ভর প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস

তাপীয় নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ থার্মোরেগুলেশন সাধারণত দুই ধরনের প্রাণিগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। ‘অন্তঃতাপ নিয়ন্ত্রক (Endothermy) এবং ‘বহিঃতাপ নিয়ন্ত্রক’ (Ectothermy) জীবজ দল। সাধারণ ভাষায় অন্তঃতাপ নিয়ন্ত্রক প্রাণিদলকে উষ্ণ রক্তের প্রাণিদল বলা হয়। এরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিপাকীয় কার্যকরণের দ্বারা দেহ-তাপমাত্রা প্রয়োজনীয় সীমারেখার মধ্যে ধরে রাখতে পারে। এভাবে এদের চারপাশের তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখন সেই উষ্ণ রক্তের প্রাণীগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিপাকীয় (Metabolic) কার্যকরণ বাড়িয়ে দিয়ে দেহের ‘নির্দিষ্ট’ তাপমাত্রায় সমতা রক্ষা করে, যাতে প্রাণীটি শৈত্যাবস্থা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। শারীরতত্ত্ববিদদের মতে, সত্যিকার অর্থে এরূপ শীতশয়ন তুলনামূলকভাবে কেবল কয়েকটি স্তন্যপায়ী ও পাখি প্রজাতির বেলায় কার্যকর। এরকম শীতশয়নের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে যেটুকু জানা গেছে, তাতে দেখা যায়, ভাল্লুক, ভোদড়জাতীয় প্রাণী (Skunk), ভাল্লুকজাতীয় ছোট প্রাণী, গর্তবাসী ছোট ইঁদুর পরিবেশের তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে আসতে থাকলে শীতশয়নে যায়।’

অন্যদিকে বহিঃত্বক নিয়ন্ত্রক প্রাণিদলকে শীতল রক্তের প্রাণিদল তাপীয় আচরণের দিক দিয়ে উষ্ণ রক্তদলের বিপরীতধর্মী বলা যায়। অর্থাৎ, এদের দেহ তাপমাত্রা একরকম থাকে। পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শীতল রক্তের প্রাণীর উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মতো নিজ দেহের বিপাকীয় পদ্ধতিতে নিজের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা স্থির রাখার ক্ষমতা থাকে না। ফলে প্রাণীটির পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার প্রভাব প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে এগুলোকে দেহ তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য সূর্য বা অন্য কোনো উৎসের ওপর নির্ভরশীল হতে দেখা যায়। যেমন কিছু উভচর প্রাণী ও সরীসৃপকে, বিশেষ করে গিরগিটিকে গরম পাথরে সূর্যের তাপে গা বিছিয়ে রেখে শরীরের তাপমাত্রা সঠিক অবস্থায় রাখতে দেখা যায়। অন্যদিকে নিম্ন তাপমাত্রার জন্য এগুলো প্রাকৃতিক ছায়া বা জলীয় ঠান্ডা স্থানের সন্ধান করে থাকে।

শীতশয়নে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বে সাধারণত কিছু প্রাণী বেশি খায় এবং দেহের ওজন বাড়ায়। আবার কোনো কোনো প্রাণী যেমন ডোরাকাটা কাঠবিড়ালি এবং ধেড়ে ইঁদুর অসময়ের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-রসদ মজুত করে। শীতনিদ্রিত যেসব প্রাণী পূর্ণ শীতনিদ্রিত থাকে, তারাও সময়ে সময়ে জেগে উঠে খাবার গ্রহণ করে থাকে। এভাবে এগুলো যথেষ্ট দীর্ঘ সময় ধরে শীতশায়িত অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু যেসব প্রাণী এভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না, সেগুলো নিজের দেহের সঞ্চিত চর্বি থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি উত্পন্ন করে দীর্ঘ সময় নির্জীব অবস্থায় কাটিয়ে দিতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই শীতশয়নের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। এটা নির্ভর করে প্রাণীর চারপাশের প্রাকৃতিক অবস্থার তাপমাত্রা ও শারীরিক-বংশগতিক ও বিভিন্ন উপসর্গের ওপর। এই শীতনিদ্রা স্বল্পকাল থেকে নিয়ে বছরের পর বছর হতে দেখা যায়।

কীটপতঙ্গের জগতেও এ ধরনের নিষ্ক্রিয় বা নির্জীব হয়ে পড়ে থেকে অল্প থেকে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেওয়ার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে, কীটতত্ত্বের ভাষায় যাকে ‘স্থগিতী’ বা Diapausae বলা হয়। কীটপতঙ্গ যেহেতু সাধারণত ডিম-শূককীট-মূককীট-পরিণত অবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, তাই এই বিশেষ স্থগিত অবস্থাটা এদের জীবনচক্রের যেকোনো অবস্থায় হতে পারে।

উষ্ণ রক্ত ও শীতল উভয় প্রাণিদলের শীতশয়নের প্রক্রিয়াটি প্রাণীর মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ ক্ষেত্রে আরও একটু নির্দিষ্ট করে বলা যায়, এই প্রাণীদলের মগজের সম্মুখ দিকের হাইপোথ্যালামাসের প্রাকচক্ষীয় (Preaphic) স্থানটি তা নিয়ন্ত্রণ করে।

এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তার এক নতুন ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। বিশেষ করে, চিকিত্সাশাস্ত্রে আরোপিত শীতশয়ন (Induced hibernation) প্রয়োগ করে মুমূর্ষু বা মৃতপ্রায় রোগীকে যদি দীর্ঘদিনের ন্যূনতম বিপাকীয় কার্যকরণের মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তা নিঃসন্দেহে রোগ উপশমের সহায়ক হবে। চিকিত্সাশাস্ত্রের নতুন নতুন উদ্ভাবন ও এর উন্নততর প্রয়োগ মানবকল্যাণে উপযোগী হয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসবে।

লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ আণবিক বিজ্ঞানী এবং খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়