সুন্দর বাদামি প্যাঁচার কথা

ঘড়েল গুইসাপটি পুকুরে নামবে মাছ খেতে। প্রতিদিনই সকালের দিকে নামে, প্রচুর মাছ খায়। অতএব আজ বাড়ির ছেলেপুলেরা সকাল থেকেই লাঠিসোঁটা হাতে প্রস্তুত ছিল পুকুরের উত্তর পাড়ে—ওদিকেরই বিশাল বড় একটি বাগানে আস্তানা ওই কুমির সাইজের গুইসাপটির।

হেলতে-দুলতে হাসি হাসিমুখে গুইসাপটি বাগানের সুঁড়িপথ ধরে এগিয়ে যখন কাছাকাছি এল, তখন লুকিয়ে থাকা দুষ্টু ছেলেদের দল মহা হইচই করে দেয় ধাওয়া। গুইসাপটি অ্যাবাউট টার্ন করে দে ঝেড়ে দৌড়। বাড়ির পোষা কুকুর তিনটিও ছুটে চলল শত্রুকে ধরতে। কিন্তু লেজের সীমানায় যেতেই গুইসাপটি লেজের চাবুক যেই না চালাল, অমনি তিনটি কুকুরই কাত হয়ে পড়ে ব্যথায় কাঁইকুঁই করতে লাগল। গুইসাপের লেজের চাবুক কী করতে পারে, কুকুর তিনটি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে আর এগোল না।

ছেলের দল ধাওয়া করে বাগানের মাঝখানে চলে আসে। ইতিমধ্যে দু-পাঁচটা পিটুনিও দিয়েছে গুইসাপটির পিঠে। কিচ্ছু হয়নি। মনে হয়েছে রাবারের ওপর লাঠি লেগে ছিটকে উঠেছে ওপরে। ভয়ে গুইসাপটি বড় মহুয়াগাছটিতে চড়ে বসে। দুষ্টুরা ভয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। কেননা, রোজ রাতে এই গাছে বসে ভয়ংকর এক প্যাঁচা ডাকে ভয়াল কণ্ঠে। ওই ডাক শুনলেই ভয় করে। মুরব্বিরা বলেন, ওটা ভূত প্যাঁচা। বড় বড় হলদে চোখ। ওটা ডাকলেই পাড়ার কোনো না কোনো বাড়িতে বিপদ নামবে, অমঙ্গল হবে। এ সময় ছেলেদের দলকে পিলে চমকে দিয়ে গুইসাপটি মহুয়াগাছ থেকে ডালপালায় শব্দ তুলতে তুলতে ধপাস করে মাটিতে পড়ে চিৎপটাং হয়ে। আর দুটো ভূত প্যাঁচা বাজপাখির মতো ডাইভ মেরে নেমেই পলাতক গুইসাপটিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। ছেলেপুলেরা ভূত প্যাঁচা দেখে ভয়ে চিত্কার দিয়ে দে ঝেড়ে দৌড় বাড়ির দিকে।

হয়তোবা গুইসাপটিকে ওরা ধাওয়া করত না, ভয় পেয়ে গুইসাপটি অনেক উঁচু থেকে মাটিতেও পড়ত না, যদি কিনা ভূত প্যাঁচা দুটির মহুয়াগাছের খোঁড়লের বাসায় ৪টি উড়ু উড়ু ছানা থাকত। এরা বাসা করে গরমকালে। ডিম পাড়ে ৩-৪টি। নিশাচর তো! তাই সারাটা দিন কাটায় কোটরে বসে অথবা অন্ধকারাচ্ছন্ন ডাল বা ঝোপঝাড়ে বসে। ডিমে তা তাই কেউ না কেউ সারাটা দিনই দেয়। অর্থাৎ বাসায় বসে থাকলেই তো তা দেওয়া হয়ে যায়। ডিম ফুটে ছানা হয় ২৪ দিনে। ডিম-ছানা না থাকলে এরা ঝোপঝাড়-ঝোপালো গাছ বা বড় গাছের ঘন ডালপালায় বসে ঘুমিয়ে-ঝিমিয়ে কাটায়। রাতে বেরোয়। ঢাকাসহ দেশের অন্য শহর ও গ্রামে এরা যথেষ্টই আছে। আছে প্রাকৃতিক বনে। ভূত প্যাঁচাদের গড়ন-ধরনও অনেকটাই বাজের মতো, অন্য প্যাঁচাদের সঙ্গে ঠিক মেলে না। ওড়ার ধরনও অনেকটাই বাজের মতো। ছোট ছোট ডাইভ মারতেও ওস্তাদ। এরা কাগজের তৈরি প্লেনের মতো উড়তে জানে।

ভূত প্যাঁচাটি হলো স্থানীয় নাম। মূল নাম ‘বাদামি প্যাঁচা’। কালো প্যাঁচা, কুপোখ নামেও পরিচিত। ভীতিকর-ভয়ংকর ডাকটা এদের ‘কু-উক, কু-উক, হুপ্ হুপ্, হুপ্ হুপ্, কি-হু, কি-হু, কু-পোখ’ ধরনের। রাতে বন-বাগানে ডাকলে একটু ভয় ভয়ই লাগে। প্রজনন মৌসুমে ডাকাডাকিটা বেড়ে যায়। বন-বাগানে ঢুকে যদি ওপরের দিকে তাকানো যায়, আর যদি একজোড়া বাদামি-প্যাঁচা বড় বড় চোখে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে একটু হলেও ভয় পাবেন। কেননা, এদের বড় বড় গোল গোল চোখ দুটি টকটকে হলুদ, চাহনিও ভয়ংকর। ওরা কিন্তু আপনাকে ভয় দিতে চায় না, ওরা আপনাকে ভয় পেয়েই তাকিয়ে থাকে। হাততালি বাজাবেন, উড়ে পালাবে। এমনিতে প্যাঁচাটা ভূত তো নয়ই, নিরীহ পাখিটার ডাকেও কোনো অমঙ্গল হয় না। দেখতেও প্যাঁচাটা সুন্দরই। ঘন বাদামি পিঠের উপরিভাগ, সারাটা বুক-পেট ও লেজের তলা সাদাটে, তার ওপর চমত্কার লালচে বাদামি ছোপ। ঠোঁটের গোড়ার কপালটুকু সাদাটে। কালচে ঠোঁট, হলুদ পা।

আবাসিক বাদামি প্যাঁচার ইংরেজি নাম Brown Boobook. বৈজ্ঞানিক নাম Ninox scutulata. দৈর্ঘ্য ৩২ সেমি। ওজন ১৭০-২৩০ গ্রাম। মূল খাদ্য গিরগিটি, ছোট ব্যাঙ, কাঠবিড়ালীর ছানা, ইঁদুর, ছোট পাখি ও পাখির ডিম-ছানাসহ পোকামাকড়।

লেখক: পাখিবিশারদ