বংশগতির রহস্য

হাইস্কুলের শিক্ষক হওয়ার পরীক্ষায় পরপর তিনবার ফেল করে হয়ে গেছেন গির্জার শিক্ষানবিশ। জীবদ্দশায় যাঁকে চিনতে পারেনি এ বিশ্ব। মনের আনন্দে নিজের বাগানে গবেষণা করে যিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন জীববিজ্ঞানের গোটা একটি শাখা—জিনতত্ত্ব বা জেনেটিকস। তিনি গ্রেগর জোহান মেন্ডেল। ১৮৮৪ সালের আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মেন্ডেলের মৃত্যুদিবসে জেনে নিন তাঁর বিস্ময়কর সেই গবেষণার কাহিনি…

গ্রেগর জোহান মেন্ডেলছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটা ১৮৮৬ সালের। সবে ইভিনিং প্রিমরোজ নামে মার্কিন একটি উদ্ভিদ আনা হয়েছে নেদারল্যান্ডসে। একধরনের ফিকে হলুদ বুনো ফুলের গাছ। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার গহিন বনে জন্মে। ফুল ফোটে সন্ধ্যার পর। সে জন্যই এমন নাম। অনেকে ডাকেন ইনোথেরা নামে।

নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামের রাস্তায় একদিন হাঁটছিলেন ডাচ উদ্ভিদবিদ হুগো দ্য ভ্রিস। এ সময় একটি মাঠে একগাদা প্রিমরোজগাছ চোখে পড়ল তাঁর। শুধু বীজ থেকে এ গাছ জন্মে, অন্য কোনোভাবে নয়। সম্ভবত পার্শ্ববর্তী কোনো বাগান থেকে গাছগুলোর কিছু বীজ ওই মাঠে পড়েছিল। সেগুলো থেকেই জন্মেছে গাছগুলো। দ্য ভ্রিস খেয়াল করলেন, এগুলোর মধ্যে কিছু গাছ অন্যগুলোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। এসব ব্যতিক্রম প্রকৃতির খেয়াল। তবে সেগুলো থেকেও ফুল জন্মেছে। পেছনের রহস্যটা কী? সেটা জানার কৌতূহল জাগল ভ্রিসের। এই ফুল নিয়ে একটি পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন তিনি।

দ্য ভ্রিস মাঠ থেকে কিছু গাছ তুলে নিজের বাগানে নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তখন তিনি আমস্টারডামের বোটানিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক। তিনি খেয়াল করে দেখলেন, বীজ থেকে জন্মানো নতুন প্রিমরোজগাছের বেশির ভাগই দেখতে আগের প্রজন্মের গাছের মতো। তবে প্রতিবারই আগের প্রজন্মের চেয়ে নতুন প্রজন্মে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। দ্য ভ্রিস এই হঠাৎ পরিবর্তনের নাম দিলেন মিউটেশন। বাংলায় যাকে বলে পরিব্যক্তি। লাতিন শব্দ মিউটেশনের অর্থ ‘পরিবর্তন’।

গাছের কত অংশ নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্যধারী, আর কত অংশ অন্য বৈশিষ্ট্যধারী, তা দেখতে তিনি সবকিছু হিসাব-নিকাশ করলেন। পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে ধরে নিলেন, প্রতিটি গাছের একেকটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে দুটি ফ্যাক্টর বা উপাদান। আরও ধরে নিলেন, ফ্যাক্টর দুটির একটি থাকে পরাগরেণুতে আর অন্যটি ডিম্বাণুতে।

প্রায় এক যুগ পর, ১৯০০ সালে প্রিমরোজ ফুল নিয়ে এই গবেষণা শেষ হলো। গবেষণাটিকে ‘বংশগতির সূত্র’ নামে আখ্যায়িত করলেন ভ্রিস। এবার বিশ্ববাসীর কাছে সেটা প্রকাশের পালা। তাঁর ধারণা ছিল, এর আগে কেউ বংশগতির এ বিষয়ে গবেষণা করেননি। তিনিই প্রথম। সেটি যদি সত্যি হয়, তাহলে তাঁর আবিষ্কারটা বড় ধরনের হইচই ফেলে দিতে পারে। কাজেই বিশ্ববাসীকে জানানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলেন ভ্রিস। সে জন্য পুরোনো নথিপত্র আর বৈজ্ঞানিক জার্নাল ঘেঁটে দেখতে লাগলেন। এর আগে আসলেই কেউ এ বিষয়ে কোনো গবেষণা করেছেন কি না, সেটাই নিশ্চিত হতে চাইছিলেন। তাতে অনেক ঝামেলা আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যায়। সেটি করতে গিয়ে চোখ কপালে ওঠার জোগাড় ভ্রিসের। বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারলেন, প্রায় ৩৫ বছর আগেই এ বিষয়ে গবেষণা করে একই ফলাফল পেয়েছিলেন অখ্যাত এক বিজ্ঞানী। তাঁর নাম গ্রেগর জোহান মেন্ডেল। সেই ১৮৬৫ সালে তিনি উদ্ভিদের ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করে তার ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন। তিনিও নিজের গবেষণাকে আখ্যায়িত করে গেছেন লজ অব ইনহেরিটেন্স বা বংশগতির সূত্র হিসেবে।

বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। কিছুদিনের মধ্যে আরও জানা গেল, ওই ১৯০০ সালে আরও দুজন বিজ্ঞানী একই বিষয় নিয়ে গবেষণা শেষ করেছেন। তাঁদের ফলাফলও হুবহু এক। শুধু তা-ই নয়, মেন্ডেলের ফলাফলের সঙ্গে হুবহু মিল। তাঁরা হলেন জার্মান উদ্ভিদবিদ কার্ল এরিখ করেঞ্জ ও অস্ট্রিয়ান উদ্ভিদবিদ এরিখ শেমার্ক ফন জাইজিনেক। কিন্তু গবেষণার সময় কেউই কারও ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতেন না। এভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে এসে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হলেন তিন অপরিচিত ব্যক্তি।

তিন বিজ্ঞানীর বুঝতে বাকি রইল না, তাঁরা আসলে নতুন কিছু নয়, মেন্ডেলের ফলাফলটাই পুনরাবিষ্কার করেছেন। তা দেখে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের আবিষ্কারটাকে আর নতুন বলে দাবি করতে পারলেন না বিজ্ঞানীত্রয়। ১৯০০ সালে নিজেদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন দ্য ভ্রিস, করেঞ্জ আর জাইজিনেক। তবে সবাই পুরো কৃতিত্ব দিলেন মেন্ডেলকে। বলা যায়, দিতে বাধ্য হলেন। এমনকি অন্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন মেন্ডেলের আবিষ্কারের দিকে। কিন্তু এই মেন্ডেল লোকটি আসলে কে? কী এমন আবিষ্কার করেছিলেন তিনি?

কদিন নতুন পথের দিশা পান মেন্ডেল। মোড় ঘুরিয়ে দেন বংশগতিবিষয়ক গবেষণায়। ১৮৫৭ সালে তাঁর মনে হলো, উত্তরাধিকারসূত্রে দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণার জন্য নতুন উদ্ভিদ জন্মানোই সবচেয়ে ভালো উপায়।

২.

জোহান মেন্ডেলের জন্ম ১৮২২ সালের ২০ জুলাই। তৎকালীন অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের সিলেসিয়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। জায়গাটা বর্তমানে চেক রিপাবলিকের অংশ। ছোটবেলা থেকে মেন্ডেলের বাগান করার শখ ছিল। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিসংখ্যান। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল হাইস্কুলের শিক্ষক হওয়া। এ চাকরি পেতে সেকালে একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো। দুর্ভাগ্য হলো, ওই পরীক্ষায় পরপর তিনবার ফেল করেন মেন্ডেল। স্বাভাবিকভাবেই চরম হতাশ হন তিনি। বাধ্য হয়ে গির্জায় শিক্ষানবিশ হিসেবে ভর্তি হন। গির্জায় পাদরি হিসেবে যোগ দেন ১৮৪৩ সালে। সেখানে তাঁর নতুন নাম হলো গ্রেগর জোহান মেন্ডেল। এ গির্জার পক্ষ থেকে ১৮৫১ সালে তাঁকে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল উচ্চশিক্ষার জন্য। তবে সেখানে প্রত্যাশিত ফল লাভে ব্যর্থ হয়ে গির্জায় ফিরতে বাধ্য হন। পরে ব্রুনোর টেকনিক্যাল স্কুলে বিজ্ঞানের অতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান মেন্ডেল। ঐতিহাসিকেরা বলেন, পুরো জীবন তিনি কাটিয়েছেন শান্তিপূর্ণভাবে। এমনকি তাঁর জীবনকে ঘটনাবহুলও বলা যায় না। একমাত্র ব্যতিক্রম, অস্ট্রিয়ার এক মঠে বংশগতি নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। আসলে গির্জার মঠে অবসর সময়ে একটা গবেষণার কথা চিন্তা করেন। নিজের ভালো লাগার কথা ভেবে গাছপালা নিয়ে গবেষণা বা উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন।

এভাবে একদিন নতুন পথের দিশা পান মেন্ডেল। মোড় ঘুরিয়ে দেন বংশগতিবিষয়ক গবেষণায়। ১৮৫৭ সালে তাঁর মনে হলো, উত্তরাধিকারসূত্রে দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণার জন্য নতুন উদ্ভিদ জন্মানোই সবচেয়ে ভালো উপায়। অন্তত একটা কারণে এ কথা মনে হয়েছিল তাঁর। সেটা হচ্ছে উদ্ভিদকে যে অবস্থায় রাখা যায়, প্রায় সে অবস্থায় থাকে। তাই তাদের খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তা ছাড়া উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ।

গাছের ফুলের মধ্যে প্রজনন কোষ তৈরি হয়। অধিকাংশ ফুলের কেন্দ্রে বীজ উৎপাদনকারী অংশ থাকে, যাতে ডিম্বাশয়ের মধ্যে একটি ডিম্বকোষ দেখা যায়। একটি গাছের ফুল থেকে পরাগরেণু বা শুক্রাণু কোষ নিয়ে আরেক গাছের ডিম্বাশয়ে বা বীজ উৎপাদনকারী অংশে দেওয়া যায়। একে বলে পর-পরাগায়ন। ফুলের গর্ভদণ্ডের ওপর পরাগরেণু পড়লে সেখানে একটি নলের সৃষ্টি হয়। এর ভেতর দিয়ে গর্ভাশয়ে ঢুকে ডিম্বকোষের সঙ্গে মিলিত হয় পরাগরেণু। এ প্রক্রিয়াকে বলে নিষেক বা ফার্টিলাইজেশন।

নিষেকের পর ফুলের গর্ভাশয় ক্রমে পরিণত হয় বীজে, যা মাটিতে পুঁতে দেওয়া যায়। ফলে মাটি থেকে জন্মাতে পারে নতুন গাছ। এবার এই নতুন জন্মানো গাছটির সঙ্গে পুরোনো গাছ দুটির (যারা পরাগরেণু আর ডিম্বাশয় তৈরি করেছিল) বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যের তুলনা করে দেখা যেতে পারে। আবার একটি নির্দিষ্ট গাছের ফুল থেকে পরাগরেণু সংগ্রহ করে সেই গাছেরই ফুলের গর্ভমুণ্ডে রেখে পরাগায়ন ঘটানো যায়। একে বলে স্বপরাগায়ন। স্বপরাগায়নের মাধ্যমে পাওয়া বীজটির পিতা-মাতা হবে একই।

টানা আট বছর মটরশুঁটিগাছ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে, তা থেকে পাওয়া ফলাফল নিয়ে গবেষণা করেন মেন্ডেল। তিনি কাজ শুরু করেছিলেন খাটো মটরশুঁটির গাছ নিয়ে। গাছগুলো পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় মাত্র এক বা দেড় ফুট লম্বা হয়। বেশ কিছু মটরশুঁটিগাছে স্বপরাগায়ন ঘটান তিনি। এসব গাছের বীজ আবার জমিতে লাগান। তাঁর বোনা প্রতিটি মটরশুঁটিগাছই জন্মাল খাটো হয়ে। মানে, এসব গাছের বংশগতি হুবহু একই রইল।

তৃতীয় প্রজন্মে গিয়ে আবারও ফিরে আসে দ্বিতীয় প্রজন্মে অপ্রকাশিত বৈশিষ্ট্যগুলো

এরপর মটরশুঁটির আরেক প্রজাতি নিয়ে কাজ শুরু করেন মেন্ডেল। এ গাছগুলো বেশ লম্বা—ছয় থেকে সাত ফুট। লম্বা প্রজাতির মটরশুঁটিগাছেও আগের মতো স্বপরাগায়ন ঘটান তিনি। এর বীজও আগের মতো জমিতে বুনে দেন। দেখা গেল, কিছু বীজ থেকে প্রতিবার এভাবে লম্বা মটরশুঁটিগাছ জন্মাচ্ছে। মানে নতুন বংশধরগুলো পাওয়া যাচ্ছে ঠিক আগের লম্বা মটরশুঁটিগাছের মতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, লম্বা মটরশুঁটিগাছ থেকে পাওয়া কিছু বীজ থেকে লম্বা মটরশুঁটিগাছ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ বীজগুলো পাওয়া গিয়েছিল স্বপরাগায়নের মাধ্যমে। হিসাবে দেখা গেল, এভাবে মোটামুটি চার ভাগের তিন ভাগ গাছ লম্বা হচ্ছে, আর খাটো হচ্ছে বাকি এক ভাগ। রহস্যটা কী?

এই ফলাফল দেখে অবাক হন মেন্ডেল। নতুন জন্মানো লম্বা মটরশুঁটিগাছগুলো দেখতে এবং উচ্চতায় ঠিক ঠিক আগের গাছগুলোর মতো বড় হচ্ছে। মানে এরা আগের গাছগুলোর প্রকৃত বংশধর। কিন্তু বাকিগুলোর ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম হচ্ছে, তা বুঝতে পারলেন না মেন্ডেল। তাই আরেকটি পরীক্ষা চালালেন। এবার চালালেন পর-পরাগায়ন। বংশগতি ঠিক থাকা একটি লম্বা মটরশুঁটিগাছের ফুল থেকে পরাগরেণু এনে আরেকটি খাটো মটরশুঁটিগাছের ফুলে রাখলেন তিনি। আবার খাটো গাছের ফুল থেকে পরাগরেণু এনে লম্বা গাছের ফুলেও রাখলেন। এভাবে যেসব বীজ পাওয়া গেল, তাদের পিতা-মাতা হলো দুটি—যাদের একটি লম্বা মটরশুঁটিগাছ এবং আরেকটি খাটো মটরশুঁটিগাছ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বীজ থেকে কী ধরনের গাছ পাওয়া যাবে? কিছু লম্বা, নাকি কিছু খাটো? নাকি সব কটি গাছই হবে মাঝারি উচ্চতার?

কিন্তু এবারের ফলাফল মেন্ডেলকে আরেক দফা অবাক করল। কারণ, তাঁর ভাবনামতো কোনোটিই ঘটল না। ওই বীজ থেকে জন্মানো গাছগুলোর কোনোটিই খাটো এবং মাঝামাঝি উচ্চতার হলো না। অবাক কাণ্ড! একটি লম্বা আর একটি খাটো গাছ থেকে পাওয়া সব কটি বীজ থেকে জন্মালো লম্বা মটরশুঁটিগাছ। সব কটি গাছই এমনভাবে লম্বা হলো যে দেখে মনে হবে, নির্ঘাত সেগুলোর পরাগরেণু (পিতা) আর ডিম্বাশয় (মাতা) উভয়ই এসেছিল লম্বা গাছ থেকে। যেন মটরশুঁটিগাছের খাটো বৈশিষ্ট্য স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

এবার মেন্ডেল এই নতুন লম্বা গাছগুলোর বীজ সংগ্রহ করলেন। সেগুলো আবার জমিতে বুনলেন। গাছের ফুলগুলোর মধ্যে স্বপরাগায়ন ঘটালেন। এসব গাছ থেকে যেসব বীজ পাওয়া গেল, তার মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ জন্মাল লম্বা মটরশুঁটিগাছ। বাকি এক ভাগ বীজ থেকে জন্মাল খাটো। এ রহস্যের মানে কী? মেন্ডেল ব্যাখ্যা খোঁজেন। ভাবলেন, মটরশুঁটিগাছের খাটো বৈশিষ্ট্য আসলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। এটি শুধু এক প্রজন্মে লুকিয়ে ছিল। পরের প্রজন্মে তা আবার প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে গোটা বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করা যায় কীভাবে?

মেন্ডেল ধরে নিলেন, একটি খাটো গাছে দুটি s থাকতে পারে। তাই একে ss হিসেবে বর্ণনা করা যায়। একটি ss গাছ থেকে সৃষ্ট পরাগরেণুতে দুটি ফ্যাক্টরের একটি থাকতে পারে।

৩.

অনেক চিন্তাভাবনার পর ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করতে নতুন একটা ধারণা আমদানি করলেন মেন্ডেল। ধরে নিলেন, প্রতিটি গাছের মধ্যে দুটি ফ্যাক্টর থাকে। ফ্যাক্টরগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে গাছের নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। ফ্যাক্টরগুলোর একেকটি আসে একেক পিতা-মাতার কাছ থেকে। (অবশ্য এ ফ্যাক্টরগুলো আসলে যে কী, সে সম্পর্কে মেন্ডেলের সঠিক ধারণা ছিল না।) এখন যে ফ্যাক্টরটি গাছের লম্বা বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী, সেটাকে ধরা যাক T। আর যে ফ্যাক্টরটি খাটো বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী, তাকে ধরা যাক s।

মেন্ডেল ধরে নিলেন, একটি খাটো গাছে দুটি s থাকতে পারে। তাই একে ss হিসেবে বর্ণনা করা যায়। একটি ss গাছ থেকে সৃষ্ট পরাগরেণুতে দুটি ফ্যাক্টরের একটি থাকতে পারে। মানে পরাগরেণুতে থাকবে একটি s। একইভাবে প্রতিটি ডিম্বকোষেও থাকবে একটি s। খাটো মটরশুঁটির একটি শুক্রাণু কোষ, আরেকটি খাটো মটরশুঁটির ডিম্বকোষের সঙ্গে মিলিত হলে বীজটি একটি s পাবে শুক্রাণু কোষ থেকে এবং আরেকটি s পাবে ডিম্বকোষ থেকে। তাই বীজটি হবে ss। আর তা থেকে জন্মাবে আগের প্রজন্মের মতো খাটো মটরশুঁটিগাছ। এ ঘটনা সব খাটো মটরশুঁটিগাছেই ঘটবে। এটি হবে আগের মটরশুঁটিগাছটির সত্যিকার বংশধর।

একইভাবে বলা যায়, লম্বা মটরশুঁটিগাছেও লম্বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য দুটি ফ্যাক্টর থাকে। একে আমরা TT হিসেবে বর্ণনা করতে পারি। একটি TT গাছ থেকে সৃষ্ট শুক্রাণুতে থাকবে দুটি ফ্যাক্টরের একটি। মানে পরাগরেণুতে থাকবে একটি T। একইভাবে প্রতিটি ডিম্বকোষেও থাকবে একটি T। তাই শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনে সৃষ্ট বীজে থাকবে TT। তাই এই বীজ থেকে জন্মাবে একটি লম্বা মটরশুঁটিগাছ। এটি হবে আগের লম্বা মটরশুঁটিগাছটির প্রকৃত বংশধর।

কিন্তু ধরা যাক, খাটো মটরশুঁটিগাছের পরাগরেণু, একটি লম্বা মটরশুঁটিগাছের ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হলো। তাহলে একটি পরাগরেণু s মিলিত হবে ডিম্বাণু কোষ T-এর সঙ্গে। ফলে গঠিত বীজটি হবে sT। অন্যদিকে লম্বা গাছ থেকে সৃষ্ট পরাগরেণু (T), একটি খাটো মটরশুঁটির ডিম্বাণুর (s) সঙ্গে মিলিত হলে গঠিত বীজটি হবে Ts। তবে sT বা Ts—দুইভাবে পাওয়া বীজ থেকেই জন্মাবে লম্বা মটরশুঁটিগাছ। কারণ T-এর প্রভাব s-এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা দেবে। এখানে লম্বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রভাবশালী বা প্রকট, ইংরেজিতে বলা হয় ডমিন্যান্ট (লাতিন থেকে আসা এ শব্দের অর্থ ‘প্রভু বা নিয়ন্ত্রণকারী’)। আর খাটো বৈশিষ্ট্য হলো দুর্বল বা প্রচ্ছন্ন, ইংরেজিতে বলে রিসেসিভ (লাতিন অর্থ ‘প্রকাশে অনিচ্ছুক’)।

মেন্ডেল তাঁর মটরশুঁটিগাছের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নিয়েও একে একে পরীক্ষা করে দেখেন। মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন এসব বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও তাঁর এই ব্যাখ্যা মিলে গেল একদম খাপে খাপে।

এবার একটি লম্বা প্রজাতির গাছ নেওয়া হলো, যা Ts (অথবা sT)। এ গাছ থেকে নতুন বংশধর জন্মাতে হবে। গাছটি যেসব শুক্রাণু কোষ তৈরি করবে, তাদের মধ্যে যেকোনো একটি ফ্যাক্টর থাকবে। অর্থাৎ অর্ধেক শুক্রাণু কোষের মধ্যে থাকবে T এবং বাকি অর্ধেকে থাকবে s। একইভাবে ডিম্বাণুর জন্যও কথাটি সত্য। অর্থাৎ গাছটি থেকে উৎপন্ন ডিম্বাণুগুলোর অর্ধেকে থাকবে T আর s থাকবে বাকি অর্ধেকে।

এবার ধরি, এসব পরাগরেণু ডিম্বাণু কোষের সঙ্গে মিলিত হলো। তাহলে প্রতিটি T যুক্ত পরাগরেণু হয় T যুক্ত ডিম্বাণু বা s যুক্ত ডিম্বাণু কোষের সঙ্গে মিলিত হয়ে বীজ তৈরি করবে। এ বীজে হয় TT থাকবে, নয়তো থাকবে Ts। আবার প্রতিটি s যুক্ত প্রতি পরাগরেণু হয় T যুক্ত ডিম্বাণু বা s যুক্ত ডিম্বাণু কোষের সঙ্গে মিলিত হয়ে বীজ তৈরি করবে। এ বীজে হয় sT থাকবে, নয়তো থাকবে ss।

এভাবে ওই লম্বা গাছ থেকে চার ধরনের বীজ পাওয়া যাবে। সেগুলো হচ্ছে: TT, Ts, sT এবং ss। বীজগুলোর প্রতিটিই হবে সমপরিমাণে। TT, Ts আর sT বীজগুলো থেকে যেসব মটরশুঁটিগাছ জন্মাবে, নিয়মমতো সেগুলো হবে লম্বা। আর ss বীজ থেকে জন্মানো মটরশুঁটিগাছগুলো হবে খাটো বা বেঁটে। তাই বীজগুলোর চার ভাগের তিন ভাগ থেকে পাওয়া যাবে লম্বা মটরশুঁটিগাছ। বাকি এক ভাগ থেকে পাওয়া যাবে খাটো মটরশুঁটিগাছ। এদের মধ্যে TT ও ss বীজ থেকে পাওয়া মটরশুঁটিগাছগুলো হবে নিজ নিজ প্রজাতির প্রকৃত বংশধর। কিন্তু এখানে Ts ও sT বীজ থেকে পাওয়া গাছগুলো লম্বা হলেও তারা আসলে মিশ্র বা সংকর প্রজাতির।

এভাবে মেন্ডেল তাঁর মটরশুঁটিগাছের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নিয়েও একে একে পরীক্ষা করে দেখেন। মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন এসব বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও তাঁর এই ব্যাখ্যা মিলে গেল একদম খাপে খাপে। গাছের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করেন তিনি। শুধু খাটো আর লম্বা বৈশিষ্ট্য নয়, সবুজ বীজ উৎপাদনকারী লম্বা মটরশুঁটিগাছ নিয়েও গবেষণা করেন মেন্ডেল। আবার খাটো হয়ে জন্মানো সবুজ বীজ উৎপাদনকারী গাছ, হলুদ বীজ উৎপাদনকারী লম্বা গাছ ও হলুদ বীজ উৎপাদনকারী খাটো গাছ নিয়েও গবেষণা করেন। এসব গবেষণায় তিনি দেখতে পান, কোনটি প্রকৃত প্রজাতি আর কোনটি নয়। আবার পরবর্তী বংশধরে তিনি কোন ধরনের বীজ কী পরিমাণে পাবেন, তা-ও ব্যাখ্যা করতে পারছেন।

সুইস উদ্ভিদবিদ কার্ল উইলহেম ফন নেগেলির কাছে একটা গবেষণাপত্র লিখে পাঠান মেন্ডেল। নেগেলি ছিলেন ইউরোপে সে যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তিনি প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের লোকজনের কাছ থেকে অসংখ্য চিঠিপত্র পেতেন।

৪.

সবশেষে মেন্ডেল বুঝতে পারলেন, বিজ্ঞানীরা তাঁর কথায় কান দেবেন না। কারণ, তিনি ধর্মযাজক আর শখের উদ্ভিদবিদ। তা ছাড়া তিনি হাইস্কুলে শিক্ষক হতে চেয়েও পরীক্ষায় ফেল করার কারণে হতে পারেননি। তাই ভাবলেন, কোনো প্রতিষ্ঠিত উদ্ভিদবিদের কাছে তাঁর গবেষণাপত্র লিখে পাঠাবেন। কারণ, ওই উদ্ভিদবিদ যদি মেন্ডেলের গবেষণাকে মূল্যবান মনে করেন, তাহলে তাঁর কথা অন্য বিজ্ঞানীরা শুনবেন।

এ কারণে সুইস উদ্ভিদবিদ কার্ল উইলহেম ফন নেগেলির কাছে একটা গবেষণাপত্র লিখে পাঠান মেন্ডেল। নেগেলি ছিলেন ইউরোপে সে যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তিনি প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের লোকজনের কাছ থেকে অসংখ্য চিঠিপত্র পেতেন। অনেকে তাঁদের ভাবনা, গবেষণা, আবিষ্কার নেগেলিকে জানাতে চাইতেন। সেগুলোর অনেকগুলো নেগেলির কাছে আকর্ষণীয় মনে হতো না। অকেজো, অগুরুত্বপূর্ণ কিছু চিঠি দেখে মাঝেমধ্যে বিরক্তও হতেন তিনি। সম্ভবত মেন্ডেলের গবেষণাকেও উটকো ভেবে অমনোযোগের সঙ্গে চোখ বোলান নেগেলি। ভেবেছিলেন, এটাও হয়তো কোনো আনাড়ির কাজ। তাই মেন্ডেলের কাগজপত্র ফেরত পাঠান তিনি। এতে চরম হতাশ হন মেন্ডেল। অবশ্য পরে একটি ভালো বিজ্ঞান জার্নালে নিজের গবেষণার কথা প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। সেটি ছিল তাঁর কাজের খুব সামান্য অংশ। তবু কোনো উদ্ভিদবিদ সেদিকে তেমন নজর দেননি। এসব ঘটনায় মেন্ডেল এতই মর্মাহত হন যে তিনি উদ্ভিদ প্রজনন নিয়ে গবেষণা ছেড়ে দেন। ১৮৬৮ সালে তিনি এক মঠের অধ্যক্ষের পদ পান। গবেষণা ছেড়ে নিজেকে মঠের কাজে পুরোটা সময় নিয়োজিত করেন মেন্ডেল। এভাবে ১৮৮৪ সালে মারা যান তিনি।

এদিকে ১৮৯১ সালে মারা যান নেগেলি। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, কত বড় এক ভুল করে গেছেন। সেই ভুলের মাশুল হিসেবে এখন তাঁকে স্মরণ করা হয় শুধু এ কারণে যে তিনি মেন্ডেলের দিকে মনোযোগ দেননি। শুধু তিনিই নন, খোদ মেন্ডেলও জেনে যেতে পারেননি তাঁর প্রতিষ্ঠিত জীববিজ্ঞানের নতুন এ শাখাকে বলা হবে জেনেটিকস বা জিনতত্ত্ব। আর তার জনক হিসেবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে ঠাঁই পাবেন গ্রেগর মেন্ডেল।

সূত্র: হাউ উই নো অ্যাবাউট জিন, আইজ্যাক আসিমভ

দ্য জেনেটিক কোড, আইজ্যাক আসিমভ

উইকিপিডিয়া