খাদ্যপুষ্টি
আগামীর খাদ্য
বাবলগাম, আইসক্রিম কিংবা এনার্জি ড্রিংকস খেয়ে শরীরের যে খুব উপকার হয়, তা কিন্তু নয়। আশার কথা হলো, আগামী এক দশক পরে মানুষ নতুন কিছু খাদ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে চলেছে, যা কেউ কখনো দেখেনি আগে।
বাবলগাম ফোলাতে পারেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলেও ফোলানোর চেষ্টা করেনি এমন কাউকে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু একসময় এই বাবলগাম কেউ চোখেই দেখেনি। মানে ১৯২৮ সালের আগের কথা বলছিলাম আর কী। কিন্তু তারপর থেকেই তো শুরু হয়ে গেল পাল্লা দিয়ে বাবলগাম ফোলানোর প্রতিযোগিতা। একই রকমভাবে ১৯৩০ সালের আগে আইসক্রিমগুলোও এতটা নরম ছিল না। তখন আইসক্রিম খেতে দাঁতে বেশ জোর থাকতে হতো বৈকি! আবার ১৯৯০ সালের শেষ দিকে একধরনের ওষুধের গন্ধওয়ালা পানীয় বাজারে আসে। বর্তমানে যাকে এনার্জি ড্রিংকস নামে সবাই খাচ্ছে দেদার। এভাবেই দিনে দিনে খাদ্যের স্বাদে–গন্ধে বৈচিত্র্য এনেছে মানুষ।
যেসব খাওয়াদাওয়ার কথা হলো, তা কিন্তু বেশি খেতে নিষেধই করেন সবাই। কারণ, বাবলগাম, আইসক্রিম কিংবা এনার্জি ড্রিংকস খেয়ে শরীরের যে খুব উপকার হয়, তা কিন্তু নয়। আশার কথা হলো, আগামী এক দশক পরে মানুষ নতুন কিছু খাদ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে চলেছে, যা কেউ কখনো দেখেনি আগে।
আমরা সবাই জানি, যে স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেলে শরীর ভালো থাকে। খাদ্য ও শরীরের এই যে ওতপ্রোত সম্পর্ক, তা কিন্তু প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮০০ সালে। আর তা করেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ লিন্ড। তিনি আবিষ্কার করেন, লেবুজাতীয় ফল, অর্থাৎ ভিটামিন ‘সি’ খেলে স্কার্ভি রোগ হয় না। এই ফাঁকে বলে রাখি, সে সময় প্রচুর নাবিক সমুদ্রে গিয়ে স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতেন।
না না, স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিয়ে কোনো জ্ঞান দিতে বসিনি। বরং আগামী পৃথিবীর নতুন খাদ্যের কথা জানাব আজ। ডা. লিন্ডের মতো অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণায় আমরা পেয়েছি পুষ্টিকর খাদ্যের তালিকা। কিন্তু বর্তমান পুষ্টিবিজ্ঞান কিন্তু বলছে, সব মানুষ এক হলেও তাদের দৈহিক চাহিদায় কিছুটা তারতম্য রয়েছে। আর তাই খাদ্যভুবনে নতুন সংযোজন হতে চলেছে ব্যক্তিগত খাদ্য।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে তা নির্দিষ্ট ফসলে ঢুকিয়ে চাহিদামতো ফলন আনছেন।
এই প্রক্রিয়ায় প্রথমেই কারও ডিএনএ টেস্ট করা হবে। আর তা থেকেই জানা যাবে তার শরীরের জন্য কী প্রয়োজন। অথবা চিকিৎসক বলে দেবেন, আগামী দুই দিন একেবারেই ফুচকা খাওয়া চলবে না। কিছু কোম্পানি অবশ্য এরই মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এই ‘নিউট্রিজেনেটিক সার্ভিস’ শুরু করেছে। কিন্তু সেগুলো একেবারেই নির্ভুল হয়নি। ২০২৮ সাল নাগাদ এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট ধারণা নিতে পারবে বিজ্ঞান। খাদ্যবিজ্ঞানের নতুন এই ধারার প্রবর্তকদের একজন মার্কিন মুলুকের ম্যাসাচুসেটসে টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেফরি ব্লুমবার্গ। তিনি বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বলা সম্ভব, আপনার কোন সবজি কিংবা ফল খাওয়া প্রয়োজন এবং সেটা কত দিন পরপর।
কাঁচা গাজরের রং কী? কমলা, তাই তো! কিন্তু একসময় এর রং ছিল সাদাটে। আর আকারও ছিল বেশ ছোট। তরমুজ ছিল ছোট, গোল, শক্ত আর তিতা। ভাবছেন আবোলতাবোল বকছি? একদম না। হাজার বছর ধরে বাছাই করা প্রজাতির মধ্যে প্রজনন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিউটেশন এবং সঙ্গে নিবিড় খামারব্যবস্থা, সব মিলিয়ে বর্তমানের গাজর কিংবা তরমুজ পেয়েছি আমরা। আমাদের চারপাশের বিভিন্ন সবজি কিংবা ফলের ক্ষেত্রেই বিষয়গুলো প্রায় এক।
তবে বর্তমান বিজ্ঞান বিষয়গুলোকে দেখছে অন্যভাবে। চেষ্টা চলছে চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন ফল, শাকসবজি উৎপাদনের। প্রয়োজনে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে তা নির্দিষ্ট ফসলে ঢুকিয়ে চাহিদামতো ফলন আনছেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার কিছু বিজ্ঞানী কলার মধ্যে প্রো–ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন করেছেন, যেটা সাধারণ প্রজাতিতে অনুপস্থিত। এ জন্য তারা প্রথমে পাপুয়া নিউগিনি থেকে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির কলার ডিএনএ সংগ্রহ করেছেন, যাতে প্রো–ভিটামিন ‘এ’ উপস্থিত। পরে সেই ডিএনএ সাধারণ প্রজাতির মধ্যে স্থানান্তর করে ভিটামিন ‘এ’–সমৃদ্ধ কলা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সিলিকন ভ্যালি, বিখ্যাত বিশ্বের প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে। তবে ক্রমেই এই স্থানটি বিশ্বে পরিচিত খাদ্যের স্বাদে সৃজনশীলতার তৈরির জন্যও। সম্প্রতি তারা একটি মাংস ছাড়া বার্গার বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছে।
তবে এসব ক্ষেত্রে কোনো ফসলের অন্য প্রজাতি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটাও চেষ্টা চলছে, যাতে প্রয়োজনে যেকোনো জীব থেকেই ডিএনএ নিয়ে চাহিদামতো ফসল তৈরি করা যায়। আর তা সম্ভব হলে, যেকোনো ফসলকেই নির্দিষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ বানানো সম্ভব হবে। আর এসব জাদুর ঘটনা ঘটানো সম্ভব এক প্রযুক্তির মাধ্যমে, তার নাম ক্রিসপা ক্যাস৯। এর সফল প্রয়োগে একটি আপেল খেলেই হয়তো সব পুষ্টি মেলা সম্ভব। আবার শুধু মসুর ডাল দিয়ে ভাত খেলেই পাওয়া যাবে মাংসের সমান প্রোটিন।
সিলিকন ভ্যালি, বিখ্যাত বিশ্বের প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে। তবে ক্রমেই এই স্থানটি বিশ্বে পরিচিত খাদ্যের স্বাদে সৃজনশীলতার তৈরির জন্যও। সম্প্রতি তারা একটি মাংস ছাড়া বার্গার বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছে। কারণ, মাংস না থাকলেও সেই বার্গার খেয়ে তা একেবারেই মনে হয়নি। বিষয়টি অন্যদের জন্য বেশ মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। তারাও চাইছে নতুন কিছু করে সবাইকে তাক লাগাতে। সেটা হতে পারে মাংসবিহীন মাংস কিংবা দুধবিহীন দুধ। একটু আশ্চর্যের হলেও আগামী দিনে এ যে অসম্ভব নয়।
তবে এটুকু বলাই যায়, খাদ্যভুবনে আগামী এক দশকে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে চলেছে। যেখানে সুপারশপগুলোয় হেঁচকি কমানোর ললিপপ থেকে মিলবে নষ্ট পানি থেকে উৎপাদিত পানীয়ের বোতল। তবে ওই সময় পর্যন্ত সুপারশপ থাকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে এমন চকলেট ও আইসক্রিম বাজারে আনতে খাটছেন বিজ্ঞানীরা, যা খুব সহজেই গরমে গলে যায় না। আর তার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজি।
পরিবেশনের রকমফেরে খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতায় বেশ কম হয়ে থাকে। সে কারণেই আগামীর খাদ্যে পরিবেশনও একটা বড় বিষয়।
আগামী দিনে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার খেতে কোনো ধরাবাঁধা নিয়মে থাকার বালাই না রাখলেও চলবে। কারণ, এখানে মিলবে এমন সব বাহারি খাদ্য, যা কখনো চেখে দেখেনি কেউ। তার স্বাদ ও গন্ধও মন মাতাবে যে কারও। আর তা দেখেও না খেয়ে আসার কোনো মানে হয়? ভাবছেন বাইরের খাবার খেয়ে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে তো! এ নিয়ে মোটেই ভাবনা নেই। কারণ, সেসব খাদ্য বানানো হবে স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই। আবার ওজন বৃদ্ধিতে যে হরমোন দায়ী, তাকেও কাবু করতে সক্ষম হবে ভবিষ্যতের বিজ্ঞান। কাজেই মুটিয়ে যাওয়ার ভয়টাও নেই সেভাবে।
বলা হয়ে থাকে, পরিবেশনের রকমফেরে খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতায় বেশ কম হয়ে থাকে। সে কারণেই আগামীর খাদ্যে পরিবেশনও একটা বড় বিষয়। এ জন্য বিভিন্ন আকার–আকৃতি থেকে শুরু করে নতুন নতুন পদ্ধতির কথাও ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। ধরুন, কারও বাড়িতে গিয়ে রান্নাঘরে দেখলেন তরকারিতে পেঁয়াজবাটা মেশাচ্ছে এক রোবট। আবার অন্য হাতে রেফ্রিজারেটর থেকে বের করছে লঙ্কাবাটা। নিশ্চয়ই অবাক হবেন না, ভবিষ্যতের পৃথিবী বলে কথা। এখনই অবশ্য কিছু প্রতিষ্ঠান এমন রাঁধুনি রোবট বানাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের মোলে রোবটিকস এমনই এক প্রতিষ্ঠান, যারা ইতিমধ্যে স্বয়ংক্রিয় রান্নাঘর বানিয়েছে। এগুলো যেমন রান্নায় সক্ষম, তেমনি ধোয়ামোছা শেষে থালাবাসন গুছিয়ে রাখতেও পারদর্শী। আবার ওয়েটার হিসেবেও তাদের দেখা ইতিমধ্যেই মিলছে বিভিন্ন জায়গায়। তবে সামনের দিনগুলোয় একটা অ্যাপের মাধ্যমেই খাবারের অর্ডার সরাসরি পৌঁছে যাবে স্বয়ং রাঁধুনি রোবটের কাছে। এরপর কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা! ব্যস, আপনার টেবিলে গরম–গরম পৌঁছে যাবে অর্ডার দেওয়া খাবার। অন্যদিকে, খাদ্যের আকারেও আসছে থ্রিডির প্রয়োগ। এই থ্রিডি প্রযুক্তিতে অনেক জটিল কাজই সহজ হয়ে গেছে। এর ফলে রানি এলিজাবেথের মাথার মতো ললিপপ থেকে শুরু করে কোরাল আকৃতির বিস্কুট বানানো সম্ভব একনিমেষেই। এ কারণেই কাউকে ইচ্ছেমতো সারপ্রাইজ দেওয়াও সম্ভব খুব সহজেই।
লেখক: কৃষিবিদ ও সাংবাদিক
সূত্র: বিবিস ফোকাস
*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত