অণুজীবের বিশ্ব

অণুজীবকে পৃথিবীর সব জীবনের ভিত্তি বলা যেতে পারে। আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই, যে মাটির ওপর নির্ভর করি কৃষি কাজের জন্য, যে পানীয় পান করি, যে প্রক্রিয়ায় খাদ্য পরিপাক করি—মোট কথা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবই অণুজীবের কার্যকলাপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পৃথিবীর সব জায়গায় রয়েছে অণুজীব। এই অণুজীবরা মানুষের ত্বকের পৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ার এবং গভীর সমুদ্রপৃষ্ঠের হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত।

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ জেনে বা না জেনে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব থেকে নানা ধরনের উপকার পেয়ে আসছে। অতীতে মানুষ এ উপকারকে জাদু বলে মনে করত। আঙ্গুর থেকে কীভাবে ওয়াইন হয়, গম থেকে কীভাবে বিয়ার হয়, কিংবা দুধ থেকে কীভাবে পনির হয়—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অণুজীবঘটিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে আঠারো শতকের মানুষ ছিল অজ্ঞাত। এ নিয়ে তাদের মনে কোনো প্রশ্ন তৈরি হয়নি।

১৬৬৫ সালে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী জিরোলামো ফ্রাকাস্টোর ‘থিওরি অব কন্টেজিয়াস ডিজিজ’ (Theory of contagious disease) তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। এতে অণুজীব গঠিত প্রক্রিয়া বুঝতে সুবিধা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ডাচ বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ভন লিউয়েনহুক এবং ইংরেজ বিজ্ঞানী রবার্ট হুককে তাঁদের যুগান্তকারী কাজের জন্য অণুজীববিজ্ঞানের স্থপতি বলা হয়। ১৬৬৫ থেকে ১৬৭৮ সালের মধ্যে রবার্ট হুক প্রথম অণুজীবের চিত্র উপস্থাপন করেন। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে লিউয়েনহুক প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে জীবন্ত অণুজীব পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। যদিও এই আশ্চর্যজনক সাফল্য তাৎক্ষণিক সমসাময়িক মানুষজন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ তখন অনেকেই স্পন্টেনিয়াস জেনারেশন (Spontaneous Generation) তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল। এ ধারণা বলে, অজৈব বস্তু থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীব তৈরি হয়।

মানুষের ৯০ শতাংশ রোগব্যাধি কোনো না কোনোভাবে অন্ত্রস্থ অণুজীবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সত্যিকার অর্থে অণুজীববিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হতে প্রায় ১৫০ বছর লেগেছে। আর অণুজীববিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রার জন্য লুই পাস্তুর, এডওয়ার্ড জেনার, আলেকজান্ডার ফ্লেমিংসহ অনান্যদের আন্তরিক সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন। কারণ তাঁরা অণুজীবকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

গত ১০০ বছরে অণুজীববিজ্ঞানের অভাবণীয় অগ্রগতি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন ক্রিসপার-ক্যাস ৯-এর মতো পদ্ধতি সম্পর্কে জেনেছেন। নিপূণভাবে অণুজীবকে পরিবর্তন করে দুরারোগ্য রোগব্যাধি,—যেমন ক্যান্সার নিরাময়ে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে স্বল্প সময়ে অধিক নিত্য ব্যবহার্য শিল্পসামগ্রী উৎপাদন করতে হয় এবং কীভাবে শিল্পবর্জ্য দূষণ নিরাময় করতে হয়,—এগুলো তাঁরা এখন জানেন। মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি মাইলফলক হলো ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের শুরু করা দ্য হিউম্যান মাইক্রোবায়োম প্রজেক্ট (The Human Microbiome Project)। মানবদেহের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন অণুজীব সম্পর্কে জানা এবং সে সব অণুজীবের মানবস্বাস্থ্য ও রোগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা দেখাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। অবাক করা বিষয় হলো, মানবদেহের নিজস্ব কোষের তুলনায় অণুজীবের সংখ্যা অনেক বেশি। এর অণুপাত ১০: ১। আরও অবাক করার বিষয়, এই অণুজীবের ৯৫ শতাংশের আবাস্থল মানুষের অন্ত্র। এ থেকেই অনুমেয়, মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগে অণুজীবের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষের ৯০ শতাংশ রোগব্যাধি কোনো না কোনোভাবে অন্ত্রস্থ অণুজীবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর কলামিস্ট ও লেখক কার্ল জ্যিমারের আ প্লানেট অব ভাইরাস পড়লে অনুধাবন করা যায়, এইচআইভি, মার্স ও ইবোলার মতো আণুবীক্ষণিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের রয়েছে পৃথিবী পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা। কোভিড ১৯ মহামারি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। যদিও অণুজীব মানেই জীবাণু নয়, যা সবসময় রোগব্যাধি সৃষ্টি করে। ১৯ শতকে গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার এবং বিশ শতকের শুরুতে পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার ওষুধ শিল্পে অণুজীব ব্যবহারের প্রাথমিক অগ্রগতি বলা যেতে পারে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরণের অতি সহনশীল অণুজীব ব্যবহার করে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্প-জীব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছেন।

বর্তমানে সহস্র অণুজীবঘটিত যৌগ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা বহুলভাবে অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টিফাংগাল ড্রাগ হিসেবে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়াও অণুজীবভিত্তিক সাপ্লিমেন্ট অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে রোগ নিরাময়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) ২০২৩ সালের শুরুর দিকে প্রথম সেবনযোগ্য অণুজীবভিত্তিক সাপ্লিমেন্ট ‘SER-19’ (বাণিজ্যিক নাম Vowst) অনুমোদন দিয়েছে। এটি ক্লোস্টিডায়োডেস ডিফসাইল (Clostridiodes diffcile) ব্যাকটেরিয়া-সৃষ্ট ডায়রিয়া নিরাময়ে কাজ করে।

চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও প্রকৃতিতে অণুজীবের অস্তিত্ব ও ভূমিকা অতুলনীয়। অণুজীবরা প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ও জৈবরাসায়নিক (Biogeochemical) চক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলো বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ত্যাগ করে ও ক্ষতিকর গ্রিন হাউস গ্যাস শোষণ করে, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান নাইট্রোজেন সরবরাহ করে এবং মৃত জৈব-সামগ্রী প্রক্রিয়াজাত করে নতুন জীবন বিকাশে পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়াও বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় টেকসই পরবর্তী প্রজন্মের জীবাশ্ম জ্বালানি (Biofuel) উৎপাদনে সালোকসংশ্লেষী অণুজীব—যেমন ক্ষুদ্র শৈবাল ও সায়ানোব্যাকটেরিয়া—ব্যবহৃত হচ্ছে।

শিল্পক্ষেত্রেও অণুজীবের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, যেমন পাউরুটি, দই, পনির, প্রক্রিয়াজাত মাংস, এনজাইম ও পানীয় ইত্যাদি উৎপাদনে অণুজীব ও তাদের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরণের অতি সহনশীল অণুজীব ব্যবহার করে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্প-জীব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছেন। আর অতি সহনশীল অণুজীবের একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োগক্ষেত্র হচ্ছে, আকরিক থেকে বিভিন্ন অণুজীবঘটিত জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মূল্যবান ধাতু, যেমন কপার, সোনা ও ইউরেনিয়াম আহরণ করা। এটি বায়োমাইনিং নামে পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কপার বায়োমাইনিং কোম্পানি বায়োসিগমা। এতে চিলির আতাকামা মরুভূমি থেকে পাওয়া আকরিক থেকে অতি সহনশীল অণুজীব ব্যবহারের মাধ্যমে কপার উৎপাদন করা হয়। এ জন্য ব্যবহৃত হয় অ্যাসিডোথিওব্যাসিলাস ফেরোক্সিডানস (Acidithiobacillus ferrooxidans) এবং থিওব্যাসিলাস ফেরোক্সিডানস (Thiobacillus ferroxidans)।

একুশ শতকের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগগুলোর একটা হলো, বহির্জাগতিক প্রাণের সন্ধান করা। এলিয়েন সভ্যতার সূত্র খোঁজার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রাতের আকাশে রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন।

বর্তমানে বিশ্বের ২০ শতাংশ কপার উৎপাদন করা হয় বায়োমাইনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, মহাকাশবিজ্ঞানীরা বায়োমাইনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাশূন্যে গ্রহাণুপুঞ্জ বা ভিনগ্রহ থেকে বিরল মৃত্তিকা মৌল (Rare Earth Elements) আহরণের চিন্তাও করছেন। ২০১৯ সালে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ইসা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ‘বায়োরক’ নামে একটি পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, স্ফিঙ্গোমোনাস ডেসিকাবিলিস (Sphingomonas desiccabilis) নামের একধরনের ব্যাকটেরিয়া চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে ব্যাসাল্ট থেকে বিরল মৃত্তিকা মৌল আহরণ করতে পারে।

একুশ শতকের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগগুলোর একটা হলো, বহির্জাগতিক প্রাণের সন্ধান করা। এলিয়েন সভ্যতার সূত্র খোঁজার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রাতের আকাশে রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন। কিন্তু অণুজীববিজ্ঞান কি অন্যান্য গ্রহ, গ্রহাণু কিংবা গভীর মহাকাশে জীবন বা প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলতে বা ধারণা দিতে পারে? বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, অতি সহনশীল বা এক্সট্রিমোফিলিক অণুজীবরা পৃথিবীতে বিভিন্ন চরমভাবাপন্ন পরিবেশে যেভাবে নিজেদের অভিযোজিত করে বেঁচে থাকে, তা অনেকটা ভিনগ্রহের চরমভাবাপন্ন পরিবেশের মতো। অদূর ভবিষ্যতে এটি বহির্জাগতিক প্রাণের অনুসন্ধানের খোরাক হতে পারে কিংবা এমন কোনো বহির্বিশ্বের সন্ধান দিতে পারে, যেখানে আগে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল।

উদাহরণস্বরূপ, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের লেক ভস্টকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অণুজীবের ক্রিয়াকলাপ আবিষ্কার করেছেন। এটা অনেকটা বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপার মতো হিমশীতল ও অলিগোট্রপিক পরিবেশের সমতুল্য। অন্যদিকে আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত উষ্ণ স্রোতে হাইপারথার্মোফিলিকের মতো অতি সহনশীল অণুজীব অবিষ্কার আমাদের প্রতিবেশী মঙ্গলগ্রহের অনুরূপ পরিবেশের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ওদিকে শনির চাঁদ টাইটানে অ্যামোনিয়া ও মিথেন সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে বৈদ্যুতিক আধানযুক্ত পরিবেশে অ্যামোনিয়াম ও মিথেন একত্রিত হয়ে জৈব যৌগ গঠন করতে পারে এবং গভীর সাগরের তলদেশের উষ্ণ স্রোতে অনুরূপ এক্সট্রিমোফিলিক অণুজীব এই মিথেনসমৃদ্ধ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মঙ্গলের মাটির মতো একই রকম উপাদান দিয়ে তৈরি মাধ্যমে (ইংরেজিতে বলে মিডিয়াম, গবেষণাগারে অণুজীব চাষের জন্য তৈরি বিশেষ বৃদ্ধিবর্ধক খাবার) এ মিথানোজেনস (Methanogens) চাষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আরকানসাসের একদল বিজ্ঞানী প্রাথমিকভাবে দেখিয়েছেন, মঙ্গলের মাটিতে প্রাণ বা জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে।

প্রাণ বা জীবনের সঙ্গে অণুজীবের বন্ধন অবিচ্ছেদ্য। তাই বলা যায়, অণুজীবের মাধ্যমে জীবনের উৎপত্তি, বিকাশ এবং অণুজীবের মাধ্যমেই জীবনের বিনাশ।

লেখক: পিইএচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র; সহকারী অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

**নিবন্ধটি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা ও সংবাদের আলোকে রচিত